কোটা সংস্কার আন্দোলন যে সরকার উৎখাতের দিকে গড়াবে, সেটি কেউ ধারণা করতে পারেননি বলে জানিয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে ও সাবেক তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়।
কোটা সংস্কার আন্দোলন যে সরকার উৎখাতের দিকে গড়াবে, সেটি কেউ ধারণা করতে পারেননি বলে জানিয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে ও সাবেক তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়।
এছাড়া শেখ হাসিনা পদত্যাগের বিষয়ে দু-একদিন আগে থেকেই চিন্তাভাবনা করছিলেন কিন্তু দেশ ছাড়ার ব্যাপারে কোনও প্রস্তুতিই ছিল না। বিক্ষুব্ধ জনগণ গণভবনে পৌঁছাতে যতটা সময় লাগবে, দেশ ছাড়ার জন্য শেখ হাসিনার হাতে সেটুকু সময় ছিল বলে দাবি করেন জয়।
বিবিসির দক্ষিণ এশিয়া সম্পাদক ইথিরাজন আনবারাসনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সজীব ওয়াজেদ সেই সময়ের পরিস্থিতি ও সরকার পতন পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেন।
সজীব ওয়াজেদ বলেন, আমার মা কখনো বাংলাদেশ ছাড়তে চাননি। তাকে আমাদের রাজি করাতে হয়েছে। তিনি পদত্যাগ করার পরিকল্পনা করছিলেন, তিনি একটা ভাষণ দিতে চেয়েছিলেন এবং সংবিধান অনুযায়ী ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বিক্ষুব্ধ লোকজন গণভবনের দিকে মিছিল করার কথা ঘোষণা করলো, আমরা পরিবারের সদস্যরা তার কাছে অনুনয় করি যে, তারা সহিংসতার জন্য আসছে, তারা হত্যা করতে পারে, তোমাকে নিরাপত্তার জন্য চলে যেতে হবে।
জয় বলেন, আমার খালা (শেখ রেহানা) তার সঙ্গে ছিলেন। আমার মা চাইছিলেন খালা যেন হেলিকপ্টারে করে সামরিক বিমান ঘাটিতে চলে যান। কিন্তু আমরা মা উঠতে চাচ্ছিলেন না। তখন আমি তাকে এবং আমার খালাকে বলি, তাকে (শেখ হাসিনা) অবশ্যই যেতে হবে।
তিনি জানান, হেলিকপ্টারে করে ঢাকা ছাড়েন শেখ হাসিনা। সেখান থেকে ভারতের আগরতলা ও পরে দিল্লী পৌঁছান।
পুরো পরিস্থিতি পর্যালোচনায় শেখ হাসিনার সরকার ভুল করেছিল কিনা, এমন প্রশ্নে সজীব ওয়াজেদ বলেন, পরিস্থিতি এই দিকে গড়াবে তা তারা কেউ ভাবেননি। আমাদের কেউ ভাবেনি এই সহিংস আন্দোলন শেষ পর্যন্ত সরকার উৎখাতের দিকে গড়াবে। আমরা বুঝতে পারছিলাম, জুলাইয়ের ১৫ তারিখে যে সহিংসতার পেছনে কিছু অজানা গ্রুপ আছে, তারা মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মিছিল করার সময় আমরা রাজাকার বলে শ্লোগান দিয়েছিল। তখন আমাদের সমর্থকদের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হয়। পুলিশ কঠোরভাবে সেই সংঘর্ষ থামানোর চেষ্টা করে। আমার বিশ্বাস, সেদিন যারা ওই শ্লোগান দিয়েছিল, আমরা এখনো জানি না মধ্যরাতে সেই স্লোগান দেওয়া ব্যক্তিরা কারা ছিল, তারাই এই পরিস্থিতি তৈরি করার জন্য দায়ী।
আমাদের সরকার কখনো বিক্ষোভকারীদের ওপরে শক্তি প্রয়োগ করতে চায়নি, বরং পুলিশ তাদের পাহারা দিয়েছে, তাদের ওপর হামলার কোনও নির্দেশ ছিল না।
মাত্র একটি নির্বাহী আদেশ জারি করে যে সমস্যার সমাধান করা যেত, তা কেন এত প্রাণহানিতে গড়াল, বিবিসির এমন প্রশ্নের জবাবে জয় বলেন, এর আগে তো আমাদের সরকারই কোটা বাতিল করে দিয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের সদস্যদের আবেদনে পরে হাইকোর্ট সেটা বহাল করে। আমাদের সরকারের আইনি টিমও আদালতে শিক্ষার্থীদের দাবি পূরণের চেষ্টা করছিল। এটা এর মধ্যেই আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে ছিল। কিন্তু এর মধ্যেই সহিংসতা শুরু হয়। বলপ্রয়োগ ভুল হয়েছে, কিন্তু এটা উভয় পক্ষেই হয়েছে। শিক্ষার্থী মারা গেছে, বেসামরিক মানুষ মারা গেছে, পুলিশও মারা গেছে।
এখন আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব কে দেবে, জানতে চাইলে সজীব ওয়াজেদ বলেন, দল টিকে যাবে। ১৯৭৫ পরে যখন বেশিরভাগ শীর্ষ নেতা কারাগারে ছিল, তখনো দল টিকে গেছে। এটা হচ্ছে আদর্শের দল, দেশের একমাত্র গণতান্ত্রিক দল যা স্বাধীনতার পূর্বে গণতান্ত্রিকভাবে তৈরি হয়েছে।
বাকি দুটি দল সামরিক শাসকদের হাতে তৈরি। দল তাদের নেতা বের করে নেবে। কিন্তু এখন তারা আমাদের দল নির্মূল করার চেষ্টা করছে। নেতাকর্মীদের ওপর হামলা হচ্ছে, তারা আমাদের মন্ত্রীদের খুঁজছে, অনেকে লুকিয়ে আছে, অনেকে বিদেশে চলে গেছেন।
দেশে ফিরে সজীব ওয়াজেদের নেতৃত্ব দেওয়ার ইচ্ছা আছে কিনা, জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, সত্যি কথা বলতে, এরকম কোনও ইচ্ছা নেই। এটা আমার পরিবারের জন্য তৃতীয় ধাক্কা। যেমন মানুষ, তেমন নেতাই তাদের পাওয়া উচিত। এখন বাংলাদেশে মব রুল চলছে।
সামনে যে নির্বাচন হবে, হয়তো আওয়ামী লীগকে অংশ নিতে দেওয়া হবে না। হয়তো বিএনপি-জামাত নির্বাচনে বিজয়ী হবে। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ আসলে অন্ধকারাছন্ন।
অনেকে অভিযোগ করছেন, আওয়ামী লীগের সময়েও অনেক দমন পীড়ন হয়েছে, অনেককে গুম করা হয়েছে। এমনকি দুজনকে সম্প্রতি আট বছর গুম থাকার পর মুক্তিও দেওয়া হয়েছে।
এই অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, অবশ্যই কিছু ভুল হয়েছে। সরকারের মধ্যে অনেক ব্যক্তি ছিলেন যারা এসব ভুল করেছেন। কিন্তু আমরা সবসময়েই সেগুলো ঠিক করার চেষ্টা করেছি। আমাদের সরকারেই একজন মন্ত্রীর ছেলে, বিশেষ বাহিনীর সদস্য ছিলেন কিন্তু বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের জন্য কারাগারে গেছেন (নারায়ণগঞ্জের সাত খুন)।
বাংলাদেশে শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্যগুলো যেভাবে ভেঙে ফেলা হয়েছে, এ নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে সজীব ওয়াজেদ বলছেন, বাংলাদেশের মানুষের প্রতি অসন্তোষ এবং তারা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, এটাই আমার এখনকার অনুভূতি। আমি জানি, আওয়ামী লীগ সবচেয়ে বড় দল, এখনো আমাদের জনসমর্থন সবচেয়ে বেশি। ১৭ কোটি মানুষের দেশে ১০/২০ হাজার খুব ক্ষুদ্র অংশ। কিন্তু আমি যখন এসব (ভাঙচুরের) ছবি দেখি, আমি বাংলাদেশের মানুষের প্রতি গভীর অসন্তোষ অনুভব করি। এখন যা বাংলাদেশে ঘটছে, তা পাকিস্তানের মতো।
তিনি বলেন, একসময় বাংলাদেশের মানুষ পেছন ফিরে তাকিয়ে শেখ হাসিনার ১৫ বছর সময়কে স্বর্ণযুগ বলে মনে করবে। সেই দিন তারা আফসোস করবে, কিন্তু এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ ঠিক হয়ে গেছে।
আওয়ামী লীগ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অংশ হবে কিনা, জানতে চাওয়া হলে সজীব ওয়াজেদ বলেন, তারা আওয়ামী লীগকে কখনোই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অংশ হতে দেবে না।
আমি ও আমার পরিবার বিদেশে বড় হয়েছি, সেখানেই বাস করি। বাংলাদেশের ডিজিটাইলাইজেশনের জন্য আমি বিনা পয়সায় উপদেষ্টা হিসাবে কাজ করেছি। আমি সফল হয়েছি, বাংলাদেশের গ্রাম-গঞ্জে আমি ডিজিটাল কানেক্টিভটি নিয়ে গেছি। সেই বাংলাদেশের মানুষ আমার মায়ের সঙ্গে এরকম করেছে, আমার নানাকে অসম্মান করেছে, যিনি এই দেশের প্রতিষ্ঠাতা, এটা মেনে নেওয়া আমার জন্য অনেক কঠিন। বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে আমি আর কোনও সম্পর্ক রাখতে চাই না।
যখন ঢাকায় শেষবার শেখ হাসিনার সঙ্গে সংক্ষেপে সজীব ওয়াজেদের কয়েকবার কথা হয়, তখন অনেক হৈচৈ হচ্ছিল। তখন সংক্ষেপে শেখ হাসিনার সঙ্গে তার শেষ যে কথাটি হয়েছে, তা হলো, মা, তোমাকে এখনি দেশ ছাড়তে হবে।
তার বোনের সঙ্গেও মায়ের কথা হয় বলে তিনি জানান। তার বোন সায়মা ওয়াজেদ জাতিসংঘের একটি দপ্তরের কর্মকর্তা হিসাবে ভারতে থাকেন।
তখন দেশ ত্যাগের জন্য শেখ হাসিনাকে কতটা সময় দেওয়া হয়েছিল, জানতে চাওয়া হলে সজীব ওয়াজেদ বলেন, আসলে কোনও সময়ই দেওয়া হয়নি। কারণ বিক্ষুব্ধ লোকজন গণভবনের দিকে মিছিল করে আসছিল। সুতরাং তাদের সেখানে পৌঁছাতে কতটা সময় লাগবে, সেটুকু সময়ই তার হাতে ছিল। তবে তাকে নির্দিষ্ট কোন সময়সীমা বেধে দেওয়া হয়নি। কোন রকম প্রস্তুতি ছাড়াই বাংলাদেশ ছাড়তে হয়।
সূত্র- বিবিসি বাংলা
এমএসএ