‘আমার অনাগত সন্তানের ভবিষ্যৎ কী?’

দাম্পত্য জীবনের এক বছর পূর্ণ হতে চলেছে। সব ঠিক থাকলে কিছুদিন পরেই পৃথিবীর আলো দেখার কথা তার সন্তানের। কিন্তু সেই সন্তানের মুখ দেখা হলো না জিন্নাতুল ইসলাম খোকনের (৩০)। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান। ওইদিন বিকেলেই পুলিশের গুলিতে নিহত হন খোকন। 

দাম্পত্য জীবনের এক বছর পূর্ণ হতে চলেছে। সব ঠিক থাকলে কিছুদিন পরেই পৃথিবীর আলো দেখার কথা তার সন্তানের। কিন্তু সেই সন্তানের মুখ দেখা হলো না জিন্নাতুল ইসলাম খোকনের (৩০)। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান। ওইদিন বিকেলেই পুলিশের গুলিতে নিহত হন খোকন। 

পরিবার নিয়ে গাজীপুরে থাকতেন খোকন। সেখানে পিকআপ ভ্যান চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে পরিবারের ভরণপোষণ করতেন নেত্রকোণার কেন্দুয়া উপজেলার দলপা ইউনিয়নের ভূইয়াপাড়া গ্রামের গোলাম মোস্তফার ছেলে খোকন।

এ ঘটনায় ১০ মাস আগে বিয়ে হওয়া খোকনের স্ত্রী রানী আক্তার শোকে কাতর। তিনি কেঁদে কেঁদে বলেন, আমরা কেউ আর এখন ঢাকায় থাকবো না। যার জন্য আমরা বাড়ি ছেড়ে গাজীপুর থাকতাম তিনিই আর নেই। আমার শাশুড়ি এবং আমার ভাশুরকে নিয়ে ঢাকায় গেছেন জিনিসপত্র আনার জন্য। আর আমার শ্বশুরবাড়ির লোকজন বলেছেন, আমি যদি এখানে থাকি তাহলে তারা আমার ভরণপোষণ করবেন। কিন্তু আমার অনাগত সন্তানের ভবিষ্যত কী? আমার গর্ভের ৯ মাসের সন্তান এতিম কেন?

আন্দোলন চলাকালে রাজধানী ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে নেত্রকোণার ১২ জন নিহত হয়েছেন। তাদের সবাইকে গ্রামের বাড়িতে এনে দাফন সম্পন্ন করা হয়েছে। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও নিহতদের বাড়িতে শোকের ছায়া এখনো কাটেনি। স্বজনদের আহাজারি ও চোখের পানিতে ভারী হয়ে উঠেছে পরিবেশ।

ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে খোকনের স্ত্রী রানী আক্তার বলেন, গত ৫ আগস্ট হাসিনার পতনের পর যখন আন্দোলনে গুলাগুলি হচ্ছিল, তখন আমার স্বামী বাসাতেই ছিলেন। আমরা তাকে বাইরে যেতে নিষেধ করেছিলাম। তখন সে বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে, আমি দূরে কোথাও যাব না, মোড়ের দোকান থেকে চা খেয়ে আসি। সাধারণত দোকানে গিয়ে সে বন্ধু-বান্ধব নিয়ে আড্ডা দিতেন। আমরা ভাবছিলাম, সে হয়তো অন্য কোথাও যাবে না, দোকানে চা খেয়ে চলে আসবেন। কিন্তু অনেক্ষণ যাওয়ার পরেও যখন বাসায় আসছিলেন না, তখন তাকে নিয়ে খুব চিন্তা হচ্ছিল।

তিনি বলেন, আমরা খুবই আতঙ্কিত ছিলাম। চতুর্দিকে গোলাগুলি হচ্ছে, এদিকে আবার শুনতে পাচ্ছি শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছে। সে বাসায় না আসায় আমরা খুব চিন্তিত ছিলাম। পরে সন্ধ্যা ৭টার দিকে জানতে পারি তার গুলি লেগেছে। উনি বিকেলেই মারা যান, কিন্তু আমাকে কেউ বিষয়টা জানাননি। আমাকে সবাই বলেছেন, হাতে গুলি লেগেছে। রাতের বেলা আমাকে জানানো হয়, নেত্রকোণা বাড়িতে নিয়ে গিয়ে তার চিকিৎসা হবে, ঢাকায় নাকি সব হাসপাতাল বন্ধ। এসব বলে তারা আমাকে বাড়িতে নিয়ে এসেছে। তারপর রাতে বাড়িতে আসলে আমি জানতে পারি তিন বিকেলেই মারা গেছেন।

খোকনের ফুফু রাবেয়া খাতুন বলেন, আমি শুনলাম আমার ভাইয়ের ছেলের গুলি লেগেছে। নতুন বাজার আমার এক ভাই ব্যবসা করতো সে ফোন দিয়ে জানায়। আমি শুনে কান্নাকাটি করতেছিলাম, তখন তারা বলল কান্নাকাটি করো না, কিছু হয় নাই, হাতে গুলি লাগছে। আমি এসব শোনার পর চিৎকার দিয়ে বেহুঁশ হয়ে যাই। তারপর জ্ঞান ফিরে দেখি সবাই কান্নাকাটি করতেছে। পরে রাতের বেলা মরদেহ নিয়ে আসে, মসজিদের সামনে সারারাত মরদেহ রাখা ছিল। সকালে গোসল করানোর পর আমাদের এখানে দাফন করা হয়েছে।

তিনি বলেন, এখন দুশ্চিন্তায় ঘুমাতে পারি না। এই মেয়েটার বিয়ে হয়েছে এক বছর হয় নাই, এর মধ্যেই সে বিধবা হলো। তার পেটে ৯ মাসের একটা বাচ্চা, সেও বাবার মুখ দেখার আগেই এতিম হয়ে গেছে।  চিন্তা করতে করতে আর কোনো কিছু ভালো লাগে না।

নিহত খোকনের বড় ভাই মো. দুলাল মিয়া বলেন, খোকন অনেক কষ্ট করে পরিবার নিয়ে চলতো। আর্থিক অনটনের কারণে সে গাজীপুরে থেকে ট্রাক চালিয়ে সংসার চালাতো। তার স্ত্রী ৯ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। মাত্র ১০ মাস হলো তাদের বিয়ে হয়েছে। এখন এই অবস্থায় এই মেয়েটার কী হবে? আর তার সন্তানের ভবিষ্যৎ কী? এটা আমরা চিন্তা করে পাই না। এর মধ্যে বেশ কয়েকজন দলীয় লোকজন এসে আমাদের সঙ্গে দেখা করে গেছেন, সান্ত্বনা দিয়ে গেছেন। কিন্তু সান্ত্বনায় কি আর আমার ভাই ফেরত আসবে? আমাদের এখন দাবি একটাই, আমার ভাইয়ের হত্যার সুষ্ঠু বিচার চাই।

নিহতদের জন্য আইনগত সহায়তার বিষয়ে জানতে চাইলে নেত্রকোনা জেলা পুলিশ সুপার মো. ফয়েজ আহমেদ বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ঢাকাতে এবং তার আশেপাশে যারা মারা গিয়েছেন তাদের মধ্যে ১২ জনের মৃতদেহ নেত্রকোণায় এসেছে। এর মধ্যে তিনজন ছাত্র এবং বাকিরা শ্রমজীবী। তাদের পরিবারের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করেছি। আমাদের পক্ষ থেকে যা যা করণীয় সে বিষয়ে আমরা যথাযথ ব্যবস্থা নিয়েছি এবং এর বিচার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।

চয়ন দেবনাথ মুন্না/এএমকে

Visit Source Page

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *