২০০৪ সাল। ইংল্যান্ডের লন্ডনের এক কফিশপে আলোচনায় রোমান আব্রামোভিচ এবং হোসে মরিনিও। রোমান আব্রামোভিচ চেলসির মালিক আর মরিনিও কেবলই পোর্তোকে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতিয়ে ফুটবল বিশ্বে শোরগোল ফেলেছেন। দুজনের আলোচনার বিষয় একজন স্ট্রাইকার। চেলসিকে শিরোপার রেসে ফেরাতে হবে আর সেজন্য দরকার এক স্ট্রাইকার। মরিনিও আলোচনায় তুললেন অখ্যাত এক তরুণ দিদিয়ের দ্রগবার নাম। ফ্রান্সের ক্লাব মার্শেইতে খেলেন তিনি।
২০০৪ সাল। ইংল্যান্ডের লন্ডনের এক কফিশপে আলোচনায় রোমান আব্রামোভিচ এবং হোসে মরিনিও। রোমান আব্রামোভিচ চেলসির মালিক আর মরিনিও কেবলই পোর্তোকে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতিয়ে ফুটবল বিশ্বে শোরগোল ফেলেছেন। দুজনের আলোচনার বিষয় একজন স্ট্রাইকার। চেলসিকে শিরোপার রেসে ফেরাতে হবে আর সেজন্য দরকার এক স্ট্রাইকার। মরিনিও আলোচনায় তুললেন অখ্যাত এক তরুণ দিদিয়ের দ্রগবার নাম। ফ্রান্সের ক্লাব মার্শেইতে খেলেন তিনি।
মরিনিও সেদিন বলেছিলেন, ‘মিস্টার আব্রামোভিচ, পে। প্লিজ পে অ্যান্ড ডোন্ট স্পিক।’ তাকে নিয়ে পর্তুগিজ কোচের বক্তব্য ছিল পরিস্কার। ‘অনলি হি ক্যান টার্ন দ্য ওয়াটার ইনটু ওয়াইন।’ বাইবেলে এমন শব্দ উচ্চারণ করা হয় যীশুর ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ করতে। দ্রগবা সত্যিই কতখানি ক্ষমতাধর সেটা ফুটবল মাঠে প্রমাণ করেছেন বহুবারই।
তবে আইভোরিকোস্টের দ্রগবা সত্যিই যেন জেসাসের মতোই। যার উত্থানে বদলে গিয়েছিল পূর্ব আফ্রিকার দেশটির ফুটবল। যার দেখানো পথে আজও আইভরিকোস্ট আফ্রিকান ফুটবলের পরাশক্তি। সেই দ্রগবাই একদিন থামিয়ে দিয়েছিলেন দেশের গৃহযুদ্ধ। ফুটবলের মাঠ থেকে দিদিয়ের দ্রগবার আকুতি থামিয়ে দেয় আইভোরিকোস্টের দীর্ঘদিনের গৃহযুদ্ধ।
ঘটনা ২০০৫ সালের ৮ অক্টোবর। ২০০৬ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলে প্রথম বারের জন্য যোগ্যতা অর্জন করতে হলে আইভরি কোস্টকে জিততেই হবে সুদানের বিরুদ্ধে। একইসময়ে ক্যামেরুনকেও হারতে হবে কিংবা ড্র করতে হবে। যদি ক্যামেরুন জিতে যায়, তবে আইভরিকোস্ট জিতলেও বিশ্বকাপের টিকিট পাবে না। এমনই এক ম্যাচে সুদানকে ৩-১ গোলে হারায় আইভরিকোস্ট।
খানিক পর ভেসে আসে আনন্দের এক খবর। মিশরের বিপক্ষে ১-১ গোলে ড্র তাদের। প্রথমবার বিশ্বকাপে আইভরিকোস্ট! ড্রেসিংরুমে উল্লাস। এরই মধ্যে দলনেতা দ্রগবা সবাইকে উল্লাস থামাতে বলেন। ডেকে আনা হয় মিডিয়াকে, পুরো আইভরিকোস্ট তখন টিভির সামনে সরাসরি সম্প্রচারে। শান্ত কণ্ঠে দ্রগবা দিলেন যুদ্ধবন্ধের ডাক। আজও দেশে দেশে চরম গোলযগের মুহূর্তে যে আওয়াজ বাজে শান্তির দূত হয়ে।
দ্রগবা ক্যামেরার সামনে দিলেন যুদ্ধবন্ধের ডাক, ‘নারী কিংবা পুরুষ, উত্তর কি দক্ষিন, পূর্ব কি পশ্চিম; সব আজ এক হয়েছে। এবং এটাই প্রমাণ করেছে একাগ্রতা ও সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা আমাদেরকে বিশ্বকাপের জন্য মনোনীত করেছে। আমরা একসাথে বিশ্বকাপ খেলবো।
দ্রগবা দুইভাগে বিভক্ত হওয়া দেশের দুই প্রধান নেতার উদ্দেশ্যে আরোও বললেন- ‘আমরা কথা দিয়েছিলাম আমাদের জয়োল্লাস সবাইকে একত্রিত করবে। আমি হাতজোড় করি, আপনারা দয়া করে আগ্নেয়াস্ত্র নামিয়ে রাখুন। আফ্রিকার একটি দেশ যাতে প্রচুর সম্পদ আছে, তারা যুদ্ধে নামবে না। দয়া করে আপনাদের অস্ত্র রাখুন এবং নির্বাচনের আয়োজন করুন।’
দলনেতা দ্রগবার সঙ্গে হাঁটু গেড়ে বসলেন পুরো দল। দ্রগবার কণ্ঠে তখনো যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান, ‘যুদ্ধ ও শত্রুতা ভুলে অস্ত্র তুলে রাখুন, ভোট হোক। আমরা আনন্দে বাঁচতে চাই তাই স্টপ ফায়ারিং গানস।’
১ মিনিটের ছোট্ট এক বক্তব্য। পুরো আইভরিকোস্ট এবার এক ছাতার নিচে। ৫ বছরের গৃহযুদ্ধ থেমে যায় দ্রগবার ওই এক মিনিটের বক্তব্যের পর। প্রেসিডেন্ট আর বিদ্রোহিপক্ষ রাজি হয় সমঝোতার জন্য। আইভরিকোস্ট দেখল ইতিহাস গড়া এক যুদ্ধবিরতি।
মাঠের বাইরে যিনি নায়ক, মাঠেও তিনি ছিলেন অসামান্য। অভিষেক মৌসুমেই কারলিং কাপ ফাইনালে তারই দেওয়া গোলে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী লিভারপুলকে ১-০ তে হারায় চেলসি। ইনজুরি বিধ্বস্ত মৌসুমেও তার অবদান ছিল বলার মতো। করেছিলেন ১৬ গোল। সেই থেকে শুরু। এরপরে চেলসির আক্রমণের আসল কাণ্ডারী তিনি। পরের মৌসুমের শুরুতে তারই গোলে আর্সেনালকে কমিউনিটি শিল্ডের ফাইনালে হারায় চেলসি। দিদিয়ের দ্রগবা হয়ে যান চেলসির পোস্টারবয়।
চার বার ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ, চারটা এফ এ কাপ, তিনবার লিগ কাপ, এক বার উয়েফা চ্যাম্পিয়ন লিগ। নিজ দেশের হয়ে ৬৫ গোল। দ্রগবাকে চেলসি ইতিহাসেরই সেরা খেলোয়াড় বলতেও দ্বিধা করেন না অনেকে। বিবিসির নির্বাচিত বর্ষসেরা আফ্রিকান ফুটবলার হয়েছেন, প্রিমিয়ার লিগে গোল্ডেন বুট জেতেন ২০০৫-০৬ এবং ২০০৯-১০ সালে। ২০১০ সালে টাইম ম্যাগাজিনের তালিকায় বিল ক্লিন্টন, বারাক ওবামা, লেডি গাগা, সিমোন কাওয়েল-এর সঙ্গে বিশ্বের একশো প্রভাবশালী মানুষের এক জন ছিলেন তিনি।
সেই যুদ্ধবিরতির দুই বছর পর আবার দু’পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা, লড়াই শুরু হয়ে যায়। আবারও এগিয়ে এলেন দ্রগবা। প্রেসিডেন্টকে বলে জাতীয় দলের একটি ম্যাচ আয়োজন করা হল। তবে রাজধানীতে না। ম্যাচ হলো বিদ্রোহী অধ্যুষিত এলাকায়। উদ্দেশ্য পুরো দেশকে ঐক্যবদ্ধ করা। সে ম্যাচে আইভরিকোস্টের জাতীয় সঙ্গীতের সময় দুই নেতাই পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছিলেন। দিদিয়ের দ্রগবা আরও একবার হাজির হলেন দেশের ত্রাতার ভূমিকায়।
মাদাগাস্কারের সাথে ম্যাচ খেলতে যখন বিদ্রোহীদের এলাকায় দ্রগবারা যাচ্ছেন, তাদের সামনে পিছনে সারি সারি সেনাবাহিনী! পুরো মাঠ পাহারা দিলো দুই পক্ষের শক্তিশালী বাহিনী। কিন্তু মাঠে বসে খেলা দেখলেন দুই প্রধান নেতা। ৫-০ গোলের জয়ের ম্যাচে শেষ গোল’টা দ্রগবা’ই করলেন। খেলা শেষের বাঁশি বাজতেই আনন্দে গ্যালারিতে থাকা দর্শকরা নেমে পড়লো মাঠে। সেনাবাহিনীর প্রটোকল থেকে বেরিয়ে দ্রগবা তখন জনতার।
অনেকগুলো বছর পর ব্রিটিশ সাংবাদিক অ্যালেক্স হেস এসেছিলেন আইভোরিকোস্টে। তার সঙ্গে পুরো দেশ ঘুরেছিলেন দ্রগবা। নিজের দেশে তখন তিনি আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তায়। দ্রগবা হাসিমুখে স্বীকার করেছিলেন সেদিন, ‘আমি অনেক ট্রফি জিতেছি। কিন্তু কোনোটিই আমাকে গৃহযুদ্ধ থামিয়ে দেওয়ার চেয়ে বেশি মর্যাদা আর আনন্দ দেয়নি।’
জেএ