‘আমার লেদা (ছোট্ট) মাইয়াডার অনেক জ্বর, দম (শ্বাস) টাইন্না লইতে পারে না। সকাল ৮টা বাজে হাসপাতালে আনছি ভর্তি করাইতে। নিউমোনিয়া ধরা পড়ছে। ভর্তির পর ওরে ওয়ার্ডে পাডাইছে। এর আড়াই ঘণ্টা পরে ডাক্তারের দেখা পাইছি। এক ঘণ্টা পরে একজন নার্স আপা আইসা আমার হাতে ওষুধের নাম লেখা একটা কাগজ ধরাইয়া দিছে। কইছে ওষুধগুলো বাইর থেইক্কা কিন্না লইয়া আসেন, হাসপাতালে নাই। আমি অহন বাইরে যাইতাছি ওষুধ কিইইন্না আনতে।’
‘আমার লেদা (ছোট্ট) মাইয়াডার অনেক জ্বর, দম (শ্বাস) টাইন্না লইতে পারে না। সকাল ৮টা বাজে হাসপাতালে আনছি ভর্তি করাইতে। নিউমোনিয়া ধরা পড়ছে। ভর্তির পর ওরে ওয়ার্ডে পাডাইছে। এর আড়াই ঘণ্টা পরে ডাক্তারের দেখা পাইছি। এক ঘণ্টা পরে একজন নার্স আপা আইসা আমার হাতে ওষুধের নাম লেখা একটা কাগজ ধরাইয়া দিছে। কইছে ওষুধগুলো বাইর থেইক্কা কিন্না লইয়া আসেন, হাসপাতালে নাই। আমি অহন বাইরে যাইতাছি ওষুধ কিইইন্না আনতে।’
দুই বছরের মেয়ে মুনিয়াকে হাসপাতালে ভর্তি করানোর অভিজ্ঞতা এভাবেই ঢাকা পোস্টের কাছে তুলে ধরেন ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার বাসিন্দা দিনমজুর মো. মনির। তার মতো দ্বীপজেলা ভোলার প্রায় সাড়ে ১৯ লাখ মানুষের উন্নত চিকিৎসার শেষ ভরসাস্থল হচ্ছে জেলার ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতাল। কিন্তু সেখানে চিকিৎসার বেহাল দশার কারণে অনেক ভোগান্তিতে পড়েন জেলার বাসিন্দারা।
গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে ১০১ জন শিশু রোগী ভর্তি হয়েছে হাসপাতালে। গত এক মাসে ভর্তি হয়েছে ১৯৪০ জন। তার মধ্যে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে ২৪ জন।
হাসপাতালের ৫০ বেডের শিশু ওয়ার্ডে ধারণ ক্ষমতার ৫ গুণের বেশি শিশু নিউমোনিয়া ও ডায়রিয়ায়সহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত। প্রতিদিন সেখানে ২৫০ থেকে ২৭০ এর বেশি অসুস্থ শিশু চিকিৎসা নেয়। এর মধ্যে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ভর্তি আছেন প্রায় ১৮০ জন শিশু। এছাড়াও স্কানু ও ডায়রিয়া ওয়ার্ডে ভর্তি আছে আরও শতাধিক।
গত ২ দিন ভোলার ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতালটির ৫০ বেডের শিশু ওয়ার্ডে তিল ধরনের ঠাঁই নেই। একই চিত্র বারান্দার মেঝেতেও। প্রতিটি বেডে দুই থেকে তিনজন শিশুকে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। বাকি অসুস্থ শিশুদের বারান্দার মেঝেতে সারিবদ্ধ ভাবে শুইয়ে রেখে নামমাত্র চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
হাসপাতালে কোনো একজন শিশু হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হলেও দ্রুত পাওয়া যায় না চিকিৎসককে, নেই পর্যাপ্ত নার্সও। সময়মতো চিকিৎসক ও নার্স না পাওয়ায় শিশু মৃত্যুর অভিযোগও পাওয়া গেছে। প্রতিদিন নার্সদের সঙ্গে বাক-বিতণ্ডায় জড়াচ্ছেন শিশুদের স্বজনরা।
প্রতি ঘণ্টায় ঘণ্টায় হাসপাতালে আসছে নতুন রোগী। ভর্তির ঝামেলা এড়াতে অনেক অভিভাবক অসুস্থ শিশু নিয়ে ভিড় করছেন হাসপাতালের বহির্বিভাগে। সেখানেও থাকছে উপচে পড়া ভিড়।
আড়াইশোর বেশি অসুস্থ শিশুর চিকিৎসাসেবা দিয়ে নিয়োজিত আছেন মাত্র চারজন নার্স ও একজন সিনিয়র স্টাফ নার্স। শিডিউল অনুযায়ী একজন চিকিৎসক ২৪ ঘণ্টা শিশু ওয়ার্ডের চিকিৎসার দায়িত্বে থাকার কথা। কিন্তু সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ওয়ার্ডে রাউন্ডের পর জরুরি বিভাগ ব্যতীত আর কোনো চিকিৎসকের দেখা মেলে না।
সিরিঞ্জ, ক্যানোলো, স্কচটেপ, স্যালাইন ও অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ হাসপাতালের সরবরাহে নেই। হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডসহ অন্যান্য ওয়ার্ডেরও একই চিত্র। এভাবেই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে ভোলা সদর হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা।
জ্বর ওঠায় ১০ মাস বয়সী শিশু আলিফাকে ভোলার দৌলতখান উপজেলার মিয়ার হাট এলাকা থেকে সদর হাসপাতালে আনেন তার বাবা-মা। শিশুটির ঠাঁই হয়েছে শিশু ওয়ার্ডের বারান্দার মেঝেতে। আলিফার মা বলেন, মেয়েটাকে ভর্তি করে ওয়ার্ডে নেওয়া হলে আমাদের দিয়ে বাইরে থেকে ক্যানোলা, স্কচটেপ ও ইনজেকশন কিনিয়ে আনতে বলেন নার্সরা। পরে সেই ক্যানোলা আলিফার হাতে লাগায়। কতক্ষণ পরে বলে আবার ওষুধ কিনে আনতে বলে। পরে আবার ওই ওষুধও কিনে আনি। আমরা যদি সবকিছু বাইরে থেকেই আনতে হয় তাইলে সরকারি হাসপাতালের কাজ কি?
ভোলা সদর উপজেলার চরসামাইয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা মো. মাহফুজের মেয়ে মাহমুদার (৭) প্রচুর জ্বর ও কাশি। গত ২ দিন আগে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করার তিনি। সঙ্গে আছেন তার স্ত্রী ও ২ বছর বয়সী শিশু মুন্নি। এখন মুন্নিও জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে চিকিৎসা নিচ্ছে। তার বাবার দাবি, হাসপাতাল থেকেই মুন্নি ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে।
ডায়রিয়ায় আক্রান্ত আলীনগর ইউনিয়নের শিশু রাফিয়াদের মা জানান, বেলা ১১টা বাজে এখনও একজন নার্সও আসেনাই মাইয়াডার কাছে। নার্স আফারে বলেছি একটু দেইক্ষা যাইতে। এক ঘণ্টা হইয়া গেছে, তিনি এহনও আসেননি।
সদর উপজেলার দক্ষিণ দিঘলদী ইউনিয়নের ১১ মাস বয়সী শিশু নুসাইবাকে নিয়ে হাসপাতালের বারান্দার মেঝেতে বসে আছেন মা রুজিনা বেগম। তার মেয়ের শ্বাসকষ্ট। ডাক্তার দেখাবেন বলে অপেক্ষায় আছেন। ডাক্তারের দেখা না পেয়ে ও মেয়ের শারীরিক অবস্থা অপরিবর্তিত দেখে বাধ্য হয়েই তিনি হাসপাতালের ছাড়পত্র না নিয়েই ছোটেন প্রাইভেট হাসপাতালে।
ভোলা সদর হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডের সিনিয়র ষ্টার্ফ নার্স সালমা বেগম বলেন, আজ (মঙ্গলবার, ০৩ সেপ্টেম্বর) হাসপাতালে অসুস্থ শিশু আছে প্রায় ২৭০ জন। প্রতিদিনই নতুন নতুন শিশু রোগী ভর্তি হচ্ছেন। ওয়ার্ডে চারজন নার্স ডিউটি করছেন। রোগীর এত চাপ যে আমরা কোন শিশু রেখে কোন শিশুর কাছে যাবো বুঝতে পারছি না। পরিস্থিতি সামলাতে অন্য ওয়ার্ড থেকে আরও পাঁচজন নার্স ডেকে এনেছি। তারা এখন আমাদের সঙ্গে শিশু ওয়ার্ডে সেবা দিচ্ছেন।
রোগীর অভিভাবকদের দেওয়া বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের জনবল সংকট, কিছুই করার নেই। তারপরও আমাদের সাধ্য মতো চেষ্টা করে যাচ্ছি।
জনবল সংকটের মধ্যে বিপুল সংখ্যক শিশু রোগীকে সেবা দেওয়া প্রায় অসাধ্য বলে জানিয়েছেন ভোলা ২৫০ শয্যা হাসপাতালের সিনিয়র কনসালটেন্ট (শিশু) ডা. সালাউদ্দিন। তিনি জানান, সব মিলিয়ে ওয়ার্ডে প্রায় ৩০০ রোগী আছে। যতটা সম্ভব শিশুদের সেবা দিতে চেষ্টা করছি।
হাসপাতালে পর্যাপ্ত ডাক্তার নার্স ও ওষুধ না থাকায় সেবা ব্যাহত হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন ভোলার ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. সৈয়দ আবু আহমেদ শাফী। তিনি ঢাকা পোস্টকে জানান, বর্তমানে হাসপাতালে ডাক্তার ও নার্স সংকট আছে। এছাড়া অতিরিক্ত রোগীর চাপে ওষুধের সংকটও দেখা দিয়েছে। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। এ সংকটগুলো কাটানোর চেষ্টা করছি। আশা করছি দ্রুত এগুলোর সমাধান করা হবে।
হাসপাতালে বেড আছে ২৫০টি। নিউমোনিয়া ডায়রিয়াসহ নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডেই ভর্তি আছে প্রায় ২৭০ জন। আবহাওয়া পরিবর্তনজনিত সংক্রামিত ভাইরাসের কারণে এমনটা হচ্ছে। তাই শিশুদের অভিভাবকদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
এফআরএস