রাজনাথ সিংয়ের বক্তব্য ও আমাদের প্রস্তুতি

রাজনাথ সিংয়ের বক্তব্য ও আমাদের প্রস্তুতি

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সরকার মোহাম্মদ শামসুদ্দিন

ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের একটি বক্তব্য নিয়ে ক’দিন যাবৎ দেশের সবমহল সরব। সাবেক একজন সেনাপ্রধানসহ অনেক সামরিক ও বেসামরিক বিশেষজ্ঞ আমাদের সশস্ত্র বাহিনীকে পূর্ণ প্রস্তুত থাকার জন্য পরামর্শ দিয়েছেন। এই ব্যাপারে আমার দ্বিমত না থাকলেও, সেনাবাহিনীতে চাকরির সুবাদে এই নিয়ে কিছু লিখতে চাই।

ভারতের সার্বিক পরিস্থিতি সংক্ষেপে দেখলে—

১) বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপটে ভূ-রাজনৈতিকভাবে ভারত অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। ইউক্রেন-রাশিয়ার চলমান যুদ্ধের কারণে পশ্চিম ও রাশিয়ার সাথে সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষায় ভারতের পররাষ্ট্র নীতি ও বৈশ্বিক সম্পর্ক নাজুক অবস্থায় আছে।

তাছাড়া স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারকে অগণতান্ত্রিকভাবে টিকিয়ে রাখার জন্য তাদের ভূমিকা, শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর তাকে আশ্রয় প্রদান, বর্তমান সরকারের প্রতি ভারতের মনোভাব ইত্যাদি ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সাথেও সম্পর্কের দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে।

২) ইসরায়েলের সঙ্গে অতি ঘনিষ্ঠতা মুসলিম বিশ্বের সাথে সম্পর্ক রক্ষায় ভারতের চ্যালেঞ্জ ক্রমশই বাড়ছে, বিশেষ করে যখন গাজায় হাজার হাজার নিরীহ মানুষকে ইসরায়েল হত্যা করেছে।

৩) আঞ্চলিক রাজনীতি ও বৈশ্বিক অর্থনীতিতে চীনের ক্রম-বর্ধমান প্রভাব বৃদ্ধি, ভারতকে আঞ্চলিক ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষায় ক্রমশই আরও বেশি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করছে।

৪) ভারতের আরেক প্রতিবেশী মিয়ানমারের ওপর ক্রমবর্ধমান চীনের কর্তৃত্ব, মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, ভারতের সীমান্ত সংলগ্ন মিয়ানমারের কিছু স্টেটের ইন্সার্জেন্সি (insurgency) পরিস্থিতি দেশটির জন্য মোটেই সুখকর নয়।

৫) দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে ভারতের জন্য সর্বদা মাথা ব্যথা পাকিস্তান, যার ভূ-রাজনৈতিক ও ভূ-কৌশলগত কোনো পরিবর্তন হয়নি।

৬) দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য রাষ্ট্রগুলোর সাথে ভারতের সম্পর্ক আমাদের খুবই সুবিদিত। মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও ভুটান—কারা ভারতের বন্ধু বিষয়টি পরিষ্কার নয়।

৬) ভারতের বর্তমান রাজনৈতিক ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা পরিস্থিতি অন্য অনেক সময়ের চেয়ে অনেক বেশি নাজুক! মোদি সরকারের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকা, পশ্চিমবঙ্গে চলমান আন্দোলন, সেভেন সিস্টার্স-এর অনেকদিন ধরে চলমান ইনসার্জেন্সি, মণিপুরের বর্তমান অবস্থা ইত্যাদি ভারতের জাতীয় নিরাপত্তাকে অনেক বেশি নাজুক করে তুলেছে।

উপরে উল্লিখিত অতি সংক্ষিপ্তভাবে বর্ণিত ভারতের সার্বিক পরিস্থিতিতে প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর তাদের সশস্ত্র বাহিনীকে কয়েকটি দেশসহ বাংলাদেশের নাম উল্লেখ করে প্রস্তুত থাকতে বলা আমার কাছে অস্বাভাবিক মনে হয়নি। দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নাজুক হলে, ভারতের মতো দেশে বাহ্যিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি নাজুক হয়ে পড়তে পারে যেকোনো সময়।

তবে এটা নিশ্চিত যে, ভারত আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার অন্য কোনো ইস্যু নিয়ে মাথা ঘামালেও, এই পরিস্থিতিতে আমাদের জাতীয় প্রতিরক্ষার ওপর আগ্রাসন চালানোর সাহস কোনোভাবেই পাবে না।

রাজনাথ সিংয়ের বক্তব্যের পেছনে নিম্নবর্ণিত কারণ ও কৌশলগুলো থাকতে পারে—

১) বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার জাগরণ, গণ অভ্যুত্থান ও আগস্ট বিপ্লব ভারতের জন্যও ভিন্ন সংকেত হতে পারে। আমাদের আন্দোলনের প্রভাব পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের জনমনে প্রতিক্রিয়া করবে এটা খুবই স্বাভাবিক।

ইতিমধ্যেই পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে ছাত্র-জনতার অনেক জাগরণী গান জনপ্রিয়তা পেয়েছে এবং তাদের আন্দোলনেও একই ভাষা ও গান ব্যবহার হচ্ছে। বাংলাদেশের বিপ্লবের প্রভাব ভারতের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে—এমন ধারণা থেকে জাতীয় নিরাপত্তাকে সর্বদা সুসংহত রাখার জন্য প্রতিরক্ষা মন্ত্রী সশস্ত্র বাহিনীকে সর্বদা প্রস্তুত থাকার কথা বলতেই পারেন।

২) রাজনাথ সিংয়ের এই বক্তব্যের পেছনে নতুন বাংলাদেশ ও বর্তমান সরকারের জন্য প্রচ্ছন্ন হুমকিও থাকতে পারে।

৩) ভারত জানে যে, বন্দি বিনিময় চুক্তির আলোকে বাংলাদেশ একসময় শেখ হাসিনাকে বিচারের জন্য ফেরত চাইবে। শেখ হাসিনাকে এত সহজে ভারত ফেরত দেবে বলে মনে হয় না। রাজনাথ সিংয়ের এই ধরনের প্রচ্ছন্ন হুমকিতে বাংলাদেশকে যদি তাকে ফেরত চাওয়া থেকে নিরুৎসাহিত রাখা যায় সেই কৌশল থাকতে পারে।

৪) সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হতে পারে—যদি এই ধরনের হুমকিতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফেরত পাঠানো যায়। সেনাবাহিনী তথা সশস্ত্র বাহিনীকে যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য ব্যারাকে নিয়ে আসলে-বহুল আলোচিত প্রতি বিপ্লবের নীল নকশা বাস্তবায়নে খুবই সহজ হতে পারে।

৫) তাছাড়া এধরনের প্রচ্ছন্ন হুমকি যেকোনো দেশকে অস্থিতিশীল করতে বড় সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এত বড় বিপ্লব সংগঠিত হওয়ার পরে যেখানে অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অসংগঠিত এবং ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বন্যায় দেশের পূর্বাঞ্চল নিমজ্জিত; সংকটপূর্ণ অবস্থায় এই ধরনের হুমকি দিয়ে যদি নতুন সরকারকে তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী দেশকে এগিয়ে নিতে লক্ষ্যভ্রষ্ট করা যায়। এই সরকারকে ব্যর্থ করাও পতিত পলায়নকৃত সরকারের বড় লক্ষ্য।

ভারত বর্তমান পরিস্থিতিতে কখনোই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যুক্ত হবে না। বিশেষ করে, চলমান সরকার ভারতের স্বার্থ বিরোধী কী উদ্যোগ নেয়, ভারতের সাথে সম্পাদিত দেশ বিরোধী কোন চুক্তি বাতিল করে সবকিছু পরিস্থিতি বলে দেবে। রাজনাথ সিংয়ের প্রচ্ছন্ন বক্তব্যের পেছনে এই ধরনের ইঙ্গিত রয়েছে বলে ধারণা করাই যায়।

যাই হোক, আমাদের সশস্ত্র বাহিনী যেকোনো সময় যেকোনো পরিস্থিতিতে যুদ্ধের জন্যই প্রস্তুত থাকে। সবসময় প্রস্তুত থাকাই বাঞ্ছনীয়। তবে কোনো অবস্থায় যেন আমরা তাদের কৌশলের কাছে প্রতারিত না হই।

শুধু জাতীয় প্রতিরক্ষার দিকে ফোকাস দিয়ে দেশের জাতীয় নিরাপত্তার অন্যান্য দিকগুলো যেন রক্ষা করতে না ভুলি। আমাদের বিপ্লবের মূল লক্ষ্য থেকে আমাদের কোনো শক্তি যেন সরাতে না পারে। এজন্য সেনা ও সশস্ত্র বাহিনীকে সরকারের সহযোগিতার আওতায় প্রদত্ত সব কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত থেকে নিজেদের প্রস্তুত থাকতে হবে বলেই আমি মনে করি।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, সশস্ত্র বাহিনী ও জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য অনেক প্রচ্ছন্ন হুমকি আসবে এবং কৌশল ও রাজনীতির খেলা হবে। আমরা যেন কোনোভাবেই বিভ্রান্ত না হই।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সরকার মোহাম্মদ শামসুদ্দিন ।। অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা

Visit Source Page

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *