সাবজেক্ট ম্যাপিংয়ে জিপিএ-৫ এর উল্লম্ফন, চার কারণে কমেছে পাসের হার

সাবজেক্ট ম্যাপিংয়ে জিপিএ-৫ এর উল্লম্ফন, চার কারণে কমেছে পাসের হার

>> যশোর ও ময়মনসিংহ বোর্ডের খারাপ ফলে কমেছে গড় পাসের হার

২০২৪ সালের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ভিন্ন রকম ফল প্রকাশ করল সরকার। ছাত্রজনতার আন্দোলনের কারণে এবার অর্ধেক বিষয়ে সরাসরি পরীক্ষা হয়েছে বাকিগুলো বাতিল করে সাবজেক্ট ম্যাপিংয়ের মাধ্যমে ফলাফল তৈরি করা হয়েছে। এতে ফলাফলে কিছুটা বৈচিত্র্য এসেছে।

যদিও করোনা মহামারি সময় অটোপাসের নজির ছিল। তবে এবার সাবজেক্ট ম্যাপিংয়ের কারণে সর্বোচ্চ ফল জিপিএ-৫ এ প্রাপ্তিতে উল্লম্ফন ঘটেছে। যদিও যশোর ও ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ডের খারাপ ফল, ইংরেজি ও আইসিটি বিষয়ের কঠিন পরীক্ষায় সার্বিক পাসের হার কমেছে।

মঙ্গলবার চলতি বছরের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় ফল প্রকাশ করা হয়েছে। এবার ১১ শিক্ষা বোর্ডে গড় পাসের হার ৭৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ। এ বছর পাসের হারসহ ফলাফলে বেশি পিছিয়ে পড়েছে ময়মনসিংহ ও যশোর শিক্ষা বোর্ড। চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডেও খারাপ ফলাফল হয়েছে। চার শিক্ষা বোর্ডে ফলাফল খারাপ হওয়ার মূল কারণ ইংরেজি ও তথ্যপ্রযুক্তি (আইসিটি) বিষয়ে ফেল।

চার বোর্ডের কারণে কমেছে পাসের হার

দেশের ১১টি শিক্ষা বোর্ডের এইচএসসি ও সমমানের প্রকাশিত ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এবার মূলত কয়েকটি কারণে গত বছরে তুলনায় পাসের হার কমেছে। এর মধ্যে চারটি শিক্ষা বোর্ডে পাসের হার কম, ইংরেজিতে অকৃতকার্যের হার বেশি, আইসিটি বিষয়ে খারাপ ফল, বন্যার কারণে সিলেট বোর্ডে কঠিন বিষয়ে অটোপাস এবং ফলাফলে সাবজেক্ট ম্যাপিং পদ্ধতি প্রয়োগ করায় এ পার্থক্য তৈরি হয়েছে। যে কারণে সার্বিক পাসের হার কমেছে, বিপরীতে অর্ধলক্ষাধিক শিক্ষার্থী জিপিএ ৫ পেয়েছে। শুধু তাই নয়, প্রকাশিত ফলাফলে বোর্ডওয়ারি গড় পাসের হারেও ঊর্ধ্বমুখী ও নিম্নমুখিতার ঘটনা ঘটেছে।

এ ব্যাপারে আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সভাপতি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার ঢাকা পোস্টকে বলেন, যে বিষয়গুলোর পরীক্ষা বাতিল করা হয়েছিল, সেগুলোর ফলাফল উচ্চমাধ্যমিকে গড় পাসের হারে বড় রকমের প্রভাব পড়ে না। উচ্চমাধ্যমিক পাসের হারটি মূলত নির্ভর করে ইংরেজি এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিষয়ের ওপর। কিন্তু এবার এই দুটি বিষয়ের পরীক্ষা হয়েছিল। ফলে গড় পাসের হারটি স্বাভাবিক সময়ের মতো হয়েছে।

সাবজেক্ট ম্যাপিংয়ের কারণে জিপিএ-৫ এ উল্লম্ফন

গত বছর এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় ৯২ হাজার ৫৯৫ জন জিপিএ ৫ পেয়েছিল। এ বছর জিপিএ ৫ পেয়েছে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৯১১ জন। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে জিপিএ-৫ বেড়েছে ৫৩ হাজার ৩১৬ জন।

ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বিষয় ম্যাপিংয়ের কারণে জিপিএ ৫ এর এতো উল্লম্ফন হয়েছে। এ বছর ৮টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের শিক্ষার্থীদের ৬ বিষয়ের পরীক্ষা বাতিল হয়েছে। সিলেট বোর্ডে হয়েছে মাত্র দুই বিষয়ের পরীক্ষা। অর্থাৎ তারা ১১ বিষয়েই পরীক্ষা দেয়নি। আর মাদ্রাসা ও কারিগরি বোর্ডের শিক্ষার্থীদেরও ৪ থেকে ৬ বিষয়ের পরীক্ষা দিতে হয়নি। বাতিল হওয়া পরীক্ষায় নম্বর দেওয়া হয়েছে এসএসসির বিষয় ম্যাপিং করে। এতে বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের পদার্থ, রসায়ন বা উচ্চতর গণিতের মতো বিষয়ের পরীক্ষা না হওয়ায় জিপিএ ৫ বেড়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ বছর যারা এইচএসসি ও সমমানে উত্তীর্ণ হয়েছে তারা ২০২২ সালের এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল। এই শিক্ষার্থীরা করোনাকালীন নবম-দশম শ্রেণিতে পড়ায় ওই বছর সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে প্রশ্নের একাধিক সুযোগ রেখে পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল। ফলে তাদের ফল ভালো ছিল। আর ওইসব বিষয়ে সাবজেক্ট ম্যাপিং হওয়ায় জিপিএ-৫ এর সংখ্যা বেড়েছে।

জিপিএ ৫ বেড়ে যাওয়ার পেছনে অন্যতম প্রভাবক হিসেবে সাবজেক্ট ম্যাপিং কাজ করেছে বলে মনে করেন আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সভাপতি তপন কুমার সরকার। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, এসএসসিতে বিজ্ঞান বিভাগে পড়ে যে শিক্ষার্থী জিপিএ ৫ পেয়েছিলেন, তিনি হয়ত উচ্চমাধ্যমিকে মানবিকে পড়েছেন। ফলে এসএসসির বিজ্ঞানের বিষয়গুলোর নম্বর এইচএসসিতে এসে মানবিকের বিষয়গুলোর বিপরীতে যোগ হয়েছে। এভাবে বিভাগ পরিবর্তনের কারণে জিপিএ ৫ বেড়েছে।

যশোর ও ময়মনসিংহে খারাপ ফল

ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এইচএসসিতে এবার পাসের হারে সবার নিচে রয়েছে ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ড। প্রায় একই রকম পাসের হার যশোর বোর্ডেও। কাছাকাছি অবস্থানে চট্টগ্রাম বোর্ডও। অন্য বোর্ডগুলোর তুলনায় এ তিনটি শিক্ষা বোর্ডে পাসের হার তুলনামূলক অনেক কম, যার প্রভাব পড়েছে সার্বিক গড় পাসের হারে। মূলত ইংরেজিতে বেশি ফেল করায় এ দুটি বোর্ডে ফল বিপর্যয় হয়েছে বলে জানিয়েছেন বোর্ড সংশ্লিষ্টরা।

বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ডে পাসের হার ৬৩ দশমিক ২২ শতাংশ। আর যশোর বোর্ডে ৬৪ দশমিক ২৯ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছেন। দুই বোর্ডে যথাক্রমে ৩৬ দশমিক ৭৮ এবং ৩৫ দশমিক ৭১ শতাংশ শিক্ষার্থীই ফেল করেছেন। তাছাড়া চট্টগ্রাম ও কুমিল্লায়ও তুলনামূলক ফল খারাপ। বোর্ড দুটিতে যথাক্রমে পাসের হার ৭০ দশমিক ৩২ শতাংশ ও ৭১ দশমিক ১৫ শতাংশ। এ খারাপ ফলের নেপথ্যে ইংরেজি, আইসিটি বিষয়।

সিলেট বোর্ডে রেকর্ড পাস, আর্শীবাদ হয়েছে বন্যা

ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এবার অটোপাসে সিলেট বোর্ডে চমকপ্রদ ফলাফল এসেছে। যার নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে বন্যা পরিস্থিতি। বন্যার কারণে এ বোর্ডে পরীক্ষা শুরু হয় দেরিতে। বাংলা ও ইংরেজি পরীক্ষা স্থগিত হয়ে যায়। ৯ জুলাই থেকে আইসিটি বিষয়ের মাধ্যমে সিলেট বোর্ডে পরীক্ষা শুরু হয়। পরে পরীক্ষা বাতিল হওয়ায় সিলেটের পরীক্ষার্থীদের বাংলা ও ইংরেজি বিষয়ে পরীক্ষায় বসতে হয়নি। বিগত এসএসসি পরীক্ষায় তারা বাংলা ও ইংরেজিতে যে নম্বর পেয়েছিল, সেটাই এইচএসসিতে ম্যাপিং করে ফলাফলে যুক্ত করা হয়েছে। এ দুটি বিষয়ে সিলেটে পাসের হার শতভাগ। অর্থাৎ এটি অন্যতম নিয়ামক। আর অনুষ্ঠিত বাকি ৪টি বিষয়ে তুলনামূলক ভালো ফল করায় বোর্ডটি এবার সবার শীর্ষে রয়েছে।

এ বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. জাকির আহমদ জানিয়েছেন, ইংরেজি ও বাংলা পরীক্ষা না হওয়ায় বেশ সুবিধা পেয়েছে সিলেটের শিক্ষার্থীরা। ইংরেজিতে অনেক সময় ছাত্র-ছাত্রীরা খারাপ করে। সেদিক দিয়ে ওই পরীক্ষাটা না হওয়ায় পাসের হার কিছুটা বেশি।

যেভাবে হয়েছে বিষয় ম্যাপিং

সংকটকালীন সময়ে সাধারণ বিষয় ম্যাপিং করা হয়। এর আগে করোনাকালে পরীক্ষা নিতে না পারায় কিংবা কম বিষয়ে পরীক্ষা নিতে গিয়ে সাবজেক্ট ম্যাপিং করে ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে। এ জন্য কোন পরীক্ষার কোন বিষয়ের নম্বর যুক্ত হবে, সে বিষয়ে একটি নীতিমালাও আছে। এবার যেসব বিষয়ের পরীক্ষা হয়নি, সেগুলোর ফলাফল প্রকাশ করা হয় এসএসসি বা সমমানের পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে বিষয় ম্যাপিং করে। এ প্রক্রিয়ায় একজন পরীক্ষার্থী এসএসসিতে একটি বিষয়ে যত নম্বর পেয়েছিলেন, এইচএসসিতে সেই বিষয় থাকলে তাতে এসএসসিতে প্রাপ্ত পুরো নম্বর বিবেচনায় নেওয়া হবে। আর এসএসসি, এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় বিষয়ে ভিন্নতা থাকলে বিষয় ম্যাপিংয়ের নীতিমালা অনুযায়ী নম্বর বিবেচনা করে ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে। যেমন এসএসসিতে যে পরীক্ষার্থী বিজ্ঞানে পড়েছিলেন, এইচএসসিতে হয়ত তিনি ব্যবসায় শিক্ষা বা মানবিক শাখায় পড়েছেন। সে ক্ষেত্রে এসএসসিতে বিজ্ঞানের বিষয়গুলোর প্রাপ্ত নম্বর পরীক্ষার্থীর এইচএসসির ব্যবসায় শিক্ষা বা মানবিকের নৈর্বাচনিক বিষয়ের নম্বর হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে।

এনএম/এসকেডি

Visit Source Page

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *