যে কোনো পণ্য রপ্তানিতে ক্রেতাকে স্যাম্পল বা নমুনা পাঠাতে হয়। ক্রেতা সন্তুষ্ট হলেই আসে অর্ডার। কিন্তু বিদেশে স্যাম্পল বা নমুনা পাঠাতেই যদি ৪০০ কোটি টাকা চলে যায়, সেটাকে কী বলবেন?
যে কোনো পণ্য রপ্তানিতে ক্রেতাকে স্যাম্পল বা নমুনা পাঠাতে হয়। ক্রেতা সন্তুষ্ট হলেই আসে অর্ডার। কিন্তু বিদেশে স্যাম্পল বা নমুনা পাঠাতেই যদি ৪০০ কোটি টাকা চলে যায়, সেটাকে কী বলবেন?
সম্প্রতি এমন আজব একটি ঘটনা ধরা পড়েছে। কাস্টমসের অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সফটওয়্যারের ত্রুটির সুযোগ নিয়ে এক কিংবা দুই টাকা নয়, প্রায় ৪০০ কোটি টাকার পোশাক পণ্য রপ্তানি হয়েছে। সেক্ষেত্রে কোনো মুদ্রা দেশে ফেরত আসেনি। আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, কাতার, যুক্তরাজ্য, সৌদি আরব, নাইজেরিয়াসহ বিভিন্ন দেশে এ অর্থ পাচার হয়েছে।
জানা যায়, ২০২৩ সালে রপ্তানির আড়ালে এ টাকা পাচার করে চারটি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান। ১৭৮০টি চালানের মাধ্যমে তা পাচার হয়েছে বলে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের প্রাথমিক তদন্তে উঠে এসেছে। বিষয়টির অধিকতর তদন্তের জন্য কাস্টমস গোয়েন্দা ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সমন্বয়ে টিম গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে যৌথ টিম গঠনের কাজ শুরুও হয়েছে।
বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনতে গঠিত জাতীয় টাস্কফোর্সের দশম সভায় এ সিদ্ধান্ত হয় বলে জানা গেছে। জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত ওই সভায় কাস্টমসের অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সফটওয়্যারের বিভিন্ন ত্রুটি নিয়েও আলোচনা হয়েছে। ওই ত্রুটির কারণে পণ্য রপ্তানির আড়ালে অর্থপাচার হয়েছে। ত্রুটি নিরসনে সফটওয়্যার নিয়মিত আপডেট করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ ছাড়া অনিয়ম রোধে চট্টগ্রাম বন্দরের এক্সিট গেটে আইন প্রয়োগকারী ও গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারি বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ে ‘বিদেশে পাচারকৃত সম্পদ বাংলাদেশে ফেরত আনার বিষয়ে গঠিত টাস্কফোর্স’-এর ওই সভার সভাপতিত্ব করেন সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল আবু মোহাম্মদ আমিন উদ্দিন। যেখানে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার ১৭ জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন।
সভায় টাস্কফোর্স সংক্রান্ত কমিটির প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন। সেখানে ১৩টি বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। যার মধ্যে একটি হলো- রপ্তানির আড়ালে চারটি প্রতিষ্ঠানের ৪০০ কোটি টাকা পাচারের ঘটনায় যৌথ অনুসন্ধান করা। কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর এবং দুদক যৌথভাবে বিষয়টি অনুসন্ধান করবে।
প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- সাবিহা সাকি ফ্যাশন, এশিয়া ট্রেডিং কর্পোরেশন, ইমু ট্রেডিং কর্পোরেশন ও ইলহাম কর্পোরেশন।
এ বিষয়ে শুল্ক গোয়েন্দার ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রথমে সাবিহা সাকি ফ্যাশন নামের প্রতিষ্ঠানের জালিয়াতির বিষয়টি উদ্ঘাটন হয়। এরই ধারাবাহিকতায় আরও তিন প্রতিষ্ঠানের অর্থপাচারের তথ্য পাওয়া যায়। তাদের কোনো এলসি ছিল না, রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের ইএক্সপি ব্যবহার করেছে। প্রতিষ্ঠান চারটির বিগত সময়ের ১৭৮০টি চালানের বিপরীতে ১৮ হাজার ২৬৫ টন পণ্য রপ্তানি দেখানো হয়েছে। যার ঘোষিত মূল্য তিন কোটি ৭৮ লাখ ১৭ হাজার ১০ মার্কিন ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা দাঁড়ায় ৩৮২ কোটি টাকা। আমাদের ধারণা, অর্থের পরিমাণ ৪০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
‘যখন কোনো জালিয়াত চক্র অর্থপাচারের উদ্দেশ্য রপ্তানি করে, তখন তার উদ্দেশ্যই থাকে রপ্তানি মূল্য কোনোভাবেই দেশে না আনা। সেক্ষেত্রে তারা পণ্যের মূল্য কোনো না কোনোভাবে কম দেখানোর চেষ্টা করে। তার প্রধান লক্ষ্যই হলো টাকা বিদেশে পাচার করা। বৈদেশিক মুদ্রা বৈধ পন্থায় দেশে প্রত্যাবাসিত হওয়ার কোনো সুযোগ না থাকায় মানিলন্ডারিং সংঘটিত হয়েছে, এটার প্রমাণও মিলেছে।’
জানা যায়, সাবিহা সাকি ফ্যাশন মোট ৮৬টি চালানের বিপরীতে ৯৯৭ টন পণ্য রপ্তানি করেছে। যার মধ্যে রয়েছে- মেন্স ট্রাউজার, টি-শার্ট, বেবি সেট, ব্যাগ, পোলো শার্ট, জ্যাকেট, প্যান্ট ও হুডি রপ্তানি। এর বিনিময় মূল্য ১৮ লাখ ৪৫ হাজার ৭২৭ মার্কিন ডলার বা ২১ কোটি টাকা।
প্রতিষ্ঠানটির টি-শার্ট ও লেডিস ড্রেস রপ্তানির কথা থাকলেও বেবি ড্রেস, জিন্স প্যান্ট, লেগিন্স, শার্ট ও শালসহ ঘোষণাবহির্ভূত পণ্য রপ্তানির প্রমাণ পাওয়া গেছে। এসব পণ্য সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, সৌদি আরব ও নাইজেরিয়ায় রপ্তানি করা হয়েছে।
এশিয়া ট্রেডিং কর্পোরেশন এক হাজার ৩৮২টি চালানের মাধ্যমে পণ্য রপ্তানি করেছে। ১৪ হাজার ৮৫ টন টি-শার্ট, টপস ও লেডিস ড্রেস রপ্তানি করেছে। যার বিনিময় মূল্য দুই কোটি ৫৮ লাখ ২৬ হাজার ৮৬৬ মার্কিন ডলার বা ২৮২ কোটি টাকা।
ইমু ট্রেডিং কর্পোরেশন ২৭৩টি পণ্যের চালান রপ্তানি করেছে। প্রতিষ্ঠানটি দুই হাজার ৫২৩ টন টি-শার্ট, ট্রাউজার ও টপস রপ্তানি করেছে, যার বিনিময় মূল্য ৬৫ লাখ চার হাজার ৯৩২ মার্কিন ডলার বা ৬২ কোটি টাকা।
ইলহাম কর্পোরেশন ৩৯টি চালান রপ্তানি করেছে। ৬৬০ টন টি-শার্ট, ট্যাংক টপ, লেডিস ড্রেস রপ্তানি করেছে, যার বিনিময় মূল্য ১৬ লাখ ৩৯ হাজার ৪৮৫ মার্কিন ডলার বা ১৭ কোটি টাকা।
কাস্টমস ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের প্রাথমিক তদন্তে আরও দেখা যায়, চারটি প্রতিষ্ঠান বিল অব এক্সপোর্টে দিনের পর দিন ব্যবহার করেছে ভুয়া এলসি আর ইএক্সপি নম্বর। এ ছাড়া কোন কোন ক্ষেত্রে রপ্তানিকারক ছিলেন এক ব্যাংকের গ্রাহক, আর এলসি ও ইএক্সপি ছিল অন্য ব্যাংকের। অথবা রপ্তানিকারক সংশ্লিষ্ট ব্যাংকেরই গ্রাহক। কিন্তু ব্যবহার করা হয়েছে অন্য গ্রাহকের এলসি আর ইএক্সপি নম্বর। বিল অব এক্সপোর্টের হার্ড কপি আর কাস্টমস সার্ভারের তথ্যেও মিলেছে বিরাট ফারাক। যার অন্যতম রপ্তানিকারকের নামের ভিন্নতা। গরমিল আছে ন্যাচার অব ট্রানজেকশন, সিপিসি কোড আর ইউডিতেও।
টাস্কফোর্সের দশম সভায় উপস্থিত কাস্টমসের গোয়েন্দা প্রতিনিধি জানান, অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সফটওয়্যারের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ওই টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। তবে, সভায় সিআইডি প্রতিনিধি উল্লেখ করেন, অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সফটওয়্যারে বিভিন্ন ত্রুটি রয়েছে। এ বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। সিআইডি এ সফটওয়্যারের ত্রুটিসমূহ সংশোধনের বিষয়ে এনবিআরকে অনুরোধ করেছিল। সফটওয়্যারটি নির্দিষ্ট সময় পরপর পর্যালোচনাপূর্বক ত্রুটিসমূহ চিহ্নিত করে সেগুলো দূরীকরণের বিষয়ে উদ্যোগ নিতে বলেন গোয়েন্দা ওই কর্মকর্তা।
তিনি আরও জানান, চট্টগ্রাম বন্দর হতে আমদানি করা পণ্য খালাসের ক্ষেত্রে ‘এক্সিট’ গেটে শুধুমাত্র বন্দরের নিরাপত্তাকর্মীরা দায়িত্ব পালন করেন। এক্ষেত্রে এক্সিট গেটে বন্দরের নিরাপত্তাকর্মীর পাশাপাশি অন্যান্য আইন-প্রয়োগকারী ও গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারি নিশ্চিত করা গেলে আমদানির ক্ষেত্রে অনিয়ম অনেকাংশে রোধ করা সম্ভব। আলোচনা শেষে সভাপতি অ্যাসাইকুডা সফটওয়্যারটি নিয়মিতভাবে আপডেট ও চট্টগ্রাম বন্দরের এক্সিট গেটে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থাসমূহের সমন্বয়ে নজরদারির প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের জন্য এনবিআর ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেওয়ার বিষয়ে মত দেন। চিঠির খসড়াটি প্রস্তুতের ক্ষেত্রে তিনি বিএফআইইউকে সংশ্লিষ্ট সংস্থাসমূহ হতে প্রয়োজনীয় পরামর্শ গ্রহণের বিষয়ে নির্দেশনা দেন।
অপরদিকে, সভায় দুদকের একজন মহাপরিচালক ও উপপরিচালক কাস্টমস গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে ওই চার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিং মামলা দায়ের করা হয়েছে কি না, তা জানতে চান। কাস্টমস গোয়েন্দা প্রতিনিধি জানান, কাস্টমস আইনে মামলা দায়ের করা হলেও মানিলন্ডারিং মামলা দায়েরের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। যেহেতু এ ধরনের মামলায় সাধারণত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংশ্লিষ্টতা থাকে, সেহেতু যৌথ তদন্তকারী দল গঠনের বিষয়ে পরামর্শ দেয় দুদক টিম।
সভায় যেসব মামলায় একাধিক সংস্থার শিডিউলভুক্ত অপরাধের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায় সেসব মানিলন্ডারিং মামলা দায়েরের আগে যৌথ অনুসন্ধান দল গঠনের জন্য বিএফআইইউকে অনুরোধ করার বিষয়ে নির্দেশনা প্রদান করা হয়।
আরএম/