#তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৮২২ কোটি টাকা
#তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৮২২ কোটি টাকা#খারাপ অবস্থায় পিপলস লিজিং, বিআইএফসি, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং#আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দুরবস্থার জন্য দায়ী কেন্দ্রীয় ব্যাংক
অনিয়ম আর নানা অব্যবস্থাপনায় ধুঁকছে বেশিরভাগ ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা এনবিএফআই। এসব প্রতিষ্ঠান যাচাই-বাছাই ছাড়াই নামে-বেনামে ঋণ দিয়েছে। কিন্তু এখন আদায় করতে পারছে না। ফলে এ খাতে বাড়ছে খেলাপি ঋণ। তিন মাসের ব্যবধানে এ খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৮২২ কোটি টাকা। ফলে চলতি বছরের জুন শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৪ হাজার ৭১১ কোটি টাকায়। যা তিন মাস আগে ছিল ২৩ হাজার ৮৮৯ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ পরিসংখ্যানে এমন চিত্র উঠে এসেছে।
খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান-পরিচালকদের যোগসাজশে ঋণ ভাগাভাগি করা হয়েছে। বেশিরভাগ ঋণের বিপরীতেও নেওয়া হয়নি জামানত। আবার ঋণ নেওয়া অনেক গ্রাহককে খুঁজেও পাওয়া যাচ্ছে না। এসব কারণে অর্থ সংকটে প্রতিনিয়ত দুর্বল হয়ে পড়ছে অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠান। আবার কিছু প্রতিষ্ঠান আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে পারছে না। ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের এমন পরিস্থিতির জন্য অন্যতম দায়ী কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কারণ, নিয়ন্ত্রণ সংস্থা হয়েও তারা কঠোরভাবে তদারকি করেনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, কিছু পরিচালক ও প্রভাবশালী ব্যক্তি কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে লুটপাট করেছে। তাদের সেই বড় বড় কেলেঙ্কারি ও অনিয়মের কারণে এখন খেলাপি ঋণ বেড়েছে। তাদের অনিয়মের কারণে অনেকগুলো আর্থিক প্রতিষ্ঠান এখন রুগ্ণ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এর প্রভাব পুরো খাতে ছড়িয়ে পড়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জুন শেষে ৩৫টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণের স্থিতি দাঁড়ায় ৭৪ হাজার ৫৩৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২৪ হাজার ৭১১ কোটি টাকা, যা মোট স্থিতির ৩৩ দশমিক ১৫ শতাংশ।
গত মার্চ শেষে ঋণ স্থিতি ছিল ৭৪ হাজার ৩৮৯ কোটি টাকা। ওই সময় খেলাপি ঋণ ছিল ২৩ হাজার ৮৮৯ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৩২ শতাংশ। অর্থাৎ তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৮২২ কোটি টাকা বা ৩ দশমিক ৪৪ শতাংশ। গত ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ২১ হাজার ৫৬৭ কোটি টাকা, যা ওই সময়ের মোট ঋণের ২৯ দশমিক ২৭ শতাংশ। সেই হিসাবে ছয় মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩ হাজার ১৪৪ কোটি টাকা বা ১৪ দশমিক ৫৭ শতাংশ।
অপরদিকে চলতি বছরের জুন শেষে আদায় অযোগ্য বা মন্দঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ২১ হাজার ৩৩ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা মোট ঋণের ২৮ দশমিক ২২ শতাংশ। যা গেল মার্চে ছিল ২০ হাজার কোটি টাকা, যা ওই সময়ের মোট ঋণের ২৬ দশমিক ৯১ শতাংশ।
আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স কোম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিএলএফসিএ) চেয়ারম্যান ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট ফাইন্যান্স কোম্পানির (আইআইডিএফসি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মো. গোলাম সরওয়ার ভূঁইয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, যেগুলো খেলাপি হয়েছে তার বেশিরভাগই পুরোনো ঋণ। ওই সময় অনেক ঋণ যাচাই-বাছাই ছাড়াই দিয়েছিল। নিয়ন্ত্রণ সংস্থাও তেমন তদারকি করেনি। ফলে মন্দঋণ বেড়েছে। তবে সব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবস্থা খারাপ নয়। হাতেগোনা কিছু প্রতিষ্ঠানের কারণে এ খাতে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান অনেক ভালো করছে। এখন দেখেশুনে ঋণ দিচ্ছে। আদায়ে জোর দেওয়া হচ্ছে, আগামীতে খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে জানান তিনি।
দেশের ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দুরবস্থা নতুন নয়। আর্থিক খাতের বহুল আলোচিত ব্যক্তি প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদার বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে যে অনিয়ম করেছেন, পুরো খাত এখন তার জের টানছে। পি কে হালদারের মালিকানা ও ব্যবস্থাপনায় ছিল এমন কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে খেলাপি ঋণের হার সবচেয়ে বেশি। পাশাপাশি এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্কিত অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানেও খেলাপি ঋণ বাড়ছে, যে কারণে সার্বিকভাবে এ খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েই চলেছে।
তথ্য বলছে, পি কে হালদার সংশ্লিষ্ট আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে পিপলস লিজিংয়ের খেলাপি ঋণের হার ৯৯ শতাংশ বা ১ হাজার ৯৬ কোটি টাকা, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি লিমিটেডের (বিআইএফসি) খেলাপির হার ৯৬ দশমিক ৮৫ শতাংশ বা ৭৪৩ কোটি টাকা, ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের খেলাপি ঋণ ৯৪ দশমিক ৭৬ শতাংশ বা ৩ হাজার ৯১২ কোটি টাকা। এ ছাড়া পি কে হালদার সংশ্লিষ্ট এফএএস ফাইন্যান্সের খেলাপি ঋণ ৮৯ দশমিক ৫৬ শতাংশ বা ১ হাজার ৬৪৫ কোটি টাকা ও আভিভা ফাইন্যান্সের খেলাপি ঋণ ৭১ দশমিক ৭২ শতাংশ বা ১ হাজার ৯০২ কোটি টাকা।
এর বাইরে ফারইস্ট ফাইন্যান্সের খেলাপি ঋণ ৯৪ দশমিক ৪১ শতাংশ, জিএসপি ফাইন্যান্সের ৯২ দশমিক ৩৭ শতাংশ, ফার্স্ট ফাইন্যান্সের ৮৯ দশমিক ৪১ শতাংশ, প্রিমিয়ার লিজিংয়ের ৬৬ দশমিক ৭৪ শতাংশ, সিভিসি ফাইন্যান্সের ৫৯ দশমিক ৩৯ শতাংশ, মেরিডিয়ান ফাইন্যান্সের ৫৯ দশমিক ১৭ শতাংশ, আইআইডিএফসির ৫৮ দশমিক ৬৪ শতাংশ, হজ ফাইন্যান্সের ৫৭ দশমিক ৭৯ শতাংশ, ফিনিক্স ফাইন্যান্সের ৫৭ দশমিক ৭৯ শতাংশ, ন্যাশনাল ফাইন্যান্সের ৫৬ দশমিক ৮৬ শতাংশ, বে লিজিংয়ের ৫২ দশমিক ৮২ শতাংশ ও উত্তরা ফাইন্যান্সের ৫০ দশমিক ৪৮ শতাংশ। এরপরই খেলাপি ঋণের তালিকায় আছে ইউনিয়ন ক্যাপিটাল, মাইডাস ফাইন্যান্স, ইসলামিক ফাইন্যান্স, প্রাইম ফাইন্যান্স, ইডকল ও লংকাবাংলা ফাইন্যান্স।
এদিকে এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আমানত বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৫ হাজার ১১৬ কোটি টাকায়। এর আগের প্রান্তিকে যা ছিল ৪৪ হাজার ৩০৪ কোটি টাকা। যদিও এই তিন মাসেই আর্থিক প্রতিষ্ঠান ছেড়েছেন সাড়ে ৪৮ হাজারের বেশি ব্যক্তি আমানতকারী।
দেশে প্রথম আর্থিক প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু হয় ১৯৮১ সালে আইপিডিসির মধ্য দিয়ে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশ ব্যাংক লাইসেন্স দিয়ে থাকে এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন ১৯৯৪-এর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করে। অর্থাৎ ব্যাংকগুলোর মতো ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর রেগুলেটরি বডি হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। দেশে বর্তমানে ৩৫টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান কাজ করছে।
এসআই/এসএসএইচ