মুক্তিযুদ্ধ ও জাতীয় সংগীতকে কটাক্ষ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত

মুক্তিযুদ্ধ ও জাতীয় সংগীতকে কটাক্ষ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে স্বৈরশাসকের পতনের পর মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং জাতীয় সংগীতসহ জনসাধারণের আবেগ ও অনুভূতি নিয়ে একটি সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী অপতৎপরতায় লিপ্ত হয়েছে দাবি করে এর বিরুদ্ধে উদ্বেগ ও নিন্দা জানিয়েছেন দেশের ৪৮ বিশিষ্ট নাগরিক।

শনিবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে তারা বলেন, একটি সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ এমনকি জাতীয় সংগীত নিয়ে প্রশ্ন তোলার ধৃষ্টতা দেখাতে পরিকল্পিত প্রচার শুরু করেছে। মাত্র কয়েকদিন আগে জামায়াতে ইসলামীর আমির জাতিকে অতীতের সবকিছু ভুলে যাবার পরামর্শ দিয়েছেন। অনুমান করা যায়, অতীত বলতে তিনি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, সেই সময়ে তার দলের ভূমিকার কথাই বুঝিয়েছেন। তিনি যে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকেই বোঝাতে চেয়েছেন, তা আরও পরিষ্কার হলো গত ৩ সেপ্টেম্বর জাতীয় প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুল্লাহিল আমান আযমী সংবিধান ও জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের দাবি জানিয়ে যে বক্তব্য দিয়েছেন তা থেকে। আমরা তার এই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, সাম্প্রদায়িক ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্যের নিন্দা ও তীব্র প্রতিবাদ জানাই।

বিবৃতিতে তারা বলেন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অর্থ এই নয়, যেখানে যা খুশি তাই বলা। যে উদ্দেশ্যে তিনি ৩ সেপ্টেম্বরের সংবাদ সম্মেলন ডেকেছিলেন, তার বাইরে গিয়ে সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে জাতীয় সংগীত ও সংবিধানের মূলনীতির প্রতি কটাক্ষ করে তিনি বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষের আবেগের জায়গায় আঘাত করেছেন। 

তারা বলেন, সবার মনে রাখা দরকার, ১৯৭১ সালে তরুণ, ছাত্র, কৃষক-শ্রমিক-সেনা-পুলিশ সদস্যসহ সর্বস্তরের বিভিন্ন ধর্ম-জাতি-বর্ণ নারী-পুরুষ নির্বিশেষে লাখ লাখ মানুষ জীবনপণ লড়াইয়ে ৯ মাসের সশস্ত্র যুদ্ধে চরম আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নামের আমাদের এই প্রিয় দেশটিকে স্বাধীন করেছিলেন। এর জন্য বর্বর হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসর জামায়াতসহ বিভিন্ন দলীয় ঘাতক বাহিনীর অবর্ণনীয় বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতার শিকার হতে হয়েছে সাধারণ মানুষ নারী-পুরুষ, ছাত্র-শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী-লেখক, শিল্পী, সাংবাদিকসহ সর্বস্তরের অগণিত ব্যক্তি ও পরিবারকে। সেই ইতিহাস এই দেশের প্রজন্মের পর প্রজন্মের মানুষ মনে রেখেছে এবং ভবিষ্যতেও মনে রাখবে। এই ইতিহাস ভুলে যাবার কথা বলার অধিকার কিংবা দুঃসাহস কারোরই থাকার কথা নয়। আর জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’ গেয়েই মুক্তিযোদ্ধারা জীবনপণ লড়াইয়ের শপথ নিয়েছেন, যুদ্ধ করেছেন। তাদের অনেকে শহিদ হয়েছেন, অনেকে শারীরিক পঙ্গুত্বের শিকার হয়েছেন। অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা যে যুদ্ধ করেছেন, জাতীয় সংগীত ছিল তাদের প্রেরণার সার্বক্ষণিক উৎস। তাই জাতীয় সংগীতটি কার্যত যুদ্ধের মধ্য দিয়েই লাখো শহিদের রক্তে নতুনভাবে আমাদের প্রাণের সংগীত হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। একে নিয়ে প্রশ্ন তোলা মানে মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে প্রশ্ন তোলা। একে কোনোভাবেই এই দেশের মানুষ দলমত নির্বিশেষে ছাত্র-জনতা মেনে নেবে না।

বিবৃতিতে তারা আরও বলেন, সাবেক ওই সেনা কর্মকর্তা গুমের শিকার হয়ে রাষ্ট্রীয় সামরিক গোয়েন্দা বাহিনীর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত গোপন আটককেন্দ্র ‘আয়নাঘর’-এ দীর্ঘ আট বছর বন্দি ছিলেন। গুমের শিকার ব্যক্তিদের মুক্তিসহ রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন এজেন্সির দ্বারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচারের দাবিতে আমরা বরাবরই সোচ্চার ছিলাম, এখনও আছি। আমরা চাই সাবেক ওই সেনা কর্মকর্তাসহ যারা ‘আয়নাঘর’-এ আটক ছিলেন, নিপীড়ন, নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তারা সবাই ন্যায়বিচার যেন পান। আমরা আশা করব অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তাদের ন্যায়বিচারের বিষয়টি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিশ্চিত করবে। কিন্তু তার সঙ্গে জাতীয় সংগীত কিংবা মুক্তিযুদ্ধের অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার যে কোনো প্রচেষ্টা নিতান্তই উদ্দেশ্যমূলক। তাই যারা ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ কিংবা জাতীয় সংগীত নিয়ে প্রশ্ন তুলতে চেষ্টা করছেন কিংবা অসত্য তথ্য প্রচার করছেন তাদের এ ধরনের ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য প্রদান থেকে বিরত থাকার জন্য আমরা আহ্বান জানাচ্ছি। অন্যথায় এর বিরুদ্ধে জনপ্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য আরও বৃহৎ কর্মসূচি দিতে আমরা বাধ্য হবো।

বিবৃতিতে বলা হয়- শত শত শিক্ষার্থী, শিশু, কিশোরী-কিশোর ও জনতার প্রাণ বিসর্জনের মধ্য দিয়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ও গণতন্ত্রের যে বিজয় অর্জিত হলো, তাকে সংকীর্ণ দলীয় ও গোষ্ঠীগত স্বার্থ হাসিলের জন্য কোনো সাম্প্রদায়িক অথবা অন্য গোষ্ঠী যাতে ব্যবহার করতে না পারে সেজন্য আমাদের সবাইকে সদা সতর্ক, সজাগ ও ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।

বিবৃতিদাতারা হলেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, মানবাধিকার কর্মী ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা সুলতানা কামাল, নিজেরা করির সমন্বয়ক খুশি কবীর, অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে. চৌধুরী, সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী জেড আই খান পান্না, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটি উপাচার্য পারভীন হাসান, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, মৌলানা আব্দুল হামিদ খান ভাষানী পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. মো. হারুন-অর-রশিদ, সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট তবারক হোসেন, আলোকচিত্রী ড. শহিদুল আলম, এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, লেখক রেহনুমা আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শাহনাজ হুদা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. খাইরুল ইসলাম চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ঈশানী চক্রবর্তী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জোবায়দা নাসরিন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মাহা মির্জা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সামিনা লুৎফা, ল্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ড. সাদাফ নুর, বাংলাদেশ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি ড. নূর মোহম্মদ তালুকদার, নতুন দিগন্তের নির্বাহী সম্পাদক মাযহারুল ইসলাম বাবলা, বিবর্তন সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সভাপতি এএসএম কামালউদ্দিন, বিবর্তন সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক মফিদুর রহমান লাল্টু, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মিনহাজুল হক চৌধুরী, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক সালেহ আহমেদ, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মনিন্দ্র কুমার নাথ, কোস্ট ট্রাস্টের নির্বাহী পরিচালক রেজাউল করিম চৌধুরী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ফারহা তানজীম তিতিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক তাসনীম সিরাজ মাহবুব, নাগরিক উদ্যোগের প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন, এমএসএফ’র প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট সাইদুর রহমান, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার আশরাফ আলী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার শাহদাত আলম, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট নাজমুল হুদা, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট এমএম খালেকুজ্জামান, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মো. আজিজুল্লাহ ইমন, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট প্রিন্স আল মাসুদ, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট উম্মে কুলসুম, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট শায়লা শারমীন, মানবাধিকার কর্মী তাপসী রাবেয়া, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আজমীর হোসেন, মানবাধিকার কর্মী দীপায়ন খীসা, মানবাধিকার কর্মী ও সংগীত শিল্পী বাপ্পী মাশেকুর রহমান, আদিবাসী অধিকার কর্মী হানা শামস আহমেদ, সাঙ্গাত’র কোর গ্রুপ মুক্তাশ্রী চাকমা, এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা।

এসকেডি

Visit Source Page

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *