বাগেরহাটে ৬ দিনে আহত ৫ শতাধিক, নৈরাজ্যে জনমনে আতঙ্ক

বাগেরহাটে ৬ দিনে আহত ৫ শতাধিক, নৈরাজ্যে জনমনে আতঙ্ক

গণঅভুত্থ্যানে সরকার পতন ও শেখ হাসিনার দেশ ত্যাগের পর থেকে বাগেরহাটে ভাঙচুর, মারধর, অগ্নিসংযোগ ও ঘের লুট অব্যাহত রয়েছে। লুটপাট-ভাংচুর থেকে বাদ যাচ্ছে না ধনী-গরিব কেউই। গোয়ালের গরু থেকে হাস-মুরগি, খাবার প্লেট থেকে চায়ের কাপ, মৎস্য ঘের কোনোকিছুই রক্ষা পাচ্ছে না লুটপাটকারীদের হাত থেকে। 

হামলা হয়েছে প্রেসক্লাব ও সাংবাদিকদের ওপরও। হামলায় ৫ সংবাদকর্মীসহ ৫ শতাধিক লোক আহত হয়েছেন। এদের মধ্যে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত না এমন ব্যক্তিও রয়েছেন। বিএনপি ও জামায়াত নেতাদের কড়া হুঁশিয়ারির পরও জেলা জুড়ে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট থামানো যাচ্ছে না। কর্মবিরতির কারণে পুলিশ নিয়মিত দায়িত্ব পালন না করায় এই নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি থামছে না বলে দাবি ভুক্তভোগীদের।

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, বাগেরহাট শহরের রেলরোডে জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়সহ জেলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের অন্তত ১০০টির বেশি অফিস ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। ভাঙচুর করা হয়েছে কচুয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাইফুল ইসলাম খোকনসহ অসংখ্য নেতাকর্মীদের বাড়ি। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাঙচুর ও দখলের ঘটনা ঘটেছে। এমনকি বিএনপির নেতাদের বাড়িতেও হামলা হয়েছে। বাগেরহাট শহরের পিটিআই মোড় এলাকায় সাবেক পুলিশ সুপার মো. আলী হোসেন ফকিরের বাড়িতে দুই দফায় হামলা করা হয়েছে। বিএনপি সংশ্লিষ্টতার কারণে ২০২২ সালের ১৬ নভেম্বর বিসিএস পুলিশ ক্যাডারের এই কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে দেয় সরকার।

বাগেরহাট ২৫০ শয্যা জেলা হাসপাতালসহ উপজেলার বিভিন্ন হাসপাতালে গেল ৬ দিনে মারধরের শিকার ৪ শতাধিক মানুষ চিকিৎসা নিয়েছেন। 

এ ছাড়া বাগেরহাট দড়াটানা সেতু ও মুনিগঞ্জ সেতুর টোল প্লাজা ভাঙচুর করা হয়েছে। এই দুই সেতু টোল ফ্রি করে দেওয়া হয়েছে। বাগেরহাট সদর উপজেলার সিএন্ডবি বাজার, উৎকুল বাজার, যাত্রাপুর বাজারসহ বেশকিছু বাজারেও খাজনা তুলছেন না ইজারাদাররা।

এদিকে মোংলা, রামপাল, মোরেলগঞ্জ, শরণখোলা, কচুয়া ও বাগেরহাট সদর এলাকায় অন্তত ২০ হাজার মৎস্য ঘেরের মাছ লুট হয়েছে। দখল হয়েছে কয়েক হাজার ঘের। আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতা অবশ্য বিএনপি নেতাদের দখল করা ঘের স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিয়ে চলে গেছেন।

জেলার বিভিন্ন উপজেলার বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, সরকার পতনের পর বিজয় মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে অনেকেই হামলা ও ভাঙচুর করেছেন। কেউ কেউ সাধারণ পথচারীদের মারধরও করেছেন। নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী কাউকে কাউকে ঠিক একদিন আগে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে আওয়ামী লীগের মিছিলে লাঠিসোঁটা হাতে দেখা গেছে।

প্রত্যন্ত গ্রামে হামলা ও লুটপাটে জড়িতদের বেশিরভাগ এলাকার পরিচিতমুখ। কেবল ব্যক্তি আক্রোশের কারণেও অনেকস্থানে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বাড়ি ঘরে হামলা-লুটের পাশাপাশি কিছু সাধারণ মানুষের বাড়ি-ঘরেও হামলা করছে তারা।

হামলায় আহত উল্লেখযোগ্য আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যে রয়েছেন— বাগেরহাট-১ আসনের সংসদ সদস্য শেখ হেলাল উদ্দিনের ব্যক্তিগত সহকারী ফিরোজুল ইসলাম, কাড়াপাড়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মুহিতুর রহমান পল্টন, পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ বশিরুল ইসলাম অন্যতম।

আহত সংবাদকর্মীরা হলেন— শরণখোলা প্রেসক্লাবের সভাপতি প্রতিদিনের বাংলাদেশের উপজেলা প্রতিনিধি ইসমাইল হোসেন লিটন ও প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক কালের কণ্ঠের প্রতিনিধি মহিদুল ইসলাম, উপজেলা রামপাল প্রেস ক্লাবের সভাপতি সবুর রানা, এশিয়ান টেলিভিশনের রামপুর উপজেলা প্রতিনিধি সুজন মজুমদার,  প্রতিদিনের বাংলাদেশ জেলা প্রতিনিধি শেখ সোহেল। সাংবাদিকদের ওপর হামলার সময় প্রেসক্লাবও ভাঙচুর করা হয়। প্রেসক্লাবের দুটো কম্পিউটার ও বেশকিছু আসবাবপত্র লুটে নেয় হামলাকারীরা। 

এদিকে সরকার পতনের পর থেকে পর থেকে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান টুকু, সাধারণ সম্পাদক ভুইয়া হেমায়েত উদ্দিন, পৌর মেয়র খান হাবিবুর রহমান, জেলা যুবলীগের সভাপতি সরদার নাসির উদ্দিন, শ্রমিক লীগের সভাপতি রেজাউর রহমান মন্টু, সাধারণ সম্পাদক খান আবু বকর সিদ্দিকসহ আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতারা আত্মগোপনে রয়েছেন। আত্মগোপনে রয়েছেন ৯ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও বেশিরভাগ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা। ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি ও জন বিচ্ছিন্নতার কারণে আত্মগোপনে যেতে হয়েছে তাদের।

অন্যদিকে বিএনপি, জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নেতারা নৈরাজ্যবিরোধী বক্তব্য দিয়ে সকল নেতাকর্মীকে শান্ত থাকতে বলেছেন। মন্দির, সনাতন ধর্মালম্বীদের বাড়ি-ঘর রক্ষায় বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীদের পাহারা দিতেও দেখা গেছে। এর পরেও কেন এত হামলা এমন প্রশ্নে বাগেরহাট জেলা বিএনপির আহ্বায়ক এটিএম আকরাম হোসেন তালিম বলেন, মানুষ ক্ষোভ থেকে এই হামলা করছে। তবে তারেক রহমানের নির্দেশে আমরা সবাইকে শান্ত থাকতে বলেছি।  

সহিংসতা বন্ধে বিএনপির পক্ষ থেকে মাইকিং করা হচ্ছে। পাশাপাশি বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা মাঠে রয়েছেন। এরপরও দলের নাম ভাঙিয়ে কেউ কোনো হামলা ও ভাঙচুরসহ কোনো অপরাধের সাথে জড়ালে তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। 

পুলিশ সুপার আবুল হাসনাত খান বলেন, দেশের বিভিন্ন স্থানে থানায় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। অসংখ্য পুলিশ সদস্য খুন হয়েছেন। ১১ দাবিতে পুলিশ সদস্যরা কর্মবিরতি পালন করছেন। এলাকার শান্তি–শৃঙ্খলা ফেরাতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল পুলিশকে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে। এই সংকট দ্রুতই কেটে যাবে বলে আশা তার।                    

শেখ আবু তালেব/এনএফ

Visit Source Page

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *