বাংলাদেশ ক্রিকেট যেন ব্যর্থতার ‘পুরোনো কাসুন্দি’

বাংলাদেশ ক্রিকেট যেন ব্যর্থতার ‘পুরোনো কাসুন্দি’

‘এমন বাংলাদেশই কি আমরা চেয়েছিলাম?’ সাম্প্রতিক সময়ে কৌতুক, ক্ষোভ কিংবা অনুযোগের সুরে এই বাক্যটি অনেক বেশি ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রেক্ষাপটে হয়তো সেটি কিছুটা পরিবর্তন হয়ে দাঁড়াবে– ‘আমরা এমন বাংলাদেশ দেখেই অভ্যস্ত!’ অর্থাৎ, কালেভদ্রে আমরা চমক দেখালেও বর্তমান রূপটাই আমাদের আদি এবং আসল! যতবারই এ নিয়ে আলোচনা আসে, ‍যেন অপরিবর্তিত ‘পুরোনো কাসুন্দি ঘেঁটে’ (অতীতের অপ্রীতিকর আলোচনা) চলেছি বারংবার!

‘এমন বাংলাদেশই কি আমরা চেয়েছিলাম?’ সাম্প্রতিক সময়ে কৌতুক, ক্ষোভ কিংবা অনুযোগের সুরে এই বাক্যটি অনেক বেশি ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রেক্ষাপটে হয়তো সেটি কিছুটা পরিবর্তন হয়ে দাঁড়াবে– ‘আমরা এমন বাংলাদেশ দেখেই অভ্যস্ত!’ অর্থাৎ, কালেভদ্রে আমরা চমক দেখালেও বর্তমান রূপটাই আমাদের আদি এবং আসল! যতবারই এ নিয়ে আলোচনা আসে, ‍যেন অপরিবর্তিত ‘পুরোনো কাসুন্দি ঘেঁটে’ (অতীতের অপ্রীতিকর আলোচনা) চলেছি বারংবার!

আমরা যে ‘টাইগার ক্রিকেট’ শব্দদ্বয় ব্যবহার করি, সেটি নিয়েও দেশের সমর্থকদের বড় একটা অংশ অনেকদিন ধরে আপত্তি জানিয়ে আসছেন। সেটি ক্রিকেটারদের বাজে পারফরম্যান্স কিংবা খেলার ধরন দেখে। আমাদের ক্রিকেট আদতে কতটুকু উন্নত হয়েছে, সেই প্রশ্ন পুনরায় তোলার সুযোগ করে দিয়েছে ভারতে বাংলাদেশের চলমান সফর। টেস্ট সিরিজের পর টি-টোয়েন্টিতেও যেখানে ন্যূনতম লড়াই করতে পারেনি নাজমুল হোসেন শান্তর দল।

একই চিত্রনাট্য

রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর আগস্টেই বাংলাদেশ দল পাকিস্তান সফরে গিয়ে ইতিহাস গড়ে ফেলেছে। যাদের বিপক্ষে আগে কখনও টেস্ট জয়ের নজির ছিল না, তাদের ২-০ ব্যবধানে সিরিজ হারায় টাইগাররা। সেই দৃশ্য ভারতেও দেখা সম্ভব কি না, এমন প্রশ্ন উঁকি দিলেও বাস্তবতা বুঝে আমরা নিজেদের সংবরণ করেছি। কারণ রোহিত শর্মার দলের সামর্থ্য সবারই জানা, যারা বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের দুই আসরেই ফাইনাল খেলেছে।

যাইহোক, ২৪ বছরের টেস্ট ইতিহাস থাকা বাংলাদেশের কাছে জয়ের তাড়না কিংবা লড়াই দেখতে চাওয়া তো দোষের নয়। কিন্তু এখানেও সেই পুরোনো চিত্রনাট্য, সাদমান-মুমিনুল রান পেলেন তো, মুশফিক-শান্তরা ব্যর্থ। আবার প্রথম ইনিংসে দারুণ লাইন-লেংথে বল করা তাসকিন-নাহিদ রানারা পরের ইনিংসে যাচ্ছেতাই। ফলে যা হওয়ার কথা তাই হলো। প্রথম টেস্টে ২৮০ রান আর পরেরটিতে ৭ উইকেটের বড় ব্যবধানে হার। টেস্টে রোহিত-কোহলি-পান্ত ও জাসপ্রিত বুমরাহদের মতো তারকারা ছিলেন।

তাদের ছাড়াই শুরু হয় টি-টোয়েন্টি, এমনকি যশস্বী জয়সওয়াল, শুভমান গিল কিংবা কুলদীপ যাদবরাও নেই। দ্বিতীয় সারির দলের সামনেও বাংলাদেশ নখদন্তহীন। দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টিতে তো শান্ত-মাহমুদউল্লাহ সহ প্রথম সাত ব্যাটারই আউট হয়েছেন ভিন্ন সাত বোলারের বলে। অর্থাৎ বোলিংয়ে আসা কাউকেই হতাশ হতে হয়নি। আর্শদীপ, মায়াঙ্ক যাদব ও বরুণ চক্রবর্তীর মতো নিয়মিতরা উইকেট তো পেয়েছেনই; বাদ ছিলেন না অভিষেক শর্মা ও রিয়ান পরাগের মতো পার্ট-টাইম বোলারও। যদিও এর আগে আরও তিনবার টি-টোয়েন্টিতে (জিম্বাবুয়ে, শ্রীলঙ্কা ও আয়ারল্যান্ড) আমরা সমান সাত বোলারকে উইকেট দিয়েছি।

মুখস্ত ব্যাটিং লাইনআপ

চলমান টি-টোয়েন্টি সিরিজের জন্য বাছাইকৃত ভেন্যুগুলো যে বড় রানের ইনিংস খেলার উপযোগী সেটি শুরু থেকেই আলোচনায় ছিল। বিশেষত গোয়ালিয়রে ঘরোয়া টুর্নামেন্ট এবং দিল্লির অরুণ জেটলি স্টেডিয়ামে হওয়া আইপিএলের পরিসংখ্যান সে কথাই বলে। গোয়ালিয়রের মাধবরাও সিন্ধিয়া স্টেডিয়ামে গড় রান ১৭০-১৮০ হলেও, বাংলাদেশ প্রথম ম্যাচে তোলে সর্বসাকুল্যে ১২৭। যথারীতি ওপেনিংয়ে লিটন-পারভেজ ইমনের ব্যর্থতা। এরপর রিয়াদ,তাওহীদ হৃদয় ও জাকের আলিরা ছিলেন সেই করুণ চিত্রের নিখুঁত শিল্পী। ছোট পুঁজি ভারত পেরোয় ১২ ওভারের আগেই।

ওই ম্যাচেই টাইগারদের ব্যাটিংয়ে রোটেশন আনার কথা ধারাভাষ্য বক্সে আলোচনা হয়েছে। খোদ সাবেক অধিনায়ক তামিম ইকবালও বললেন, মেহেদী মিরাজকে মেক-শিফট ওপেন করার কথা। যেমনটা গত এশিয়া কাপ ও ওয়ানডে বিশ্বকাপে ওপেনিংয়ের দুশ্চিন্তা কাটাতে প্রয়োগ করা হয়েছিল। তবে দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টিতেও মুখস্ত রোটেশনেই বাংলাদেশ খেলতে নামে। অথচ ওভারপ্রতি ১১.০৫ গড়ে ভারতের ২২১ রান তাড়ায় ভিন্ন কিছুই করতে হতো।

ভারতের উত্তর-আধুনিক ক্রিকেটের বিপরীতে শান্তরা খেলেছেন নিজেদের চিরচেনা সেই মান্ধাতার কৌশলে। শেষমেষ ভদ্রস্থ কিছু করা হয়নি, বাংলাদেশ থেমেছে ৯ উইকেটে ১৩৫ রানে। অবশ্য বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টির পরিসংখ্যানও এরচেয়ে বেশি উন্নত নয়। সেটাই দেখে নেওয়া যাক— ফর‌ম্যাটটিতে বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত ১৭৮ ম্যাচ খেলেছে। এর মধ্যে আগে ব্যাট করে (৮৫ ইনিংসে) ওভারপ্রতি রান তুলেছে ৭.৩৯ গড়ে। প্রথম ইনিংসে ব্যাট করে তাদের গড় স্কোর ১৪৭.৮। আর পরে ব্যাট করে (৯২ ইনিংস) গড় স্কোর ১৪৯.২, ওভারপ্রতি রানের গড় ৭.৪৬।

প্রশ্নবিদ্ধ শান্ত’র অধিনায়কত্ব

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে তিন ফরম্যাটেই বাংলাদেশের অধিনায়ক করা হয় শান্তকে। এরপর ম্যাচে তার নেতৃত্বের ভুল-ত্রুটি যেমন সামনে এসেছে, তেমনি উন্নতিও দেখা গেছে কখনও কখনও। তবে পরিস্থিতি বুঝে বোলিং কিংবা ফিল্ডার সেটিংয়ের দক্ষতা তিনি এখনও আয়ত্তে আনতে পারেননি। গতকালও ভুলের শুরুটা হয় আইপিএলে এই মাঠেই স্পিনারদের তুলোধুনা করা অভিষেক শর্মার বিপরীতে মেহেদী মিরাজকে ওপেনিং বোলিংয়ে এনে। ওই ওভারে তিনি খরচ করেন ১৫ রান।

যদিও তাসকিন ও তানজিম সাকিবের দুর্দান্ত বোলিংয়ে হোঁচট কাটিয়ে ম্যাচে ফেরে বাংলাদেশ। এর ভেতর অবশ্য কিছুটা চমক হয়ে আসে রানের পিচেও মুস্তাফিজুর রহমানের কার্যকরী কাটার-স্লোয়ার। ষষ্ঠ ওভারে এসেই তিনি স্লোয়ারের ফাঁদে ফেলেন ভারতীয় অধিনায়ক সূর্যকুমার যাদবকে। আগ্রাসী রূপ ধরার আগেই তিনি ক্যাচ আউট হয়ে যান। অথচ এরপর ওভার দশেকের ভেতর আর সেই ফিজকে বোলিংয়ে আনলেন না শান্ত। স্পিনাররা টানা চার ওভার করে রান (৫৬) বিলিয়েছেন মুক্ত হাতে।

ভারতের দুই সেট ব্যাটার নিতীশ কুমরা রেড্ডি এবং রিংকু সিং–ও পরবর্তীতে কোন বোলার আসছেন, তা আর দেখেননি। ফলে বাংলাদেশের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টিতে রেকর্ড সর্বোচ্চ ২২১ রান পেয়ে যায় স্বাগতিকরা। ম্যাচটিতে টাইগারদের বিপক্ষে সর্বোচ্চ ছয়ের (১৫) রেকর্ডও গড়েছেন রিংকু-রেড্ডিরা। বিসিবির সরল স্বীকারোক্তি– ‘বিকল্প নেই’

বাংলাদেশের ৮০ রানে হারের ম্যাচটিতে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ ৪১ রান করেছেন ফরম্যাটটিতে বিদায়ী সিরিজ খেলতে নামা মাহমুদউল্লাহ। তবে তার ৩৯ বলের ইনিংসটি দলের জন্য কার্যকরী কিংবা টি-টোয়েন্টি সুলভ– কোনো ক্যাটাগরিতেই পড়ে না। তবুও বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ইনিংস বলে কথা। যা রিয়াদ ও সাকিব আল হাসান পরবর্তী বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি ভবিষ্যৎ নিয়েও শঙ্কার কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে।

আলোচনা চলছে জাতীয় দলে সাকিব-রিয়াদদের বিকল্প হবেন কে? যদিও এই দুজনই ফরম্যাটটির জন্য আদর্শ নন! এ প্রসঙ্গে নিজেদের ব্যর্থতার কথা অকপটে জানিয়েছেন বিসিবির পরিচালক নাজমুল আবেদীন ফাহিম। দেশের ক্রিকেটে জনপ্রিয় এক অধ্যায় ‘পঞ্চপান্ডব’–এরও সমাপ্তি ঘটতে চলেছে রিয়াদের অবসরে। যা নিয়ে ফাহিমের ভাষ্য, ‘ভালো লাগার দিকটা হচ্ছে তারা (পঞ্চপাণ্ডব) বাংলাদেশের ক্রিকেটকে একটা লেভেল থেকে অন্য আরেকটা লেভেলে নিয়ে এসেছে। দারুণভাবে খেলেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।’

এরপরই বিকল্প ক্রিকেটার তৈরি করতে না পারার হতাশা জানিয়ে বলেন, ‘একই সময় আমাদেরই ব্যর্থতা আমরা তাদের এতদিন খেলতে দেখেছি বা খেলতে দিয়েছি। কিন্তু তাদের চেয়ে ভালো ক্রিকেটার তৈরি করতে পারিনি। খুবই খুশি হতাম যদি তাদের চেয়েও ভালো ক্রিকেটার তৈরি করতে পারতাম। ওদের চেয়েও ভালো ক্রিকেটার যদি জাতীয় দলে খেলত। কিন্তু এটা ওরাই করতে দেয়নি। তাদেরকে কৃতিত্ব দিতে হবে।’

আগামী শনিবার হায়দরাবাদের রাজীব গান্ধী স্টেডিয়ামে সিরিজের তৃতীয় ও শেষ টি-টোয়েন্টিতে মুখোমুখি হবে বাংলাদেশ-ভারত। সেই ম্যাচটিকে বাংলাদেশ কেবলই ‘নিয়মরক্ষা’ নাকি হোয়াইটওয়াশ এড়ানোর লক্ষ্য হিসেবে নেয়, সেটাই এখন দেখার অপেক্ষা!

এএইচএস

Visit Source Page

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *