৫ আগস্ট সরকার পতনের পর আড়ালে চলে যান দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ। কেউ আছেন দেশে, আবার কেউ বিদেশে। দলের সভাপতি সে দিনই ভারতে চলে যাওয়ায় দেখা দিয়েছে নেতৃত্বে শূন্যতা। ভারতে বসে দলীয় নেতাদের সঙ্গে মাঝেমধ্যে কথা বলে কিছু বার্তা দিচ্ছেন তিনি। তবে, আগামীতে দলীয় অবস্থান বা নেতাকর্মীরা কী করবেন— সেই দিকনির্দেশনা এখনও আসেনি তার কাছ থেকে।
৫ আগস্ট সরকার পতনের পর আড়ালে চলে যান দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ। কেউ আছেন দেশে, আবার কেউ বিদেশে। দলের সভাপতি সে দিনই ভারতে চলে যাওয়ায় দেখা দিয়েছে নেতৃত্বে শূন্যতা। ভারতে বসে দলীয় নেতাদের সঙ্গে মাঝেমধ্যে কথা বলে কিছু বার্তা দিচ্ছেন তিনি। তবে, আগামীতে দলীয় অবস্থান বা নেতাকর্মীরা কী করবেন— সেই দিকনির্দেশনা এখনও আসেনি তার কাছ থেকে।
এদিকে, গ্রেপ্তারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে জামিন পাওয়া আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক সাবের হোসেন চৌধুরীকে নিয়ে শুরু হয়েছে নানা গুঞ্জন। এক-এগারোর সময় এ সংস্কারপন্থী নেতাকে আবারও সংস্কার কাজে দেখা যেতে পারে বলে বেশ আলোচনা চলছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা বলছেন, এখনই সংস্কারের প্রয়োজন নেই। দলের সভাপতির দিকনির্দেশনায় চলবে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম। সংস্কার আওয়ামী লীগের জন্য নয়, অন্য দলের হলে সমস্যা নাই।
সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক সাবের হোসেন চৌধুরীকে দিয়ে দলের সংস্কার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার ঠিকানা বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা। তিনি আমাদের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তাকে সামনে রেখেই আশার জায়গা দেখছি। তিনি নির্দেশনা দিচ্ছেন, পরামর্শ দিচ্ছেন। উনার সিদ্ধান্তই আমাদের কাছে চূড়ান্ত। আমরা সেটা অনুসরণ করব।
তিনি আরও বলেন, আগামীতে আওয়ামী লীগে সংস্কার হবে। সেখানে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অনেক ক্লিন ইমেজের লোক যুক্ত হবেন। এটা নিয়ে এখনই কথা বলার সময় আসেনি। সময় ও প্রয়োজন মতো সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। দলে এখনও শেখ হাসিনার চাইতে গ্রহণযোগ্য নেতৃত্ব নাই।
দলীয় সূত্র মতে, গত দুই মাসের অধিক সময় ক্ষমতায় নেই আওয়ামী লীগ। এর মধ্যে ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস তৃণমূল পর্যায়ে পালন করা হলেও কেন্দ্রীয়ভাবে পালন করতে পারেনি দলটি। অনেক নেতা আত্মগোপনে রয়েছেন। যারা দেশে রয়েছেন তারাও ভয়ে দিন পার করছেন, কখন গ্রেপ্তার কিংবা প্রতিপক্ষের হামলা-মামলার শিকার হন। ক্ষমতাসীন দলটির নেতাকর্মীরা আতঙ্কে দিন পার করলেও দলটির হাই কমান্ড থেকে এখনও তেমন নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। শুধুমাত্র মামলা ও হামলার তথ্য শেয়ার করতে বলা হয়েছে। দলের সভাপতি ও বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ভারতে চলে গেলেও বর্তমানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের কোথায় আছেন, সেটি জানা যায়নি। যিনি ক্ষমতায় থাকাকালে প্রতিনিয়ত মিডিয়া কিংবা নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা না বলে থাকতে পারতেন না, তিনিও আজ নিরুদ্দেশ।
সরকার পতনের পর একটিও শব্দ বলেননি তিনি। দেননি কোনো বিবৃতি। শুধু ওবায়দুল কাদের নন, দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, সাংগঠনিক সম্পাদক ও সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যদেরও হদিস নেই। তবে, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ ও আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম মাঝেমধ্যে বিবৃতি দিচ্ছেন। তারা নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছেন বলে জানা গেছে।
দীর্ঘদিন ক্ষমতা থাকার পরও কেন্দ্রীয় নেতাদের নিরুদ্দেশ হওয়ায় তৃণমূলের নেতাকর্মীরা পড়েছেন বেকায়দায়। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে দলের হাল কে ধরবেন— এমন প্রশ্ন সরব হয়েছে রাজনীতির ময়দানে। এরই মধ্যে গুঞ্জন উঠেছিল সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এবং নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীকে আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক করার। সেই গুঞ্জনও কেন্দ্রীয় নেতারা উড়িয়ে দিয়েছেন। এখন নতুন করে দলের হাল ধরতে দুজনের নাম শোনা যাচ্ছে। তারা হলেন- ডাকসুর সাবেক ভিপি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ ও আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক সাবের হোসেন চৌধুরী।
এদিকে, সাবের হোসেন চৌধুরীকে গত রোববার সন্ধ্যায় গুলশানের বাসা থেকে আটক করে পুলিশ। পরে তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। সাবের হোসেন চৌধুরী আওয়ামী লীগের বিগত সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। ৪৮ ঘণ্টার আগেই তিনি একসঙ্গে পৃথক ছয়টি মামলায় জামিন পান। এক-এগারোর সময়ে সংস্কারপন্থী হিসেবে পরিচিত ছিলেন তিনি। তারপর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে প্রায় এক দশক দলের রাজনীতিতে ছিলেন পেছনের সারিতে।
দলীয় সূত্র মতে, আওয়ামী লীগ সভাপতির স্নেহধন্য সাবের হোসেন এক-এগারোর সময় সংস্কারপন্থী হিসেবে তকমা পেয়ে রাজনীতিতে একপর্যায়ে গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেন। ২০০৮ সাল থেকে আওয়ামী লীগ চারবার মন্ত্রিসভা গঠন করে। প্রতিটিতে তার নাম আলোচনায় থাকলেও ২০২৪ সালে তার কপাল খোলে। সেটিও বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। তবে অনেকে বলছেন, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক যোগাযোগ থাকায় সাবের হোসেনকে দলের এমন দুঃসময়ে কাজে লাগানো হতে পারে।
অন্যদিকে, কানাডা থেকে দেশে ফিরে আটক হন সাবেক সংসদ সদস্য সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ। তাকে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে আটক করা হয়। সুলতান মনসুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সহসভাপতি (ভিপি) ছিলেন। ছিলেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক। এক-এগারোর সময় দলের সঙ্গে সুলতান মনসুরের দূরত্ব তৈরি হয়। অনেকেই মনে করছেন, দলের হাই কমান্ডের নির্দেশে তিনি দেশে ফিরেছেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে কোনোভাবেই কানাডা থেকে দেশে ফেরার কথা নয় তার। হয়তো দলের দুঃসময়ে পাশে থাকতেই দেশে ফিরেছেন তিনি।
তবে, সুলতান মনসুর আহমেদ ও সাবের হোসেন চৌধুরী দলের সংস্কারে ভূমিকা রাখবেন কি না— সে বিষয়ে তাদের মতামত পাওয়া যায়নি।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা ঢাকা পোস্টকে বলেন, এক-এগারোর সময় যারা শেখ হাসিনাকে মাইনাস করতে চেয়েছিলেন তাদেরকে কোনোভাবেই দল সংস্কারের দায়িত্ব দেওয়া যাবে না। এখন নেতৃত্ব দেওয়ার সময় নয়। নেতাকর্মীদের হামলা-মামলা থেকে বাঁচানোর পথ খুঁজে বের করতে হবে। প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হবে।
আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতারা বলছেন, দলকে আবারও ঘুরে দাঁড়াতে হলে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকেই প্রয়োজন। অন্য কাউকে দিয়ে সংস্কার হবে না। আগামী বছর দলের ত্রিবার্ষিক কাউন্সিল হওয়ার কথা। দলকে চাঙ্গা করতে কিছু দুর্নীতিবাজ ও পদবিক্রেতাকে বাদ দিয়ে নতুনভাবে সংস্কার করতে হবে। সেটি প্রেস রিলিজের মাধ্যমেও করা যেতে পারে। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে যিনি মাঠে থেকে শেখ হাসিনার নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে পারবেন, জেল-জুলুম মেনে নিয়ে মাঠে থাকতে পারবেন, তাকেই এখন দরকার। তবে, নেতৃত্ব বাছাইয়ে ক্লিন ইমেজের লোক প্রয়োজন।
সংস্কার প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের এক নেতা ঢাকা পোস্টকে বলেন, এটি ভুয়া খবর। আওয়ামী লীগ এখন সংস্কারের কথা চিন্তা করছে না। আর কোনো দল যদি ষড়যন্ত্র হিসেবে সংস্কার করতে চায়, সেটি কেউ মেনে নেবে না।
অন্যদিকে, এক-এগারোর সময় দলের কিছু নেতা বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে সরিয়ে সংস্কারের চেষ্টা করেছিল। সেই প্রক্রিয়া এবারও হবে কি না, তা নিয়েও চিন্তিত দলটির তৃণমূলের নেতারা। তাদের মতে, ২০০৭-০৮ সালের দিকে সেনাসমর্থিত ফখরুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদি শাসন করতে চেয়েছিল। ওই সরকারের পেছনে দেশের সুশীল সমাজের একটি অংশের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। তারা চেয়েছিলেন রাজনীতিমুক্ত একটি সরকার গঠন করতে, রাজনীতিবিদদের হেয়প্রতিপন্ন করতে। এ জন্য রাজনীতিকে বিভক্ত করার এক কূট কৌশলে নেমেছিল এক-এগারোর সরকার। ওই কৌশলের অংশ হিসেবে আওয়ামী লীগের মধ্যেও বিভক্তি তৈরির চেষ্টা করা হয়েছিল।
খালেদা জিয়াকে মুক্ত এবং শেখ হাসিনাকে বিভিন্ন মামলা দেওয়া হচ্ছে, মাইনাস টু বিষয়টা আপনার কীভাবে দেখছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব মুহাম্মাদ আবুল কালাম আজাদ মজুমদার বলেন, মাইনাস টু বিষয় সরকারের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নাই। এটা নিয়ে আমাদের কোনো উদ্বেগ বা অন্য কোনো চিন্তাও নাই। আমাদের সরকার মাইনাস টু কী জিনিস সেটা জানে না। মাইনাস টু নিয়ে আমাদের সরকারের কোনো পর্যায়ে আলোচনা হয়নি। ভবিষ্যৎ হওয়ারও কোনো সম্ভাবনা নেই।
আওয়ামী লীগের অনেক নেতা ওই সময় শেখ হাসিনার নেতৃত্বের বিরোধিতা করেছিলেন। তারা সংস্কারের দাবি করেছিলেন। কেউ কেউ শেখ হাসিনাকে মাইনাস করতে চেয়েছিলেন তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল মইন উ আহমেদের রাজনৈতিক অভিলাষ পূরণের জন্য। এখনও ওই নেতাদের আওয়ামী লীগের ‘সংস্কারপন্থী নেতা’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তবে, শেষ পর্যন্ত ষড়যন্ত্রকারীরা সফল হতে পারেননি।
এক-এগারোর সময় বিরাজনীতিকরণে বুঝে কিংবা না বুঝে সহযোগিতা করেছিলেন- আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, প্রয়াত আব্দুর রাজ্জাক, প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ, মাহমুদুর রহমান মান্না, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, মুকুল বোস, আ খ ম জাহাঙ্গীর, সাঈদ খোকন ও আখতারুজ্জামান। এ ছাড়া সাবের হোসেন চৌধুরীসহ আরও কয়েকজনের নাম ছিল ‘সংস্কারপন্থী’ তালিকায়।
এমএসআই/এমএআর