অলিম্পিক, ফ্রান্স ও বাংলাদেশ!

অলিম্পিক, ফ্রান্স ও বাংলাদেশ!

চোখের পলকেই কেটে গেল প্যারিস অলিম্পিক গেমস। ২২ জুলাই বিকেলে প্যারিস পা রেখেছিলাম গেমস কাভার করতে। ২০ দিন কেটে গেল যেন নিমিষেই!

চোখের পলকেই কেটে গেল প্যারিস অলিম্পিক গেমস। ২২ জুলাই বিকেলে প্যারিস পা রেখেছিলাম গেমস কাভার করতে। ২০ দিন কেটে গেল যেন নিমিষেই!

অন্য টুর্নামেন্ট বা প্রতিযোগিতার চেয়ে গেমস বেশ আলাদা। এখানে পদকের লড়াই যেমন আছে, তেমনি আছে সৌহার্দ্যতা-ভাতৃত্ব। আন্তরিকতার অন্যতম মাধ্যম কোটপিন বিনিময়। খেলোয়াড়, কোচ,কর্মকর্তা, সাংবাদিক, ভলান্টিয়ার থেকে শুরু করে সবাই কোটপিন আদান-প্রদান করেন। এর মধ্যে একটি কমন প্রশ্ন থাকে, ‘তোমার দেশের কতটি পদক হলো?’ বাংলাদেশ থেকে গেমসে আসা ব্যক্তিবর্গের তখন নিশ্চুপ অথবা ভদ্রতার খাতিরে মৃদুস্বরে বলতে হয় ‘নো সো ফার’।

অলিম্পিকে প্রতি পরতে পরতে আছে গল্প, শিক্ষা। বাংলাদেশ ১৯৮৪ সাল থেকে অলিম্পিকের যাত্রী। ১১ অলিম্পিকে অংশগ্রহণ করলেও শিক্ষা গ্রহণ ও প্রয়োগের মাত্রার বিষয়টি বড় আলোচনাযোগ্য। প্রতি গেমসের আগেই আপ্তবাক্য, ‘অংশগ্রহণ ও অভিজ্ঞতা অর্জন’। অলিম্পিকে অংশ নেয়া ক্রীড়াবিদ-কর্মকর্তারা সেই অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে কতটুকু ব্যবহার করেন সেই প্রশ্ন উঠছে। টোকিও অলিম্পিকে খেলা দুই সাতারু বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন। আরো অনেক অলিম্পিয়ান ক্রীড়াবিদ রয়েছেন যারা বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন থেকে সরে যান অথবা সরতে বাধ্য হন।

অলিম্পিকের প্রতি আসরেই নতুন নতুন দেশ পদকের তালিকায় যোগ হচ্ছে। বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী দুই দেশ ভারত-পাকিস্তান অলিম্পিকে পদক জেতে আগে থেকেই। ভারত ২০০৮ সালে ব্যক্তিগত ইভেন্টে স্বর্ণ আর এবার পাকিস্তানও অলিম্পিকে প্রথম ব্যক্তিগত ইভেন্টে স্বর্ণ জিতেছে। সেখানে বিশ্বের অন্যতম জনবহুল দেশ হয়েও বাংলাদেশ পদকের খাতা তো দূরের কথা, ফাইনাল রাউন্ডেই নাম লেখাতে পারছে না। অদূর ভবিষ্যতেও উঠবে কিনা ঘোরতর সংশয় রয়েছে।

পদক অর্জনের জন্য প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য-পরিকল্পনা। স্বাধীনতার অর্ধ শতাব্দী হলেও বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন চলছে লক্ষ্যহীন যাত্রাই। এর দায় অবশ্য মূলত সংগঠকদেরই বেশি। তারা নিজেদের পদ আকড়ে ধরতে যতটা মাথা খাটান এর কিয়দংশ ক্রীড়া উন্নয়নে ব্যবহার করেন না। প্যারিস অলিম্পিক গেমসেও কোচের পরিবর্তে কর্মকর্তা, আবার কোচ থাকলেও উদ্বোধনী নৌকায় কর্মকর্তার উপস্থিতি ও নানা কান্ডে আলোচনায় ছিল বাংলাদেশ কন্টিনজেন্ট। গতকাল সমাপনীতে বাংলাদেশের পতাকা বহন করেছেন গেমসের এক ভলান্টিয়ার। এটাও তেমন কাম্য নয়।

১৯৮৪ সালের লস অ্যাঞ্জেলস থেকে প্যারিস বাংলাদেশের অলিম্পিক কম-বেশি একই। ২০১৬ সাল থেকে অবশ্য টানা তিন বার একজন করে ক্রীড়াবিদ সরাসরি অলিম্পিক খেলছেন এতটুকুই উন্নতি। এতেই তৃপ্তির ঢেকুর।

বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রীড়া মঞ্চ অলিম্পিক। এখানে শুধু পদকের লড়াই নয়; ভাতৃত্ব-সহমর্মিতা আরো অনেক কিছু শেখারই ক্ষেত্র। বাংলাদেশ অবশ্য এখান থেকেও খুব শিক্ষা গ্রহণ করে না। বিশেষ করে কর্মকর্তাদের  লক্ষ্য থাকে নিজেই বারবার অলিম্পিকে আসার। অভিজ্ঞ-যোগ্য অনেকে উপেক্ষিত হন।

অলিম্পিক এমন একটি আসর যেখানে পদক জয়ী যে সম্মান, সবার শেষে যিনি ফিনিশিং টাচ স্পর্শ করেন তার জন্যও হয় করতালি। প্যারিস অলিম্পিকে নারী ম্যারাথনে ভূটানের অ্যাথলেট দৌড় শেষ করেছেন স্বর্ণজয়ীর ৯০ মিনিট পর। ভূটানী অ্যাথলেটের প্রাপ্তির কিছু ছিল না এরপরও অদম্য স্পৃহার জন্য প্রশংসিত হয়েছেন।

বাংলাদেশের চার ডিসিপ্লিন সাতার, অ্যাথলেটিক্স, শুটিং, আরচ্যারি ছাড়াও টেনিস, ভারত্তোলন, ভলিবল,ফুটবল আরো কয়েকটি ভেন্যুতেও যাওয়া হয়েছে। প্রতি ভেন্যুই ছিল দর্শকে পরিপূর্ণ। হিট, পদকের খেলা না থাকলেও দর্শক-সমর্থকরা খেলা উপভোগ করেছেন আগ্রহভরে। পদক ও তারকা দর্শক নয় ক্রীড়াপ্রেম সর্বাগ্রে এটাও অলিম্পিকের একটা বার্তা অথচ বাংলাদেশে শুধু ক্রিকেটমুখো সমাজ।

মানুষ যত বড় হয়, তত বিনয়ী হয়। অলিম্পিয়ান অনেক ক্রীড়াবিদ সেই বার্তাই বয়ে বেড়ান। টেনিস তো বটেই, বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনের অন্যতম কিংবদন্তী সার্বিয়ান নোভাক জোকোভিচ। স্বর্ণ জয়ের পর জোকোভিচের সংবাদ সম্মেলন ছিল যেন এক আদর্শ স্কুল। প্রতি শব্দ-বাক্য ছিল বিনয়,দর্শন, আবেগ ও যুক্তির সংমিশ্রণ। মাঠ নয়-মাঠের বাইরেও অলিম্পিকে থাকা অনেক শিক্ষার উপকরণ। বাংলাদেশের ক্রীড়াবিদরা অবশ্য উল্টো-বিশেষত ক্রিকেটাররা। সাম্প্রতিক দাম্ভিকতাই যেন তাদের আচরণের অংশ হয়ে দাড়িয়েছে।

বিশ্ব রাজনীতির মতো অলিম্পিকের পদক তালিকাও ‘যুদ্ধ’ ছিল আমেরিকা ও চীনের মধ্যে। সমাপীন অনুষ্ঠানের কয়েক ঘন্টা আগে আমেরিকার শ্রেষ্ঠত্ব নিশ্চিত হয়েছে। নারী বাস্কেটবলের ফাইনালে স্বর্ণ না জিতলেই চীন অলিম্পিকে প্রথম হতো। আমেরিকা ও চীনের এই শ্রেষ্ঠত্বেরও মধ্যেও রয়েছে বার্তা। তারা বিশ্বের মোড়ল হলেও ক্রীড়াখাতে অনেক বিনিয়োগ ও পরিকল্পনা করে। ক্রীড়ার মাধ্যমে দুই দেশ নিজেদের বৈশ্বিক পরিচয় ও সুনাম বৃদ্ধি করে।

করোনা, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের পর সারা বিশ্বের রাজনীতি ও অর্থনৈতিক অবস্থা বদলেছে। তাই স্বাগতিক হিসেবে ফ্রান্সের চ্যালেঞ্জ ছিল অনেক বেশি। রাজনৈতিক-সামরিক ও কূটনৈতিক নানা হুমকি ছিল প্যারিস অলিম্পিক ঘিরে। প্যারিস অলিম্পিক সেই সকল চ্যালেঞ্জ উতরে বেশ সফল গেমস উপহার দিয়েছে বিশ্বাবসীকে। বিশেষ করে স্টেডিয়ামের বাইরে নদীতে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মার্চপাস্ট ইতিহাসের পাতায় রাখতে বাদ্য হচ্ছে প্যারিসকে।

শিল্প-সংস্কৃতির নগরী প্যারিস। একশ বছর পর অলিম্পিকের আয়োজক হয়ে কোনো কমতি রাখেনি। প্রচার-প্রচারণা, সুযোগ-সুবিধা সব কিছুই করেছে উদারহস্তে। গেমসে অ্যাক্রিডিটেশনধারীরা প্যারিস শহরে ট্রেন, মেট্রো,বাস, ট্রাম সব কিছুতেই বিনামূল্যে যাতায়াত করেছেন। বড় ধরনের কোনো অব্যবস্থাপনা বা ত্রুটি চোখে পড়েনি। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রো ইউরোপের এখন শীর্ষ নেতা। সফল প্যারিস অলিম্পিক বাস্তবায়ন তার জন্যও ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। তিনি ফ্রান্সকে সেই চ্যালেঞ্জ উতরে দিয়েছেন। তাই আইওসি, ফ্রান্স ফুল লেটার মার্ক! আর বাংলাদেশ…

এজেড/এইচজেএস 

Visit Source Page

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *