সিংহবাহিনী দেবী দুর্গা

সিংহবাহিনী দেবী দুর্গা

…ভক্তদের হৃদয় মন্দিরের প্রতিমা কিন্তু অটুটই থাকবে। শত কণ্ঠে তারা এবারও গাইবেন—‘মধুকৈটভবিধ্বংসি বিধাতৃবরদে নমঃ। রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি’।

বেশ খানিকটা বদলে যাওয়া রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এবার বাংলাদেশে পুনরায় আসছে প্রতি শরতের দুর্গাপূজা। নানা আশঙ্কা-উদ্বেগের ভেতরেও ভালোবাসার অঞ্জলিতে মৃন্ময়ীর মাঝে চিন্ময়ীর আবাহনে উদ্যোগী হবেন ভক্তরা।

যদি সেই মৃন্ময়ী বিগ্রহ ভেঙে টুকরোও হয়, তবু ভক্তদের হৃদয় মন্দিরের প্রতিমা কিন্তু অটুটই থাকবে। শত কণ্ঠে তারা এবারও গাইবেন—‘মধুকৈটভবিধ্বংসি বিধাতৃবরদে নমঃ। রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি’।

দুর্গাকে নিয়ে বাংলা ও বাঙালির আবাহনের শেষ নেই। কিন্তু সিংহবাহিনী, গৌর বর্ণা এই দেবী কি পৃথিবীর আরও নানা সভ্যতায় ভিন্ন ভিন্ন রূপে দেখা দেন বা দিয়েছেন? 

প্রাচীন গ্রিসে রিয়াহ নামে যে দেবীর কথা বলা হচ্ছে, তাকে সিংহের পাহারায় এক সিংহাসনে উপবিষ্টা দেখা যায়। রিয়াহ ছিলেন পৃথিবী দেবী গাইয়া এবং আকাশের দেবতা ইউরেনাসের পুত্র। দেবতা বা টাইটান ক্রোনাসের বড় বোন এবং সঙ্গিনী রিয়াহ ছয় দেব-দেবী হেস্তিয়া, দেমেতার, হেরা, পোসেইদন, জিউস এবং হেদসের মা।

এই একই দেবীকে আনাতোলিয়া অঞ্চলে আবার ‘সিবিলিবা’ ধরিত্রী দেবী বলেও ডাকা হয়। ফ্রিজিয়ান ভাষায় তাকে ‘মাতার কুবিলেইয়া’ বা ‘মাউন্টেইন মাদার’ বলেও ডাকা হতো। গ্রিক ঔপনিবেশিকরা এশিয়া মাইনরে তার বিগ্রহ পান এবং খ্রিষ্ট-পূর্ব ষষ্ঠ শতকে এই দেবীকে নিজেদের বহু দেব-দেবীর ধর্মে আত্মস্থ করেন। 

উল্লেখ্য, আমাদের দুর্গারও আরেক নাম কিন্তু ‘পার্বতী’। কৈলাস পর্বত থেকেই তিনি প্রতি বছর মর্ত্যে আসেন। তাই তাকে আমরা ‘পার্বতী’ বলে ডাকি। আর আনাতোলিয়ার ‘মাতার কুবিলেইয়া’, দেবী সিবিলিও ছিলেন সিংহবাহিনী।

ব্যাবিলনের দেবী ইশতারের প্রতীকও সিংহ—তিনিও সিংহ পরিবেষ্টিতা। ব্যাবিলনে আজও দেবী ইশতারের দুয়ারে সিংহ ভাস্কর্য রয়েছে। আবার ব্যাবিলনের নিকটবর্তী জনপদের সুমেরীয় দেবী ইনান্নার সাথেও যেন ইশতারের মিল রয়েছে। দুজনেই সিংহবাহিনী।

মজার বিষয় হলো ভারতে যেমন দুর্গাসহ সব দেবী বা মাতৃশক্তির আরাধনাই তার উর্বরতা শক্তির পূজা, ব্যবিলন-সুমেরীয় অঞ্চলেও ইশতার বা ইনান্নার পূজা শুরু হয়েছিল নারীর উর্বরতা শক্তির পূজা হিসেবেই। একই সাথে তিনি যুদ্ধ ও ভালোবাসারও দেবী।

মূলত নারীই পৃথিবীতে নয় মাসের গর্ভধারণ এবং অনিঃশেষ প্রসব যন্ত্রণা সয়ে নতুন প্রাণ আনে। নারীর এই ‘আদি শক্তি’-কে সম্মান জানাতেই পৃথিবীর নানা প্রান্তে সূচনা হয়েছিল ‘মাতৃ উপাসনা’ তথা ‘দেবী উপাসনা’-র।

তবে ব্যাবিলনের দেবী ইশতার চরিত্রে রয়েছে বৈপরীত্য। তিনি একইসাথে আগুন সৃষ্টি করেন এবং আগুন থামিয়ে দেন, উল্লাস করেন ও কাঁদেন, ন্যায়পরতার প্রতীক এবং বৈরীকে রুদ্র রোষে ধ্বংস করতেও দ্বিধা করেন না। আমাদের দুর্গারই অপর মূর্তি যেমন কালী করালবদনী—তেমনটাই।

ব্যাবিলনের দেবী ইশতার আবার সমাজের সবচেয়ে অবহেলিত অংশের নারী বা জনপদ বধূদের রক্ষাকর্ত্রী ছিলেন। খুব বিষ্ময়করভাবে হলেও আমাদের দুর্গা পূজাতেও পতিতালয়ের মৃত্তিকা প্রয়োজন হয়। এ নিয়ে বহু প্রশ্ন বা বিতণ্ডা থাকলেও, সমাজের সবচেয়ে বঞ্চিত বা অবহেলিত অংশকে সম্মান জানাতে বা আজকের দিনে যাকে ‘social inclusivity’ বা ‘সামাজিক অন্তর্ভুক্তি’ বলা হয়—তেমন কোনো সামাজিক অন্তর্ভুক্তির দৃষ্টিকোণ থেকেই হয়তো এমন রীতির প্রচলন হয়েছিল। 

মানবীর দেহ আর সিংহীর মুখের মিশরীয় দেবী সেখমেটও ঠিক আমাদের দুর্গার মতোই। সূর্য দেবতা পিতারা তার বিরুদ্ধে চক্রান্তরত কিছু মানবের সাথে সেখমেটকে যুদ্ধ করতে পাঠালে তিনি এত ভয়ানক যুদ্ধ শুরু করেন যে গোটা মিশর ধ্বংস হওয়ার উপক্রম হয়। তখন সেখমেটের পিতা ডালিমের রসের সাথে লাল মৃত্তিকার গুঁড়ো মিশিয়ে তাকে পান করতে দিলে তিনি রস পান করে শান্ত হয়ে বাড়ি ফেরেন।

আমাদের মহিষাসুরমর্দ্দিনী-তে আবার দেবী দুর্গা যুদ্ধের এক পর্যায়ে মধু পান করে পুনরায় রণে ঝাঁপিয়ে পড়ার সঙ্কল্প ব্যক্ত করেন। মিশরীয় পুরাণে সেখমেট যুদ্ধ ও আরোগ্যের দেবী। বাংলা ও ভারতের দুর্গা-বন্দনায় যেমন বলা হয়, ‘দেহি সৌভাগ্যমারোগ্যং দেহি দেবী পরং সুখং’। সৌভাগ্য ও আরোগ্যের জন্যও তার কাছেই প্রার্থনা করা হয়। 

পারস্যের দেবী আনাহিতাও দুর্গার মতোই বা ভারতীয় দেবীদের মতোই ‘উর্বরতার দেবী’। তিনি নারীর জরায়ু, পুরুষের বীর্যকে শুদ্ধ করেন এবং নবজাতক-জাতিকাদের জন্য মাতৃ-দুগ্ধের প্রবাহ নিশ্চিত করেন। মৃত্তিকা ও শস্যের উর্বরতা এবং মানব ও পশুকে সুরক্ষাদায়িনী সব শস্যের উর্বরতাও তিনিই নিশ্চিত করেন। পারস্যের এই আনাহিতা এক সুন্দরী তবে শক্তিশালী কুমারী।

পারস্যে ‘আনাহিতা’-র উদ্ভবও ব্যাবিলনের ইশতারের সূত্র ধরে হলেও তিনি সিংহবাহিনী ছিলেন কি না সেটা স্পষ্ট নয়। তবে ‘বেদ’-এর সহোদরা গ্রন্থ আবেস্তায় ‘অবন’ (প্রাচীন পারসিকে অবন শব্দের অর্থ জল যা সংস্কৃতে ‘অপ’) বা জলের দেবী আনাহিতার  প্রতীক ‘নীলুফার’ বা ‘নীল পদ্ম’। স্লাভ দেশীয় পুরাণে আনাহিতা-ই আবার ‘মাটি সিরা জেমলিয়া’ বা ‘স্যাঁতসেঁতে মৃত্তিকা মা’  হিসেবে বিধৃত।

খ্রিষ্টধর্মে মাতা মেরীর স্তব ‘Ave Maria’ লাতিনে যখন গাওয়া হয় ‘Ave Maria, gratia plena, Dominus tecum/Benedicta tu in mulieribus/et benedictus fructus ventris tui, Iesus/Sancta Maria, Mater Dei’, সে যেন ‘রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি’ স্তোত্রেরই অন্যতর কোনো রূপ।

অদিতি ফাল্গুনী ।। উন্নয়নকর্মী, কবি, কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক

 

Visit Source Page

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *