শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব? ভারতের সামনে অপশন কী?

শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব? ভারতের সামনে অপশন কী?

ছাত্র-জনতার ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। তার দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নিয়েছে।

ছাত্র-জনতার ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। তার দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নিয়েছে।

হত্যা ও গুমসহ নানা অভিযোগে বাংলাদেশে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দায়ের হচ্ছে একের পর এক মামলা। আর এতেই প্রশ্ন উঠেছে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে পালিয়ে যাওয়া সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে কী বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব?

আর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে শেখ হাসিনাকে ফেরত চাওয়া হলে ভারতের সামনে অপশনই বা কী থাকবে?

মঙ্গলবার (২০ আগস্ট) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস জানিয়েছে, বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার নিজ দেশে একাধিক ফৌজদারি মামলার মুখোমুখি হচ্ছেন। আর এ কারণে সম্ভবত প্রতিবেশী বাংলাদেশ হয়তো তাকে প্রত্যর্পণের জন্য ভারতকে চাপ দিতে পারে।

গত ১৫ আগস্ট বার্তাসংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন এ কথা বলেন। তিনি বলেন, শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর থেকে তার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মামলা দায়ের করা হয়েছে এবং দেশের স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয় যদি সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে তাকে ‘বাংলাদেশে ফিরে আসার’ প্রয়োজন হতে পারে।

ওই সাক্ষাৎকারে তিনি আরও বলেছিলেন, এ ধরনের পরিস্থিতি কূটনৈতিকভাবে ভারতকে বিব্রত করতে পারে এবং তিনি নিশ্চিত যে– ভারত এই বিষয়টি খেয়াল রাখবে’।

হ্যাঁ। ভারত এবং বাংলাদেশ ২০১৩ সালে একটি প্রত্যর্পণ চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। পরে ২০১৬ সালে চুক্তিটিতে সংশোধন করা হয় যাতে দুই দেশের মধ্যে পলাতক বন্দি ও আসামিদের বিনিময় আরও সহজ এবং দ্রুত হয়।

এই চুক্তিটি বেশ কিছু ভারতীয় পলাতক আসামি, বিশেষ করে উত্তর-পূর্ব ভারতের বিদ্রোহী গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত আসামিদের বাংলাদেশে লুকিয়ে থাকা এবং (ভারতের) বাইরে কাজ করার প্রেক্ষাপটে তৈরি হয়েছিল।

একই সময়ে, বাংলাদেশ জামাত-উল-মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি) এর মতো সংগঠনগুলোর থেকেও সমস্যায় পড়েছিল, এই গোষ্ঠীটির সদস্যদের ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং আসামের মতো রাজ্যে লুকিয়ে থাকতে দেখা গেছে।

বন্দি বিনিময় এই চুক্তিটির কারণে ২০১৫ সালে ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসাম (উলফা)-এর শীর্ষ নেতা অনুপ চেটিয়াকে সফলভাবে বাংলাদেশ থেকে ভারতে ফিরিয়ে নেওয়ার সুযোগ পেয়েছিল নয়াদিল্লি। তারপর থেকে এই চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ আরও একজন পলাতক আসামিকে ভারতের কাছে হস্তান্তর করেছে। বেশ কয়েকটি সূত্র বলছে, ভারতও এই চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের পলাতক কয়েকজনকে বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করেছে।

চুক্তি অনুযায়ী, ভারত ও বাংলাদেশের এমন ব্যক্তিদের একে-অপরের কাছে প্রত্যর্পণ করার কথা ‘যাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে… বা যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে বা দোষী সাব্যস্ত হয়েছে, অথবা অনুরোধ করা দেশের একটি আদালতের মাধ্যমে প্রত্যর্পণযোগ্য অপরাধ করার জন্য তারা ওই আসামিকে ফিরিয়ে নিতে চাইছে’।

চুক্তিতে বলা হয়েছে, প্রত্যর্পণযোগ্য অপরাধ এমন একটি অপরাধ হতে হবে যা সর্বনিম্ন এক বছরের কারাদণ্ড বহন করে। এর মধ্যে আর্থিক অপরাধও রয়েছে। এখানে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, প্রত্যর্পণযোগ্য অপরাধ হওয়ার জন্য দ্বৈত অপরাধের নীতি অবশ্যই প্রযোজ্য হতে হবে, যার অর্থ অপরাধটি অবশ্যই উভয় দেশে শাস্তিযোগ্য হতে হবে।

চুক্তিতে আরও বলা হয়েছে, যদি ‘প্রত্যর্পণযোগ্য অপরাধের কমিশনে সহযোগী হিসেবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বা সহায়তা, প্ররোচনা বা অংশগ্রহণ’ করার চেষ্টা করা হয় তবে প্রত্যর্পণও মঞ্জুর করা হবে।

হ্যাঁ। চুক্তিতে বলা হয়েছে, অপরাধটি ‘রাজনৈতিক প্রকৃতির’ হলে প্রত্যর্পণ প্রত্যাখ্যান করা যেতে পারে। তবে এটি অপরাধের প্রকৃতি দ্বারা সীমাবদ্ধ। এবং অপরাধের তালিকা যেগুলোকে ‘রাজনৈতিক’ হিসাবে গণ্য করা যায় না তা বরং দীর্ঘ।

এর মধ্যে রয়েছে হত্যা; নরহত্যা বা অপরাধমূলক হত্যা; আক্রমণ; বিস্ফোরণ ঘটানো; জীবন বিপন্ন করার উদ্দেশ্যে কোনও ব্যক্তির মাধ্যমে বিস্ফোরক পদার্থ বা অস্ত্র তৈরি; গ্রেপ্তার ঠেকাতে বা প্রতিরোধ করার উদ্দেশ্যে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার; জীবন বিপন্ন করার অভিপ্রায়সহ সম্পত্তির ক্ষতি করা; অপহরণ বা জিম্মি করা; হত্যার প্ররোচনা; এবং সন্ত্রাস সম্পর্কিত অন্য কোনও অপরাধ।

শেখ হাসিনা একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং তিনি ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয়ের দাবি করতে পারেন। যে অপরাধের জন্য তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে তার কয়েকটি উভয় দেশের চুক্তিতে রাজনৈতিক অপরাধের সংজ্ঞা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে হত্যা, জোরপূর্বক গুম এবং নির্যাতনের মামলাও রয়েছে।

গত ১৩ আগস্ট হাসিনার বিরুদ্ধে একজন মুদি দোকানের মালিককে হত্যার অভিযোগে মামলা করা হয়েছে, যিনি গত মাসে পুলিশের গুলিতে মারা গিয়েছিলেন। পরের দিন ২০১৫ সালে একজন আইনজীবীকে অপহরণের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে জোরপূর্বক গুমের একটি মামলা দায়ের করা হয়। এরপর হত্যা, নির্যাতন এবং গণহত্যার অভিযোগে গত ১৫ আগস্ট হাসিনার বিরুদ্ধে তৃতীয় মামলা দায়ের করা হয়।

এছাড়া ভারতের জন্য বিষয়গুলো আরও জটিল হয়েছে চুক্তির একটি সংশোধনের কারণে। চুক্তির ১০(৩) অনুচ্ছেদে ২০১৬ সালে আনা সংশোধনীর জেরে কোনও আসামিকে প্রত্যর্পণের অনুরোধকারী দেশের জন্য সংঘটিত অপরাধের প্রমাণ সরবরাহ করার প্রয়োজনীয়তা এখন আর নেই। এখন প্রত্যর্পণের প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়ার জন্য অনুরোধকারী দেশের একটি উপযুক্ত আদালতের দ্বারা শুধুমাত্র একটি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা প্রয়োজন।

সম্ভবত, বাধ্য হয়ে পাঠাতে হবে। বন্দি বিনিময় চুক্তিতে কোনও আসামির প্রত্যর্পণের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করার সুযোগ রয়েছে। চুক্তির ৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রত্যর্পণের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করা যেতে পারে যদি প্রত্যর্পণ চাওয়া সেই ব্যক্তিকে দেশের আদালতে প্রত্যর্পণ অপরাধের বিচার করা যেতে পারে’। তবে হাসিনার ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য নয়।

তাতে বলা হয়েছে, চুক্তির ৮ অনুচ্ছেদে প্রত্যর্পণের অনুরোধ প্রত্যাখ্যানের একাধিক কারণের তালিকা রয়েছে যার মধ্যে এমন বিষয়টিও রয়েছে যেখানে ‘ন্যায়বিচারের স্বার্থে সরল বিশ্বাসে অভিযোগ করা হয়নি’ বা সামরিক অপরাধের ক্ষেত্রে যা ‘সাধারণ ফৌজদারি আইনের অধীনে অপরাধ’ নয় বলে মামলা রয়েছে।

ভারতের কাছে হাসিনার প্রত্যর্পণ প্রত্যাখ্যান করার অপশন রয়েছে। এক্ষেত্রে নয়াদিল্লি কারণ দেখাতে পারে, হাসিনার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো ‘ন্যায়বিচারের স্বার্থে সরল বিশ্বাসে’ করা হয়নি। তবে ভারতের এই পদক্ষেপ বাংলাদেশের নতুন সরকারের সাথে নয়াদিল্লির সম্পর্কে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।

ঢাকায় যারাই ক্ষমতায় আসুক ভারতকে তাদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে এবং বাংলাদেশে নয়াদিল্লির দীর্ঘমেয়াদী কৌশলগত ও অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করতে হবে। একইসঙ্গে নয়াদিল্লির দীর্ঘদিনের বন্ধু ও মিত্র শেখ হাসিনার ‘পাশে দাঁড়ানোর’ বিষয়টিও দেখতে হবে।

ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং (র)-এর একজন সাবেক কর্মকর্তা – যিনি বাংলাদেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন – ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেছেন, ‘শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশের হাতে তুলে দেওয়ার মধ্যেই কি আমাদের গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ নিহিত? সেটি নয়। চুক্তির বৈধতা কোনও ব্যাপার না। উভয় পক্ষের সমর্থনকারীরা রয়েছে।’

ভারতের সাবেক এই গুপ্তচর যুক্তি দিয়ে বলেন, এই বিষয়টি ‘ভারসাম্যমূলক কাজের’ নিশ্চয়তাও দেয় না।

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে, যারা ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে চায়। আওয়ামী লীগ শেষ হয়নি। বাংলাদেশের প্রশাসন এবং সামরিক বাহিনী রয়েছে ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ককে গুরুত্ব দেয়। সুতরাং আমাদের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান সুসম্পর্কের পক্ষে… তারপর ভৌগলিক বাস্তবতা রয়েছে। বাংলাদেশ ভারত-দ্বারা বেষ্টিত। দুই দেশের মধ্যে যথেষ্ট কাঠামোগত সংযোগ রয়েছে। এই সম্পর্কের দিকনির্দেশনা নিয়ে শেষ কথাটি এখনও লেখা হয়নি।’

নিরাপত্তা সংস্থার অন্যান্য যে সূত্রের সঙ্গে দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস কথা বলেছে সেগুলোও উল্লেখ করেছে, কোনও দেশ চুক্তিসহ বা চুক্তি ছাড়া তার জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে পলাতক ব্যক্তিত্বদের নিয়ে কাজ করে না এবং অবশেষে, যা ঘটবে তা হবে একটি রাজনৈতিক আহ্বান।

এছাড়া এই অঞ্চলে কাজ করেছেন এমন একজন সাবেক কূটনীতিক বলেছেন, এখনও আতঙ্কিত হওয়ার মতো কিছু হয়নি।

সাবেক ওই কূটনীতিক ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেন, ‘প্রথমত, এটি একটি অন্তর্বর্তী সরকার। এই সরকারের বক্তব্যে ভারতকে খুব একটা বিরক্ত হওয়া উচিত নয়। নিয়মিত সরকার দায়িত্ব নিলেই তাদের সাথে ভারত দীর্ঘমেয়াদে যুক্ত হতে চাইবে এবং এইভাবে মনোযোগ দিয়ে সামনে এগোবে। এছাড়া, এখন পর্যন্ত (হাসিনার বিরুদ্ধে) শুধুমাত্র এফআইআর দায়ের করা হয়েছে। এসব মামলার তদন্ত করতে হবে, চার্জশিট দাখিল করতে হবে এবং তারপর আদালত আমলে নেবে। আর তারপরই প্রত্যর্পণ প্রক্রিয়া শুরু হবে। ততক্ষণে তিস্তা দিয়ে অনেক পানি বয়ে যেতে পারে।’

তিনি আরও বলেন, ‘কূটনীতির বাইরে একটি চুক্তির অর্থ হচ্ছে– এর আইনি বিধানগুলোর বিষয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হবে। তারপরও প্রত্যর্পণের অনুরোধ ঝুলিয়ে রাখা সত্ত্বেও দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক ভালো থাকার একাধিক উদাহরণও রয়েছে।’

টিএম

Visit Source Page

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *