জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ভোলার মেঘনা-তেঁতুলিয়া নদীর পানির প্রবাহ কমে গেছে। ফলে নদীর তলদেশে পলিথিনের স্তূপ জমা পড়েছে। রাজাপুর থেকে মেঘনা নদীর চর পিয়াল পর্যন্ত ৯০ কিলোমিটার এবং ভেদুরিয়া থেকে চর রুস্তম পর্যন্ত তেঁতুলিয়া নদীর ১০০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে জেগে উঠেছে ছোট-বড় অর্ধশতাধিক ডুবোচর। পলিথিনের স্তূপ আর জেগে ওঠা ডুবোচর বাধা সৃষ্টি করছে ইলিশের প্রজননে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইলিশের নির্বিঘ্ন প্রজনন নিশ্চিত করে উৎপাদন বাড়াতে ডুবোচর খনন করে নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে হবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ভোলার মেঘনা-তেঁতুলিয়া নদীর পানির প্রবাহ কমে গেছে। ফলে নদীর তলদেশে পলিথিনের স্তূপ জমা পড়েছে। রাজাপুর থেকে মেঘনা নদীর চর পিয়াল পর্যন্ত ৯০ কিলোমিটার এবং ভেদুরিয়া থেকে চর রুস্তম পর্যন্ত তেঁতুলিয়া নদীর ১০০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে জেগে উঠেছে ছোট-বড় অর্ধশতাধিক ডুবোচর। পলিথিনের স্তূপ আর জেগে ওঠা ডুবোচর বাধা সৃষ্টি করছে ইলিশের প্রজননে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইলিশের নির্বিঘ্ন প্রজনন নিশ্চিত করে উৎপাদন বাড়াতে ডুবোচর খনন করে নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে হবে।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র ও জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত কয়েক বছর ধরে ইলিশ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধারাবাহিকভাবে বাড়িয়ে যাচ্ছে জেলা মৎস্য দপ্তর। মৌসুম শেষে উৎপাদনও দেখানো হচ্ছে বেশি। যে তথ্যের সঙ্গে মিল নেই বাস্তবের।
জেলা মৎস্য দপ্তরের পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে ভোলা জেলায় ইলিশ আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল এক লাখ ৭৭ হাজার টন। ওই বছর উৎপাদন দেখানো হয় এক লাখ ৭৭ হাজার ৮০৪ টন। সেই হিসাবে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ৮০৪ টন বেশি ইলিশ উৎপাদন হয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩৬৫ টন বেশি ইলিশের উৎপাদন দেখানো হয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৮৬২ টন বেশি ইলিশের উৎপাদন হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ভোলায় ইলিশের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে এক লাখ ৮৫ হাজার টন, যা বিগত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
যদিও ইলিশ ধরা এবং ক্রয়-বিক্রয়ের সঙ্গে জড়িতরা বলছেন ভিন্ন কথা। তাদের দাবি, এমন পরিসংখ্যান মৎস্য বিভাগের মনগড়া তথ্য দিয়ে তৈরি। বাস্তবতার সঙ্গে এর কোনো মিল নেই। প্রকৃতপক্ষে গত কয়েক বছরের ব্যবধানে ইলিশের উৎপাদন গড়ে ২৫ শতাংশ কমেছে। যার জন্য নদীদূষণ ও ডুবোচরই দায়ী।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারিভাবে প্রতি বছর অক্টোবরের মাঝামাঝি সময় থেকে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহকে ধরা হয় ইলিশের প্রজনন মৌসুম। এ সময় মা ইলিশ প্রজননের জন্য গভীর সাগরের লোনা পানি থেকে উঠে এসে ভোলার মেঘনা-তেঁতুলিয়া নদীর মোহনা দিয়ে প্রবেশ করে পদ্মাসহ বিভিন্ন নদীতে গিয়ে ডিম ছাড়ে। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে মেঘনা-তেঁতুলিয়া নদীর তলদেশে মাত্রাতিরিক্ত পলিথিন জমে এবং জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবের ফলে নদীর তলদেশে পলি জমে অসংখ্য ডুবোচর সৃষ্টি হয়েছে। এসব ডুবোচরে বাধাগ্রস্ত হয়ে ফের সাগরে ফিরে যাচ্ছে ইলিশ। ফলে দিনদিন কমছে ইলিশের উৎপাদন। এভাবে চলতে থাকলে আগামীতে রুপালি এ সম্পদ হুমকির মুখে পড়বে।
সরেজমিনে ভোলার মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদীর তীরের কয়েকটি স্থান ঘুরে দেখা গেছে, ভাটার টানে নদীর পানি কমলেই মেঘনার বুকে স্পষ্ট দেখা যায় ছোট-বড় অসংখ্য চর। জোয়ারে ফের তলিয়ে যায়। এ সময় দেখে বোঝার উপায় থাকে না যে নদীতে কোনো চর আছে।
ভোলা সদর উপজেলার প্রবীণ জেলে দেলোয়ার মিয়া বলেন, ‘যেদিন প্রথম আব্বার লগে গাঙ্গে নামছি মাছ ধরতে, ওই দিনের পর থেকে আইজো (আজ) গাঙ্গ ছাড়তে পারি নাই। মাঝখান দিয়ে প্রায় ৩৫ বছর পার হইয়া গেছে। মাছ ধইরা আগে অনেক ভালো ছিলাম, জমি কিইন্না ঘরদুয়ারও করছি। গত চার-পাঁচ বছর ধইরা সেই সুখের দিন আর আসে নাই। গাঙ্গে এখন ইলিশ মাছ যা পাই তা বেচলে (বিক্রি) মাঝেমধ্যে তেল খরচও ওঠে না।’
দৌলতখান উপজেলার জেলে মো. জাহাঙ্গীর মাঝি বলেন, ‘নদীতে এমন কোনো স্থান পাওয়া কঠিন যেখানে ডুবোচর নেই। নদীতে জাল ফেলার পর ডুবোচরের বিষয়টি স্পষ্ট হয়। এত বড় নদী, কোথাও পাঁচ হাত সমান পানি, আবার কোথাও ১৫ হাত। নদীর তলদেশে পলিথিনের স্তর পড়ে আছে। মাঝেমধ্যে জালে মাছের চেয়ে পলিথিন বেশি ওঠে।’
চরফ্যাশন উপজেলার সামরাজ মৎস্যঘাট এলাকার মানিক মাঝি বলেন, ‘নদীর গভীরতা কমে গেছে। আমরা সাগরের মোহনার কাছাকাছি গিয়ে মাছ ধরি। মোহনার কাছাকাছি মেঘনায় কয়েকটা চর আছে। আমরা জানি, স্রোত যত বেশি হবে ইলিশ তত বেশি পাব। কিন্তু এখন নদীতে তেমন স্রোত দেখি না। তাই নদীতে ইলিশও কম পাই।’
‘আগে অভিযান শুরুর আগে জালে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ত। এখন আর তেমনটা হয় না। এখন যা পাই তা দিয়ে কোনো রকম খরচের টাকাটা উঠাই।’
হতাশা প্রকাশ করে জেলে নীরব মাঝি বলেন, ‘এ বছর নদীতে দৈনিক যে পরিমাণ মাছ পাচ্ছি, তা বিক্রি করে তেল খরচও ওঠে না।’
কেন ইলিশ মিলছে না— জানতে চাওয়া হয় ভোলা সরকারি কলেজের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. মাহাবুব আলমের কাছে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘নদীর নাব্যতা কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ হলো পলিগুলো সরাসরি সাগরে না গিয়ে নদীর তলদেশে জমা হয়। এভাবে জমতে জমতে স্তূপ হওয়ার কারণে ইলিশের গতিপথ বাধাগ্রস্ত হয়।’
‘এদিকে, জলবায়ুর প্রভাবে নদীতে পানির প্রবাহের গতি কমেছে। নদীতে পানির প্রবাহ বেশি থাকলে দূষণ কম হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন মিল-কারখানার বর্জ্য নদীতে সরাসরি পড়ছে। ওই বর্জ্য নদীর পানির সঙ্গে মিশে পানি দূষণ করছে। সেই পানি ইলিশের বসবাসের অনুপযোগী।’ করণীয় কী— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নদীদূষণ ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ করাই একমাত্র সমাধান।’
ইলিশ গবেষক এবং বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক ও মুখ্য কর্মকর্তা ড. মো. আনিছুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘নদীর নাব্যতা সংকট ও দূষণের ফলে মেঘনা-তেঁতুলিয়া নদীর মোহনায় ইলিশের প্রজনন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সাগর থেকে ইলিশ যখন নদীতে ডিম ছাড়তে আসে তখন ডুবোচরের বাধা পেয়ে আবার সাগরে ফিরে যায়। ফলে প্রায় ২৫ ভাগ মা ইলিশ নদীতে প্রজনন করতে ব্যর্থ হচ্ছে।’
ইলিশের উৎপাদন কমে যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘নদীতে অবৈধ জাল দিয়ে ইলিশের পোনা নিধনও অন্যতম একটি কারণ। নিধন রোধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ এবং নদীর নাব্যতা ফেরাতে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।’
‘ইলিশ সাগরে বসবাস করলেও খাওয়া-দাওয়া ও প্রজননের জন্য নদীতে আসে। কিন্তু দূষণের কারণে নদীতে ইলিশের বাস্তুতন্ত্র কমে গেছে। যার প্রভাব পড়ছে উৎপাদনে।’
ভোলা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ কুমার দেব ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বঙ্গোপসাগরের মোহনাসহ নদীতে নাব্যতা সংকট বা ডুবোচরের কারণে ইলিশের প্রজনন কিছুটা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। নদীর গভীরতা কমে গেছে, এটা সত্য। নাব্যতা সংকটের বিষয়টি ইতোমধ্যে মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে। নদীর কোন কোন পয়েন্টে নাব্যতা সংকট আছে, সেগুলো চিহ্নিত করতে মৎস্য উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে নির্দেশনা এসেছে। ইতোমধ্যে কয়েকটি পয়েন্ট চিহ্নিত করা হয়েছে।’
ভোলার জেলা প্রশাসক মো. আজাদ জাহান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘নদীর দূষণের জন্য আমরাই দায়ী। লঞ্চ ও স্টিমার থেকে নদীতে বিভিন্ন বর্জ্য ফেলা হয়। প্রশাসনকে বিষয়টি দেখভালের পাশাপাশি জনসচেতনতা গড়ে তুলতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া নদীর পাড়ে কেউ যাতে কোনো বর্জ্য না ফেলে, সেটিও কঠোরভাবে তদারকি করা হবে।’
ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে এবং রুপালি মাছটির নির্বিঘ্ন প্রজননের জন্য যদি নদী খননের প্রয়োজন হয়, তাহলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে আলোচনা করে সেই ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হবে— বলেন জেলা প্রশাসক।
এসকেডি/