কান্না থামছে না নিহত রমজানের মায়ের

কান্না থামছে না নিহত রমজানের মায়ের

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে রাজধানী ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন নেত্রকোণার ১২ জন। তাদের সবার মরদেহ গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হয়েছে। নিহতদের বাড়িতে এখনো রয়ে গেছে আপনজন হারানোর শোক। চলছে স্বজনদের আহাজারি। 

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে রাজধানী ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন নেত্রকোণার ১২ জন। তাদের সবার মরদেহ গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হয়েছে। নিহতদের বাড়িতে এখনো রয়ে গেছে আপনজন হারানোর শোক। চলছে স্বজনদের আহাজারি। 

নেত্রকোণা সদর উপজেলার মদনপুর ইউনিয়নের নন্দীপুর গ্রামের লিটন মিয়া ও মনোয়ারা বেগম দম্পতির তিন সন্তানের মধ্যে রমজান মিয়া বড়। জীবিকার তাগিদে তিনি ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন। ১৯ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় তিনি গুলিতে নিহত হন বলে জানিয়েছে তার পরিবার। একমাত্র কর্মক্ষম রমজানকে হারিয়ে পরিবারের সদস্যরা অসহায় হয়ে পড়েছেন। 

নিহত রমজানের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, নীরব নিস্তব্ধ তার বাড়ি। সাংবাদিক এসেছে শুনেই ঘর থেকে বের হয়ে হাউমাউ করে কান্না শুরু করেন তার মা মনোয়ারা বেগম। স্ত্রীর কান্না দেখে নিজের চোখের জল লুকিয়ে রাখতে পারেননি রমজানের বাবা লিটন মিয়াও। 

রমজান কীভাবে মারা গেল জানতে চাইলে লিটন মিয়া বলেন,শুনেছি আমার ছেলের গায়ে সাড়ে ৯টার দিকে গুলি লেগেছে। মালিবাগের ওমর আলী লেন এলাকায় এ ঘটনা ঘটেছে। কিছুক্ষণ পর রমজানের খালু ফোন দিলে আমি জানতে চাই কোথায় গুলি লেগেছে? তখন সে বলে আমি জানি না, হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি। আবার আধা ঘণ্টা পর ফোন দিয়ে জানায় আপনার ছেলে মারা গেছে। কোথায় গুলি লেগেছে জিজ্ঞেস করার পর জানায় গলায় গুলি লেগেছে। আমি এবং আমার স্ত্রী যাওয়ার জন্য রওনা দিয়েছিলাম, এই সংবাদ শোনার পর আমরা দুজনই জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। ছেলের লাশটা আনতে গিয়ে খুব কষ্ট হয়েছে আমাদের। লাশ আনতে গিয়ে অনেক দৌড়াদৌড়ি করার পর ৩৫ হাজার টাকা খরচ করে ছেলের মরদেহ আনতে পেরেছি। রাত ১২টার দিকে তার জানাজা হয়।

ছেলে আন্দোলনে গিয়েছিল কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, সম্ভবত সে আন্দোলনে গিয়েছে। না গেলে তো এমন হওয়ার কথা না। বাসা থেকে বের হয়ে মালিবাগ এলাকায় ‘বেটার লাইফ হসপিটাল’ এর সামনে সে গুলি খেয়েছে। রমজান তার ছোট ভাই শাহিনকে বারণ করেছিল যেন আন্দোলনে না যায়। ছোট ভাইকে না করে সে নিজেই আন্দোলনে গিয়েছিল হয়তো।

রমজানের বাবা আক্ষেপ বলেন, আমার ছেলে আকিজ কোম্পানিতে সেলস বিভাগে চাকরি করতো। ভালো একটা অবস্থানে ছিল সে। প্রতি মাসে আমাদের ৩০ হাজার টাকা খরচের জন্য দিত। সে টাকা দিয়ে সংসারের খরচ, তার ছোট দুই ভাই-বোনের পড়াশোনার খরচ সবকিছু চলতো এই টাকা দিয়ে। এখন রমজান নিজেই নাই, টাকা কোথা থেকে আসবে। আর এই সংসার এখন কীভাবে চলবে। এগুলো চিন্তা করলে মাথা আর কাজ করে না।

সর্বশেষ ১৮ জুলাই (বৃহস্পতিবার) সকাল ৮টার দিকে ছেলে রমজানের সঙ্গে কথা বলেছিলেন মনোয়ারা বেগম। তখন রমজান তার মাকে বলেছিলেন, সোমবার টাকা পাঠাবো। টাকা পাঠানো হলে আমাদের যে ঋণের টাকা দেওয়া লাগবে সেটা দিয়ে দিবা। বাকি টাকা দিয়ে সংসারের খরচ করবা। আর এখান থেকে এক হাজার টাকার ওষুধ আনবা তোমার নিজের জন্য। ওইদিন বিকেল ৫টায় তার ছোট ভাই শাহীনকে ফোন দিয়ে রমজান বলেছিলেন, কোনো মিটিং-মিছিলে যেন সে না যায় এবং এটাও বলেন যে, আমরা গরিবের সন্তান আমরা কেন রাস্তায় পড়ে মারা যাব? 

মনোয়ারা বেগম বলেন, আমার ছেলেটা বৃহস্পতিবার বিকেলে তার ছোট ভাইকে সাবধান করলো, আর শুক্রবার সকালে আমার ছেলে রাস্তায় পড়ে মারা গেল।

সন্তান হত্যার বিচার চান কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি কার কাছে বিচার চাইব? আর কার বিরুদ্ধে মামলা করব? আমার ছেলে পুলিশের গুলিতে মারা গেছে নাকি অন্য কারো গুলিতে মারা গেছে আমি এটাও তো জানি না। তাহলে আমি কার বিরুদ্ধে মামলা করব? আমি চাই না কারো সাথে কোনো ধরনের মামলায় জড়াতে। সরকার যদি দয়া করে আমাকে একটু সহযোগিতা করে, আমার এই ছোট ছেলেটার একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দেয় তাহলে হয়তো একটু ডাল-ভাত খেয়ে বাঁচতে পারব।

রমজানের দাদি আছেন মানু বলেন, লাশটা আনার পর আমার ভাইয়ের মুখটা যখন হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখলাম, তখন খুব নরম লাগছে। আমি বারবার তার আঘাতের জায়গাটা দেখতে চাইলাম, কিন্তু কেউ আমাকে একবারের জন্য গুলিবিদ্ধ জায়গাটা দেখতে দেয় নাই। সবাই বলে তুমি এটা দেখলে মারা যাবে, এসব বলে আমাকে দেখতে দেয়নি। 

রমজানের কলেজ পড়ুয়া ছোট ভাই শাহীন বলেন, ভাইয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক খুব ভালো ছিল। বন্ধুর মতো সম্পর্ক ছিল। সে আমাকে খুব আদর করতো, ভাইকে সব সময় খুব বেশি মনে পড়ে। এটার জন্য আমার খুব খারাপ লাগে, কষ্ট লাগে। ভাই না থাকায় আমরা খুব কষ্টে সময় পার করতেছি। ভাই নাই এটা মানতেই পারি না। 

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ঢাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহতদের বিষয়ে জানতে চাইলে নেত্রকোণার সদ্য বিদায়ী পুলিশ সুপার মো. ফয়েজ আহমেদ জানান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ঢাকাতে এবং তার আশেপাশে যারা মারা গিয়েছেন তাদের পরিবারের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করেছি। আমাদের পক্ষ থেকে যা যা করণীয় সে বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এসব ঘটনার বিচার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।

চয়ন দেবনাথ মুন্না/আরএআর

Visit Source Page

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *