সেই প্রধান শিক্ষকের অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তের নির্দেশ

সেই প্রধান শিক্ষকের অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তের নির্দেশ

নীলফামারীর ডোমারের হরিণচড়া ইউনিয়নের আটিয়াবাড়ী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হায়াতুল আলমের বিরুদ্ধে চাকরির পাশাপাশি ঠিকাদারি এবং প্রতিবন্ধী-অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের বরাদ্দ, নিয়োগ বাণিজ্য, বিদ্যালয়ের বাউন্ডারি ও মাঠ সংস্কারের টাকা আত্মসাতের অভিযোগের বিষয়ে তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

নীলফামারীর ডোমারের হরিণচড়া ইউনিয়নের আটিয়াবাড়ী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হায়াতুল আলমের বিরুদ্ধে চাকরির পাশাপাশি ঠিকাদারি এবং প্রতিবন্ধী-অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের বরাদ্দ, নিয়োগ বাণিজ্য, বিদ্যালয়ের বাউন্ডারি ও মাঠ সংস্কারের টাকা আত্মসাতের অভিযোগের বিষয়ে তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

সোমবার (২১ অক্টোবর) ডোমার উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসের একাডেমিক সুপারভাইজার সাফিউল ইসলামকে সরেজমিনে তদন্তপূর্বক সুস্পষ্ট মতামতসহ প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) ও আটিয়াবাড়ী উচ্চ বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি নাজমুল আলম।

এর আগে আটিয়াবাড়ী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হায়াতুল আলমের বিরুদ্ধে চাকরির পাশাপাশি ঠিকাদারি, প্রতিবন্ধী-অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের বরাদ্দ, নিয়োগ বাণিজ্য, বিদ্যালয়ের বাউন্ডারি ও মাঠ সংস্কারের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ নিয়ে ‘প্রধান শিক্ষকই ঠিকাদার, অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশ করে অনলাইন গণমাধ্যম ঢাকা পোস্ট। এই সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হায়াতুল আলমের অনিয়ম ও দুর্নীতি সংক্রান্ত অভিযোগের তদন্ত করে মতামতসহ প্রতিবেদন পাঠানোর জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়।

উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) ও আটিয়াবাড়ী উচ্চ বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি নাজমুল আলমের স্বাক্ষরিত একটি চিঠিতে বলা হয়েছে, গত ১০ অক্টোবর আটয়াবাড়ী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হায়াতুল আলমের বিরুদ্ধে বিদ্যালয়ে চাকরির পাশাপাশি ঠিকাদারি, প্রতিবন্ধী ও অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের বরাদ্দের টাকা আত্মসাৎ, নিয়োগ বাণিজ্য, বিদ্যালয়ের বাউন্ডারি ও মাঠ সংস্কারের টাকা আত্মসাতসহ নানা অভিযোগের একখানা সচিত্র প্রতিবেদন ঢাকা পোস্ট সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এমতাবস্থায় প্রাপ্ত পত্রিকার সচিত্র প্রতিবেদনটি প্রেরণ এবং এ বিষয়ে আগামী ৭ (সাত) কার্যদিবসের মধ্যে সরেজমিনে তদন্তপূর্বক সুস্পষ্ট মতামতসহ প্রতিবেদন পাঠানোর জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।

সরেজমিনে জানা যায়, ডোমার উপজেলার হরিণচড়া ইউনিয়নের আটিয়াবাড়ী গ্রামের চারপাশে ১০ থেকে ১২ কিলোমিটারের মধ্যে কোনো মাধ্যমিক বিদ্যালয় না থাকায় তৎকালীন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম ও অধ্যাপক নুরুল ইসলাম এবং স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের সহযোগিতায় ১৯৯২ সালে আটিয়াবাড়ী উচ্চ বিদ্যালয়টি স্থাপন করা হয়। বিদ্যালয়টি ২০০০ সালে মাধ্যমিক স্কুল হিসেবে এমপিওভুক্ত হয়। বর্তমানে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৭৫৬ জন। ১৯৯৫ সালের ১৯ অক্টোবর ওই বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন হায়াতুল আলম।

নীতিমালা অনুযায়ী এমপিওভুক্ত কোনো শিক্ষক-কর্মচারী একইসঙ্গে একাধিক কোনো পদে/চাকরিতে বা আর্থিক লাভজনক কোনো পদে সম্পৃক্ত থাকার নিয়ম নেই। তবে এই নিয়মকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছেন হায়াতুল আলম। সুকৌশলে উচ্চ মাধ্যমিক পড়ুয়া ছেলের নামে ‘মেসার্স ফাহিম এন্ড হুমা ট্রেডার্স’ নামের একটি সরকার নিবন্ধিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেন তিনি। বিদ্যালয়ের ক্লাস চলাকালীন ঠিকাদারি কাজেই বেশির ভাগ সময় ব্যস্ত থাকতে দেখা যায় তাকে। বর্তমানে ডোমার সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও চিলাহাটিতে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভবন নির্মাণের কয়েক কোটি টাকার কাজ করছেন তিনি।

স্থানীয় বাসিন্দা ও অভিভাবকদের অভিযোগ, ব্যবসায়িক কাজে ব্যস্ততার কারণে বিদ্যালয়ে সময় দিতে পারেন না প্রধান শিক্ষক হায়াতুল আলম। প্রধান শিক্ষকের এমন দ্বায়িত্ব অবহেলায় পড়ালেখার আগ্রহ হারাতে বসেছে ছাত্র-ছাত্রীরা। তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে বিদ্যালয়টির শিক্ষার পরিবেশ দ্রুত ফিরিয়ে আনার দাবি জানিয়েছেন অভিভাবকরা।

এদিকে গেল বছর বিদ্যালয়ের প্রতিবন্ধী ও অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের জন্য অনুদানসহ বিভিন্ন খাতে এককালীন বরাদ্দ হয়েছিল প্রায় ৫ লাখ টাকা। এতে নিয়ম অনুযায়ী প্রতি শিক্ষার্থী ৫ হাজার টাকা করে পাবে। তবে কোনো শিক্ষার্থীকে ২ হাজার ৫০০ টাকা আবার কোনো শিক্ষার্থীকে টাকা না দিয়েই প্রধান শিক্ষক ও বিদ্যালয়টির পরিচালনা কমিটির সাবেক সভাপতি ফিরোজ আল মামুন মোটা অঙ্কের অর্থ আত্মসাৎ করেন। বিদ্যালয়ের টিউশন ফি প্রতিবছর গড়ে ২ লাখ টাকা করে বরাদ্দ পায়। নিয়ম হলো এই টাকার একটি অংশ শিক্ষক, কর্মচারীরা স্কেল অনুযায়ী পাবেন। বাকিটা স্কুলের উন্নয়নকাজে ব্যবহার হবে। বছরে দুইবার পাওয়ার কথা থাকলেও তা দেওয়া হয় কালেভদ্রে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিদ্যালয়ের বাউন্ডারি নির্মাণ ও মাঠ সংস্কারে ৫ লাখ টাকা বরাদ্দ পায়। তবে নামমাত্র কাজ করে পুরো টাকা আত্মসাৎ করেন প্রধান শিক্ষক হায়াতুল আলম ও সভাপতি ফিরোজ। ২০২৩ সালে বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক, পরিচ্ছন্নকর্মী, অফিস সহায়ক ও পিয়ন পদে নিয়োগ হয়। প্রতিটি পদের জন্য ১১ থেকে ১৩ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে সভাপতি ও প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট, অফিস সহকারী পদে দুই থেকে তিনজনের আগাম টাকা নিয়ে রেখেছেন প্রধান শিক্ষক ও সভাপতি।

স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল মজিদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘স্কুলের মাঠে মাটি ফেলার কথা ছিল ১০০ ট্রলি অথচ ৮-৯ ট্রলি মাটি ফেলে হেডমাস্টার ও সভাপতি পুরো টাকা মেরে দিয়েছেন। কিছু নিয়োগ হইছিল, সেখানে ৭০ লাখ টাকার লেনদেন হয়েছে। কোনো পরীক্ষা ছাড়াই এসব নিয়োগ হয়েছে। বরাদ্দ এলে বিদ্যালয়ের বাউন্ডারির কাজও করা হয় নাই। হেডমাস্টার ঠিকমতো স্কুলে থাকেন না। উনি ঠিকাদারি কাজে ব্যস্ত থাকেন বেশি সময়। এভাবে স্কুলের লেখাপড়ার মান নষ্ট হচ্ছে। রেজিস্ট্রেশনের সময় অন্য স্কুলের তুলনায় ২০০ থেকে ৩০০ টাকা বেশি নেওয়া হয়। আমরা চাই আমাদের এলাকার স্কুলে লেখাপড়ার মান যেন ভালো হয় এবং শিক্ষকরা যেন সময়মতো স্কুলে আসেন। এতদিন যা দুর্নীতি হয়েছে এগুলোর প্রতিকার চাই।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক অভিভাবক ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘কিছুদিন আগে মাঠে সাত-আট ট্রলি মাটি ফেলেছিল। তারপর সভাপতি বলেছিলেন, এখানে ৯০ ট্রলি মাটি ফেলা হইছে। পরে প্রতিবাদ করার পরও কোনো কাজ হয় নাই। ওরা আওয়ামী লীগের লোক, ওরা যা বলেছে সেটাই সঠিক। বাউন্ডারি দেওয়ার কথা ছিল, অল্প একটু দিছে তারপর নাকি টাকা শেষ হয়ে গেল। এদিকে আবার স্কুলের ঘরও চলে না। সরকারি যত বাজেট আসে সব প্রধান শিক্ষক আর সভাপতির পকেটে ঢুকে। এদিকে হেডমাস্টার আবার ঠিকাদারি করে বেড়াচ্ছে। তাহলে স্কুলে সময় কখন দেয়? ঠিকাদারি করবে না স্কুলে সময় দিবে।’

স্থানীয় বাসিন্দা মাহবুবার রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘একজন প্রধান শিক্ষক ঠিকাদারি করলে স্কুলে কখন সময় দেবে? এটা তার ঠিক হচ্ছে না। কারণ স্কুলের শিক্ষার্থীদের তো দেখাশোনার দায়িত্ব তার। অন্যান্য শিক্ষকরা ক্লাস করাচ্ছেন কি না সেটাও তদারকির দায়িত্ব তার। উনি কোন সময়ে স্কুলে সময় দেবে আর কোন সময়ে ঠিকাদারি করবে- এটা আমার বুঝে আসছে না। আমার কাছে মনে হচ্ছে, উনার ঠিকাদারি করা উচিত না।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রতিষ্ঠানটির এক শিক্ষক ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘গত ৫ আগস্টের পর থেকে উনি স্কুলে এলেও আগে কখনোই স্কুলে সময় দিতেন না। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর থেকে কিছুটা সময় দিতে শুরু করেছেন। শিক্ষকতা নয় উনার মূল পেশা ঠিকাদারি। সহকারী শিক্ষকসহ বিভিন্ন পদের নিয়োগে যে অর্থ বাণিজ্য ও অনিয়মের অভিযোগ, এটি এক প্রকার ওপেন সিক্রেট। কেউ নাই যে এসব বিষয়ে জানে না। যাকেই জিজ্ঞেস করবেন সেই আপনাকে সব বলে দেবে। নিয়োগের সময় লোক দেখানো নামমাত্র পরীক্ষা হয়েছে। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি এমনভাবে দেওয়া হয়েছে যাতে কেউ আবেদন করতে না পারেন। শিক্ষকদের টিউশন ফিও তিনি আত্মসাৎ করেছেন। বিদ্যালয়ের সাবেক সভাপতি ফিরোজ আল মামুনের যোগসাজশে এসব তিনি করেছেন। স্কুলের শিক্ষক হয়েও আমরা এ বিষয়ে প্রতিবাদ করতে পারিনি।’

শরিফুল ইসলাম/এমজেইউ   

Visit Source Page

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *