অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে আন্দোলনে শহীদ রিয়াজুলের সন্তানদের ভবিষ্যৎ

অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে আন্দোলনে শহীদ রিয়াজুলের সন্তানদের ভবিষ্যৎ

অভাব-অনটনের সংসারে কিশোর বয়সেই সাইকেল মেকানিকের কাজ শিখেছিলেন রিয়াজুল তালুকদার (৩৬)। এ কাজ করে পরিবারের ভরণপোষণে কষ্ট হয় বলে ঢাকায় গিয়ে মালবাহী ভ্যান চালাতেন তিনি। কিন্তু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শেষ সময় মা হারা ফুটফুটে দুইটি সন্তান রেখে গুলিতে মারা যান রিয়াজুল। তার মেয়ে মেহজাবিন ও ছেলে মোস্তাকিমের জীবন এখন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। সঙ্গে বন্ধ হয়ে গেছে তার বৃদ্ধ মা শেহেরজান বিবির চিকিৎসা সেবাও।

অভাব-অনটনের সংসারে কিশোর বয়সেই সাইকেল মেকানিকের কাজ শিখেছিলেন রিয়াজুল তালুকদার (৩৬)। এ কাজ করে পরিবারের ভরণপোষণে কষ্ট হয় বলে ঢাকায় গিয়ে মালবাহী ভ্যান চালাতেন তিনি। কিন্তু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শেষ সময় মা হারা ফুটফুটে দুইটি সন্তান রেখে গুলিতে মারা যান রিয়াজুল। তার মেয়ে মেহজাবিন ও ছেলে মোস্তাকিমের জীবন এখন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। সঙ্গে বন্ধ হয়ে গেছে তার বৃদ্ধ মা শেহেরজান বিবির চিকিৎসা সেবাও।

সম্প্রতি শরীয়তপুর সদর উপজেলার চিকন্দী ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের আবুরা গ্রামে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত শ্রমিক মো. রিয়াজুল তালুকদারের বাড়িতে গিয়ে তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া যায়।

নিহত রিয়াজুল আবুরা গ্রামের মো. গিয়াস উদ্দিন তালুকদার ও শেহেরজান দম্পত্তির সন্তান।

তার পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, প্রাথমিক স্কুলের গণ্ডি পার হওয়ার পরই অভাব-অনটনের কারণে স্থানীয় বাজারে সাইকেল মেরামতের কাজ শিখতে হয় ভূমিহীন কৃষক পরিবারের সন্তান রিয়াজুলের। ধীরে ধীরে পরিবারের সদস্য সংখ্যা ও সংসারের খরচ বেড়ে যাওয়ায় মাত্র ১৫ বছর বয়সে রিয়াজুলকে তার পরিবারসহ জীবিকার তাগিয়ে ঢাকায় যান। এরপর কয়েক বছর আগে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে রিয়াজুল ঢাকার গুলিস্তান স্পোর্টস মার্কেটে ভ্যানগাড়ি দিয়ে মাল টানাটানির কাজ করতেন। ২০১৮ সালে পারিবারিকভাবে রিয়াজুলের সঙ্গে শিমু আক্তারের বিয়ে হল। তাদের ঘর আলো করে জন্ম নেয় মেহজাবিন (৫) ও মোস্তাকিম আহমেদ হীরা (৩) নামে দুই সন্তান।

পারিবারিক কলহের জেরে শিমুর সঙ্গে রিয়াজুলের বিবাহ বিচ্ছেদ হলেও মা-বাবাসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের নিয়ে বেশ ভালোই চলছিল রিয়াজুলের সংসার। অবুঝ বয়সে মা হারিয়ে মেহজাবিন ও রিয়াজুল প্রায় ছন্নছাড়া হয়ে গ্রামের বাড়িতে দাদা-দাদির সঙ্গে থাকত। গত ৪ আগস্ট গুলিস্তান থেকে চিটাগং রোডে মাল আনতে যাওয়ার পথে কোমরে গুলিবিদ্ধ হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান রিয়াজুল। মায়ের থেকে বিচ্ছেদ হওয়ার দুই মাস পরে বাবাকে হারিয়ে মেহজাবিন ও মোস্তাকিমের ভবিষ্যৎ জীবন এখন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

রিয়াজুল গুলিবিদ্ধ হওয়ার দিন সকালে ওষুধ কেনার জন্য মাকে ১ হাজার ৫০০ টাকা পাঠিয়েছিলেন। ওই টাকার ওষুধ শেষ হওয়ার পর এখন রিয়াজুলের মার ওষুধটাও বন্ধ হয়ে গেছে।

রিয়াজুল তালুকদারের ভাই রাসেল তালুকদার বলেন, ৪ আগস্ট সন্ধ্যার দিকে রিয়াজুলের ফোন থেকে একজন কল করে জানান যে তার গুলি লেগেছে, আপনারা দ্রুত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসুন। খবর পাওয়া মাত্র আমার আরেক ভাই নাহিদকে নিয়ে আমি ঢাকা মেডিকেলে গিয়ে শুনতে পাই রিয়াজুল মারা গেছে। ৪ তারিখ রাত ৭টা ৪০ মিনিটে আমার ভাই মারা যাওয়ার পর হাসপাতাল থেকে আমাদের জানানো হয়, থানা থেকে লিখিত আনতে হবে নইলে মরদেহ দেবে না। এরপর আমি শাহবাগ থানায় গেলে সেখান থেকে আমাকে পাঠানো হয় যাত্রাবাড়ি থানায়। কিন্তু যাত্রাবাড়ি থানা থেকে আমাকে শাহবাগ থানায় ফেরত পাঠানো হয়। এভাবে একটি কাগজের জন্য আমি দুই থানায় ৭ থেকে ৮ বার ঘুরাঘুরি করি। কিন্তু কোনো থানা থেকেই কাগজ পাইনি। 

এরপর ৫ তারিখ সরকার পতনের পরে হাসপাতালের মর্গের রুম ভাঙে ছাত্ররা। এরপর আমি আমার ভাইয়ের মরদেহ পুলিশের ছাড়পত্র ছাড়া শুধু হাসপাতালের ছাড়পত্র দিয়ে নিয়ে এসে গ্রামের বাড়িতে দাফন করেছি।

রিয়াজুলের মা শেহেরজান বলেন, আমার বাবার ঘরে ফুটফুটে দুই নাতি-নাতনি। রিয়াজুলের বউ দুই মাস আগে তাকে ডিভোর্স দিয়ে চলে গেছে। এখন আমার বাবাও গুলি খেয়ে চলে গেলো। আমার প্রতি মাসে অনেক টাকার ওষুধ লাগে। ওষুধের সব টাকা রিয়াজুল দিত। রিয়াজুল মারা যাওয়ার পরে আমার ওষুধ খাওয়া বন্ধ। এখন দিন দিন অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি। আমি এভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লে বাপ-মা হারানো আমার কলিজার নাতি-নাতনিদের দেখবে কে? রিয়াজুলের বাবা বয়স্ক মানুষ। জায়গাজমি নাই। বর্তমান যুগে পড়ালেখা না করলে কাজকর্মও পাওয়া যায় না। আমার নাতি-নাতনিদের কী হইব? যারা আন্দোলন করছে তাদের পরিবারের দ্বায়িত্ব যদি সরকার নিত তাহলে ভালো হত। আমার নাতি-নাতনিদের পড়াশোনার দায়িত্ব নিলেও আমি খুব খুশি হতাম।

রিয়াজুলের বাবা গিয়াস উদ্দিন তালুকদার বলেন, আমার জায়গাজমি নেই। অন্যের জমিতে কাজ করে সংসারের মানুষের মুখে খাবার দিতাম। রিয়াজুল বড় হওয়ার পর আমার সেই কষ্ট কিছুটা দূর হয়েছিল। আমার পাঁচ সন্তান হলেও সবাই শ্রমিক। নিজেরটা করতেই কষ্ট হয় তাদের। আমার এখন শেষ বয়স। নাতি-নাতনিদের ভরণ-পোষণ ও পড়ালেখার দায়িত্ব যদি সবাই মিলে নিতো তাহলে আমি চিন্তামুক্ত হতাম। দেশের জন্য জীবন দিয়েছে রিয়াজুল। রিয়াজুলের সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে তাদের পড়াশোনার দায়িত্ব দেশবাসীকে নেওয়ার জন্য আহ্বান জানাই।

সাইফ রুদাদ/এফআরএস

Visit Source Page

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *