তিস্তা নদীতে বাড়িঘর বিলীন, নেই খাবার 

তিস্তা নদীতে বাড়িঘর বিলীন, নেই খাবার 

শাহানুর বেগমের বাবার বাড়ি কুষ্টিয়ায়। প্রায় ৩০ বছর আগে বিয়ে হয় লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার গোবর্ধন তিস্তা নদীর তীরবর্তী এলাকার মঞ্জুর হোসেনের সঙ্গে। বিয়ের সময় শাহানুর বেগম জানতেন না তিস্তা নদীর পাশে তার বিয়ে হচ্ছে। বাবা-মায়ের ইচ্ছাতেই বিয়ে করেন। ওই বছর হঠাৎ করে তিস্তার পানি বেড়ে তার শ্বশুরের বেশিরভাগ জমি নদীতে বিলীন হয়ে যায়। আর এতে মঞ্জুর হোসেনের পুরো পরিবার নিঃস্ব হয়ে যায়। 

শাহানুর বেগমের বাবার বাড়ি কুষ্টিয়ায়। প্রায় ৩০ বছর আগে বিয়ে হয় লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার গোবর্ধন তিস্তা নদীর তীরবর্তী এলাকার মঞ্জুর হোসেনের সঙ্গে। বিয়ের সময় শাহানুর বেগম জানতেন না তিস্তা নদীর পাশে তার বিয়ে হচ্ছে। বাবা-মায়ের ইচ্ছাতেই বিয়ে করেন। ওই বছর হঠাৎ করে তিস্তার পানি বেড়ে তার শ্বশুরের বেশিরভাগ জমি নদীতে বিলীন হয়ে যায়। আর এতে মঞ্জুর হোসেনের পুরো পরিবার নিঃস্ব হয়ে যায়। ুশাহানুর বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আগে জানলে আমি কখনোই তিস্তা নদীর এলাকায় বিয়ে করতাম না। আমার শ্বশুরের অনেক সম্পদ ছিল, কিন্তু তিস্তা নদী সব কিছু গিলে খেয়েছে। আজ আশ্রয়ের জন্য অন্যের জমিতে বসবাস করছি। রান্না করে দুই সন্তানকে কিছু খাওয়াতে পারছি না। 

কান্নজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, এই জীবন রেখে কী লাভ আর। নদীর ব্যাপারে এখনো কোনো পদক্ষেপ সরকার নিচ্ছে না।

শাহানুরের মতো আদিতমারী উপজেলার বাহাদুর পাড়ার ৮০ বছরের বৃদ্ধ রহমত উল্লাহও জানালেন দীর্ঘদিনের কষ্টের কথা। তিনি বলেন, এই জীবনে ১৭ বারের থেকে বেশি বাড়িঘর সরিয়েছি। আমি এই গ্রামের লাখপতি ছিলাম। কিন্তু আজ আমার কিছু নেই, সরকার বাহাদুর এসেই তিস্তাপাড়ের মানুষকে শুধু আশ্বাস দিয়ে ভোট নেন। জানি এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না। তাদের আশ্বাস দিয়ে আর কী হবে আমাদের জীবনে? তিস্তা নদীতে সব জমি বিলীন হয়ে গেছে। গত কয়েক দিনের তিস্তার পানি বৃদ্ধিতে আমার ঘর সরাতে হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাকে কতবার কল দিয়েছি, কিন্তু ফোন ধরে না। জিও ব্যাগ হলে কয়েকটি বাড়ি তারা রক্ষা করতে পারতেন। কিন্তু না তারা কোনো খবর রাখছে না। তাই নতুন সরকারের প্রতি অনুরোধ দ্রুত তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে তিস্তা পাড়ের মানুষকে রক্ষা করুন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সোমবার (৩০ সেপ্টেম্বর) সকাল ৯টায় হাতীবান্ধা উপজেলার দোয়ানীতে দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজের ডালিয়া পয়েন্টে পানি প্রবাহ রেকর্ড করা হয় ৫১ দশমিক ৭০ সেন্টিমিটার। যা বিপৎসীমার (স্বাভাবিক ৫২ দশমিক ১৫ মিটার) ৪৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়। এর আগে রোববার সকাল ৬টায় বিপৎসীমার ২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।

বন্যা সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানায়, শনিবার দুপুর থেকে তিস্তা নদীর ডালিয়া পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার কাছাকাছি দিয়ে প্রবাহিত হয়। রোববার সকাল ৬টায় বিপৎসীমার ২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এতে লালমনিরহাটের ৫টি উপজেলার প্রায় ২৫ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়ে। লালমনিরহাট সান্তাহার রেলরুটের লালমনিরহাট রতিপুর এলাকায় আধা কিলোমিটার রেলপথ ডুবে যায়। যা ওই দিনই সংস্কার করে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক রাখে রেলওয়ে। 

রোববার দুপুর নাগাদ বিপৎসীমার নিচে নেমে আসে পানির প্রবাহ। বিকেল ৩টায় বিপৎসীমার ৮ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে তিস্তা নদীর পানিপ্রবাহ রেকর্ড করা হয় ডালিয়া পয়েন্টে। সোমবার সকাল ৯টায় পানি আরও কমে গিয়ে বিপৎসীমার ৪৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে তিস্তার বামতীর লালমনিরহাটে বন্যা পরিস্থিতির বেশ উন্নতি হয়েছে। পানি কমলেও তা ধীরগতিতে নামছে। নদীপাড়ে অধিকাংশ বাড়ি থেকে পানি নেমে গেছে। বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটলেও বেড়েছে দুর্ভোগ। বন্যার পানির স্রোতে ভেসে গেছে ঘরবাড়ির বিভিন্ন জিনিসপত্র। ভিজে নষ্ট হয়েছে সংসারের নিত্য প্রয়োজনীয় অনেক পণ্য। এসব সংগ্রহ ও মেরামতে ব্যস্ত পানিবন্দি পরিবারগুলো। 

এদিকে পানিবন্দি ও বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ১৩ লাখ টাকা ও ৯০ মেট্রিক টন জিআর চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। যা সংশ্লিষ্ট উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বন্যার্তদের মাঝে বিতরণ শুরু করেছে। 

টানা দুই-তিন দিনের বন্যায় নদী তীরবর্তী এলাকার বেশ কিছু রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট ভেঙে গেছে পানির তোরে। উঠতি আমন ধান ও বিভিন্ন সবজি ক্ষেত ডুবে আছে বন্যার পানিতে। দীর্ঘ সময় ডুবে থাকায় এসব ফসলের ক্ষতির শঙ্কা করছেন চাষিরা। একই সঙ্গে বন্যার পানির তোড়ে ভেসে গেছে বেশ কিছু পুকুরের মাছ। 

গোবর্ধন গ্রামের কৃষক রহমত বলেন, বন্যার পানিতে তিন দিন ধরে ডুবে আছে উঠতি আমন ধানের ক্ষেত। পানি নামতে শুরু করেছে। পানি পুরো নেমে গেলে তখন বুঝা যাবে ক্ষেতের অবস্থা। তবে ক্ষতির আশঙ্কা তো আছেই। আপাতত ধান ক্ষেতে কচুরি পানা ও আটকে থাকা আবর্জনা সরিয়ে দিচ্ছি। নদীপাড়ের জীবন মানেই কষ্টের জীবন। বন্যা এলেও কষ্ট, গেলেও কষ্ট।

হাতীবান্ধা উপজেলার ডাউয়াবাড়ি গ্রামের আফাজ উদ্দিন বলেন, বন্যায় গরুর জন্য রাখা খড় ভিজে নষ্ট হয়েছে। এখন বন্যার পানিতে পচে যাওয়া ঘাসও খাওয়ানো যাবে না। খড়ও ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে। গরুর খাবার নিয়ে বড্ড চিন্তায় আছি। বন্যার পরে খড়ের দামও বেড়েছে কয়েকগুণ।

লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সুনিল কুমার বলেন, তিস্তার বেশ কয়েকটি স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে। সেখানে জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙন রোধের চেষ্টা করা হচ্ছে। 

তিস্তা পাড়ের মানুষের অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, এখানে আসার পর থেকে এই অঞ্চলের মানুষ তিস্তার বিষয়ে জানে। যখন একটি পরিবারের ঘরবাড়ি নদীতে বিলীন হতে থাকে, তখন আমাদের প্রতিসহ সরকারের ওপর মন খারাপ করতে পারে। তবে আমরা সর্বাধিক চেষ্ট করে যাচ্ছি ভাঙন রোধ করতে।

লালমনিরহাটের জেলা প্রশাসক এইচ এম রকিব হায়দার বলেন, বন্যাকবলিতদের জন্য ১৩ লাখ টাকা ও ৯০ মেট্রিক টন জিআর চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। যা ইতোমধ্যে বিতরণ শুরু হয়েছে। বন্যা পরিস্থিতিরও যথেষ্ট উন্নতি ঘটেছে। আশা করছি তিস্তা পাড়ের মানুষ বেশি দিন এই কষ্টে থাকবে না।

নিয়াজ আহমেদ সিপন/আরএআর

Visit Source Page

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *