লক্ষ্মীপুরে ভারী বর্ষণে জলাবদ্ধতা, জোয়ারে উপকূল প্লাবিত

লক্ষ্মীপুরে ভারী বর্ষণে জলাবদ্ধতা, জোয়ারে উপকূল প্লাবিত

টানা ভারী বর্ষণে লক্ষ্মীপুরের সর্বত্র বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বসতবাড়ি, মাঠ-রাস্তাঘাট, বীজতলা ও ফসলি ক্ষেত পানির নিচে তলিয়ে আছে। মেঘনা নদীর অস্বাভাবিক জোয়ারে উপকূলের বিস্তীর্ণ জনপদ প্লাবিত হচ্ছে। বৃষ্টি আর জোয়ারের পানিতে ডুবে থাকা এলাকাগুলোতে মাটির চুলায় রান্না বন্ধ হয়ে আছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেতে পারছে না শিক্ষার্থীরা, বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে জনজীবনে।

টানা ভারী বর্ষণে লক্ষ্মীপুরের সর্বত্র বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বসতবাড়ি, মাঠ-রাস্তাঘাট, বীজতলা ও ফসলি ক্ষেত পানির নিচে তলিয়ে আছে। মেঘনা নদীর অস্বাভাবিক জোয়ারে উপকূলের বিস্তীর্ণ জনপদ প্লাবিত হচ্ছে। বৃষ্টি আর জোয়ারের পানিতে ডুবে থাকা এলাকাগুলোতে মাটির চুলায় রান্না বন্ধ হয়ে আছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেতে পারছে না শিক্ষার্থীরা, বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে জনজীবনে।

মঙ্গলবার (২০ আগস্ট) বিকেলে লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজ রোড, সমসেরাবাদ, লামচরীসহ কমলনগর উপজেলার চরমার্টিন, চরলরেন্স ও চরকালকিনির নাসিরগঞ্জ এলাকায় গিয়ে পানিবন্দি বাসিন্দাদের দুর্দশার চিত্র দেখা যায়।

বুধবার বিকেলে খোঁজ নিয়েও একই খবর পাওয়া গেছে। এ ছাড়া এদিন সকাল থেকে পুরো জেলায় হালকা থেকে মাঝারি আকারের বৃষ্টি অব্যাহত রয়েছে। গত চার দিনে লক্ষ্মীপুরে ৩১২.৮ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে বলে জানিয়েছে রামগতি উপজেলায় দায়িত্বপ্রাপ্ত আবহাওয়া পর্যবেক্ষক সোহরাব হোসেন।

সরজমিনে কমলনগরের নাসিরগঞ্জ এলাকায় পানিবন্দি একটি বাড়িতে ঢুকে পাঁচটি ঘর দেখা যায়। উঠানে জোয়ারের পানি থই থই করছে। আর ঘরের ভেতরে অন্ধকার। এতে ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে গৃহবধূ ও দুই কিশোরীকে টুপি বুনতে দেখা যায়। পানিবন্দি অবস্থা নিয়ে জানতে চাইলে ক্যামেরার সামনে কথা না বললেও দুঃখ-কষ্টের কথা অনর্গল বলতে থাকেন তারা। এ ছাড়া রাস্তাঘাট ভেঙে চলাচলের অনুপোযোগী হয়ে পড়ছে। এর থেকে বাঁচতে দ্রুত সময়ের মধ্যে নদী তীর রক্ষায় বাঁধ নির্মাণ বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা। প্রচণ্ড বৃষ্টিতে জেলা শহরের বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে ভোগান্তিতে পড়েছে স্থানীয় বাসিন্দারা। লক্ষ্মীপুর কলেজিয়েট উচ্চ বিদ্যালয় ও লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজ মাঠ পানির নিচে ডুবে আছে। কলেজ মাঠে স্থানীয় বাসিন্দাদের মঙ্গলবার রাতে মাছ শিকার করতে দেখা গেছে। এ এলাকার মানুষের বাসা-বাড়িতেও পানি ঢুকেছে বলে জানা গেছে। মঙ্গলবার সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বৃষ্টি কমলেও বৃহস্পতিবার সকাল থেকে ফের বৃষ্টি অব্যাহত রয়েছে।

নাসিরগঞ্জ এলাকায় পানিবন্দি বশির উল্লাহ, নিজাম উদ্দিন হাওলাদার, ইয়াছমিন বেগম, মোস্তফা মিয়া, আমির জান, ফারুক হোসেন ও লোকমান হোসেনের সঙ্গে কথা হয়। পানিবন্দি হয়ে অনেকে রান্না করতে পারেননি। দুপুরে শুকনো খাবার খেতে হয়েছে অধিকাংশ পরিবারকে। আবার অনেককে দেখা গেছে অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিতে।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিদিন দুইবার নদীতে জোয়ার আসে। অস্বাভাবিক জোয়ারের পানি নদী থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূর পর্যন্ত লোকালয়ে প্রবেশ করে। নদীর কাছাকাছি এলাকার পানি ভাটায় নেমে যায়। কিন্তু  নদী থেকে দূরবর্তী এলাকার পানি নামে না। জোয়ার চলে গেলেও জলাবদ্ধতা সেসব এলাকার বাসিন্দাদের জন্য বিষফোড়া হয়ে রয়ে গেছে। বীজতলাসহ বিস্তীর্ণ ফসলি জমি পানির নিচে ডুবে রয়েছে। স্থানীয় খালগুলো প্রভাবশালীরা দখল করে স্থাপনা নির্মাণ করার কারণেই জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তারা। এবারের মতো এতো পরিমাণ বৃষ্টি এ অঞ্চলের মানুষ এর আগে কখনো দেখেনি বলেও জানান স্থানীয় লোকজন।

আমিরজান নামে একজন বলেন, বাড়িতে জোয়ারে কোমর পর্যন্ত পানি উঠেছে। রাতে ফের জোয়ার আসে। তখনও পানিতে ডুবে যায় বাড়িঘর। এতে বাড়ি থেকে দুই কিলোমিটার দূরে এক আত্মীয়ের বাড়িতে রাতে থাকার জন্য প্রতিদিন চলে যেতে হয়। 

বশির উল্যা নামে এক বৃদ্ধ বলেন, বিগত সরকার ৩১ শ কোটি টাকা ব্যয়ে নদী তীর রক্ষা বাঁধের বরাদ্দ দিয়েছে। কিন্তু প্রকল্পটি বাস্তবায়নে এমপি ও উপজেলা-ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের জোরালো কোনো পদক্ষেপ ছিল না। বেড়িবাঁধ না থাকার কারণেই লোকালয়ে জোয়ারের পানি ঢুকে প্লাবিত হয়।

ইয়াছমিন বেগম বলেন, গত কয়েকদিন ধরে প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে। এরমধ্যে জোয়ারের পানিতে বাড়িঘর সব ডুবে থাকে। এমন অবস্থায় ঘর থেকে বের হওয়া যায় না। রান্না-বান্না করতে সমস্যা হয়। ছেলে-মেয়ে স্কুল-মাদরাসায় যেতে পারে না।

পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী জিন্নাত ও তার ভাই তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র আরিফ হোসেন জানায়, তারা দুইজনই মাদরাসার শিক্ষার্থী। আরিফের পরীক্ষা চলে। বৃষ্টিতে ভিজে মাদরাসায় গিয়ে পরীক্ষা দিতে হয়েছে।

রিকশাচালক মনির হোসেন বলেন, পানির তোড়ে গ্রামীণ রাস্তাঘাট ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কিছু কিছু স্থানে জোয়ারের পানি ঢুকলেও নামার পথ নেই। পানি নিষ্কাশনের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক কালভার্ট নেই। জনপ্রতিনিধিরাও এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয় না। আমরা জোয়ারের পানির সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে আছি। তাই দ্রুত বেড়িবাঁধ নির্মাণ হলে জোয়ারের পানির কবল থেকে উপকূল রক্ষা পাবে। 

লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজ রোড এলাকার বাসিন্দা রিকশাচালক আবদুর রশিদ বলেন, টানা বৃষ্টিতে আমার বাড়ির ভেতর হাঁটু পরিমাণ পানি আছে। দুইদিন ধরে রিকশা বের করতে পারছি না। উপার্জনও নেই। পানিতে রিকশার মোটর নষ্ট হয়ে গেছে, এজন্য রিকশা বের করতে পারছি না।

রামগতি উপজেলার আলেকজান্ডার এলাকার বাসিন্দা নজরুল ইসলাম বলেন, জোয়ারের পানি উঠে উপকূল প্লাবিত হয়। এ ছাড়া প্রচণ্ড বৃষ্টিতে চরপোড়াগাছা, রামগতি, আলেকজান্ডারসহ বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। জোয়ার শেষে পানি নেমে যায়। কিন্তু খালগুলো বেদখলের কারণে জমে থাকা পানি নামছে না। এতে জলাবদ্ধতা তীব্র সমস্যা সৃষ্টি করেছে।

কমলনগরের স্কুলশিক্ষক সানা উল্লাহ সানু বলেন, লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালী জেলাকে বন্যা থেকে বাঁচাতে পারে ভুলুয়া নদী। এ নদীটির অধিকাংশ এলাকা প্রভাবশালীদের কাছে বেদখল হয়ে আছে। সেনাবাহিনী ও স্থানীয়দের সহযোগিতায় নদীটি দখলমুক্ত করলে এই দুই জেলার বাসিন্দারা উপকৃত হবে।

রামগতি ১ম শ্রেণির আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের আবহাওয়া পর্যবেক্ষক সোহরাব হোসেন বলেন, ১৭ থেকে ২০ আগস্ট পর্যন্ত লক্ষ্মীপুরে ৩১২.৮ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। নদীতে তিন নম্বর সতর্ক সংকেত ছিল। এখন তা সরিয়ে ফেলা হয়েছে। বৃহস্পতিবার (২২ আগস্ট) থেকে আবহাওয়ার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

লক্ষ্মীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নাহিদ-উজ জামান খান বলেন, নদী ভাঙন নিয়ে আপাতত কোনো অভিযোগ পাওয়া যাবে না—আশা করছি। জিও ব্যাগ ডাম্পিং প্রায় শেষ। ১০২টি প্যাকেজের ৯২টি প্যাকেজের কাজ চলমান রয়েছে। খুব শিগগিরই বাঁধ নির্মাণ ও ব্লক স্থাপন করা হবে। নভেম্বরের মধ্যে কাজ শেষ হবে। অস্বাভাবিক জোয়ারের কারণে উপকূলে পানি ঢুকে পড়ে। বাঁধ নির্মাণ কাজ শেষ হলেই এর সুফল পাবে উপকূলীয় বাসিন্দারা।

হাসান মাহমুদ শাকিল/এএমকে

Visit Source Page

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *