ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চলে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতে শ্রীলঙ্কাকে পাশে রাখতে মরিয়া সব বৃহৎ শক্তিগুলো। অনেকটা স্নায়ুযুদ্ধের মতো তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা। সব পক্ষই শ্রীলঙ্কাকে আপন করে নিতে চায় নিজেদের স্বার্থে।
শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করে জয়ের মুকুট ছিনিয়ে নিলেন অনুরা কুমারা দিশানায়েকে। এতদিন ধরে যে রাজনৈতিক সংগঠন দ্বীপরাষ্ট্রের রাজনীতিতে দুর্বল তথা প্রান্তিক অবস্থায় ছিল, সেই দলের প্রার্থী জেতায় অবাক হয়েছে অনেকেই।
ভোট কুশলীরাও শেষমেশ ব্যর্থ হয়েছে ফলাফল আঁচ করতে। তিনি আর কেউ নন শ্রীলঙ্কার বামপন্থী দল জনতা ভিমুক্তি পেরামুনার (JVP) দলের তরুণ নেতা। রাজনীতিতে তরুণ হলেও বয়স কিন্তু তার ৫৫। বিশ্ব রাজনীতিতে চমক দেখিয়ে তিনি শুধু নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করলেন না বরং শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে নতুন রঙের প্রলেপও দিলেন।
ইতিহাস রচনা করলেন দক্ষিণ এশীয় রাজনীতির নয়া সমীকরণের। বারবার দাবার গুটিতে খেলতে থাকা শ্রীলঙ্কার জনগণের ভবিষ্যৎ নির্ধারক হয়ে প্রমাণ করলেন কত বড় পাকা খেলোয়াড় তিনি।
বছর দুয়েক আগে বিশ্বের কাছে উদ্বেগের বিষয় হয়ে উঠেছিল শ্রীলঙ্কা। চরমে উঠেছিল তাদের আর্থিক সংকট। তার ওপর বিপুল অঙ্কের ঋণের বোঝা। সবকিছু সামলাতে হিমশিম খেয়েছিল তৎকালীন সরকার। খাদ্যসামগ্রী থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস, সবকিছুর দাম ছিল আকাশছোঁয়া। তাই সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ জমতে জমতে একদিন গণআন্দোলনের বিস্ফোরণ ঘটে সেখানে।
মুহূর্তেই জনগণের আক্রোশ ও গণঅভ্যুত্থানে পতন ঘটে সে দেশের সরকারের। দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি গোতাবায়া রাজাপাকসে এবং প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে। এরপর ক্ষমতায় এসে দেশের অর্থনীতি ঠিক করতে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেন ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টির নেতা রনিল বিক্রমাসিংহে।
পাশাপাশি ক্ষমতায় ফিরে ভারতের সাথে বন্ধুত্ব ও মজবুত করতে শুরু করেন তিনি। হয়ে ওঠেন তথাকথিত ভারত বন্ধু। অন্যদিকে বিরোধী দলীয় নেতা সাজিথ প্রেমাদাসা মধ্যপন্থী রাজনীতি দিয়ে বরাবরই ছিলেন চীন ঘনিষ্ঠ। চীনা ঋণ ও প্রকল্প নিয়ে বড় ক্ষোভ যেমন আছে শ্রীলঙ্কাতে তেমনি ভারতের আধিপত্যবাদ নীতিতে রয়েছে জনগণের তীব্র অসন্তোষ।
এশিয়ার সবচেয়ে পরাক্রমশালী দুই বড় শক্তি হলো ভারত ও চীন। এই দুই দেশের অধীনে তটস্থ থাকে দক্ষিণ এশিয়ার ছোট ছোট দেশগুলো। দীর্ঘদিন এই জনপদে সুদৃঢ় রাজত্ব তৈরি করে বাণিজ্য বলয় সৃষ্টি করেছে তারা। আপাত দৃষ্টিতে তাদের মধ্যে রয়েছে চির প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক সম্পর্ক কিন্তু বাণিজ্যিক সম্পর্ক আবার মধুর।
ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চলে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতে শ্রীলঙ্কাকে পাশে রাখতে মরিয়া সব বৃহৎ শক্তিগুলো। অনেকটা স্নায়ুযুদ্ধের মতো তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা। সব পক্ষই শ্রীলঙ্কাকে আপন করে নিতে চায় নিজেদের স্বার্থে।
এই দুই দেশ ছোট দেশগুলোর যেকোনো ইস্যুতে মাথা ঘামানোর পাশাপাশি সরাসরি আঞ্চলিক রাজনীতিতেও হস্তক্ষেপ করে। এক কথায় বলা চলে বৈশ্বিক রাজনীতিতে ভারত ও চীনা ফ্যাক্টর বা প্রভাব। ছোট দেশগুলোকে একরকম বাধ্য করে তাদের অনুকূলে রাখতে। নানাবিধ চাপ প্রয়োগ করে যুগের পর যুগ সুকৌশলে বানিয়ে রাখে তাদের অনুগত ও আজ্ঞাবহ।
বৈশ্বিক রাজনীতিতে শ্রীলঙ্কা ছিল বরাবরই আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। তার কারণ ও কিন্তু সবার অজানা নয়। ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থান ও সমুদ্র বন্দর। শ্রীলঙ্কার সমুদ্র বন্দর বরাবরই কাছে টেনেছে বৃহৎ শক্তিগুলো। আবার হাম্বানটোটা বন্দর চীনকে ইজারা দিয়ে খেসারতও দিচ্ছে এখন তারা।
ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চলে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতে শ্রীলঙ্কাকে পাশে রাখতে মরিয়া সব বৃহৎ শক্তিগুলো। অনেকটা স্নায়ুযুদ্ধের মতো তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা। সব পক্ষই শ্রীলঙ্কাকে আপন করে নিতে চায় নিজেদের স্বার্থে। বর্তমান সময়ে শ্রীলঙ্কার যে চরম অর্থনৈতিক দুর্দশা এর জন্য অনেকটাই দায়ী কিন্তু বৈশ্বিক শক্তিগুলো। তারা নিজেদের প্রয়োজনে নিজেরাই শ্রীলঙ্কার সাথে রাজনীতি করেছে। ঋণের নামে দেশকে পঙ্গু বানিয়েছে। মাথা উঁচু করে দাঁড়াতেও প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেছে।
এবারের নির্বাচনের ফলাফল বৈশ্বিক রাজনীতির সব হিসাব-নিকাশকে পাল্টে দিয়েছে। ভারত বা চীন—এই দুই দেশের ঘনিষ্ঠ নেতাদেরই বাতিল করে দিয়েছে শ্রীলঙ্কার আমজনতা। ধুঁকতে থাকা অর্থনীতির বেহাল দশা থেকে দেশকে টেনে তুলতে তারা ভরসা রেখেছেন বামপন্থী নেতা দিশানায়কের ওপরে। জনগণ প্রমাণ করে দিলেন তারাই হলেন শ্রীলঙ্কার শেষ কথা। তাদের হাতে শক্তি আছে দেশপ্রেমিক কাউকে ক্ষমতায় বসানোর।
জনগণ আসলে এই দুই দেশের বলয়ের বাইরে গিয়ে দিশানায়েকে মতো একজন প্রকৃত খাঁটি নেতা বেছে নিয়ে তার হাতকে শক্তিশালী করেছেন। তাই তো দিশানায়েকে জয়ের পরে এক্স হ্যান্ডলে লিখেছেন, ‘কয়েক শতক ধরে আমরা যে স্বপ্ন দেখে আসছি, তা অবশেষে সত্যি হলো। তবে এই সাফল্য কারও একার কৃতিত্ব নয়, লাখ লাখ সাধারণ মানুষের সাফল্য। লাখ লাখ চোখ যে প্রত্যাশা নিয়ে তাকিয়ে রয়েছে ও যা আমাদের সামনে এগিয়ে দিয়েছে, তাদের সাথে সম্মিলিত ভাবেই আমরা শ্রীলঙ্কার নতুন ইতিহাস রচনা করব।’
তিনি আরও দাবি করেন, ‘বহুমেরু ব্যবস্থায় নানা শক্তি শিবির থাকে। কিন্তু আমরা কোনো ভূ-রাজনৈতিক লড়াইয়ের অংশ হতে চাই না। আমরা স্যান্ডউইচ হতে নারাজ। বিশেষ করে ভারত ও চীনের মধ্যে। এই দুই দেশই গুরুত্বপূর্ণ বন্ধু আমাদের। আশা করি আরও ঘনিষ্ঠ হব আমরা।’
বৈশ্বিক মিডিয়াতে দিশানায়েকেকে নিয়ে সরব উপস্থিতিরও একমাত্র কারণ হলো তার ভারত ও চীন নিরোধী মনোভবের জন্য। তিনি নিজেকে প্রতিনিয়ত প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট ছিলেন এসব দেশের বিরুদ্ধে কথা বলে নিজেদের তৃতীয় শক্তিতে পরিণত করতে।
শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভারত ও চীনের প্রভাব ব্যাকফুটে যাওয়ার অনেকগুলো সুনির্দিষ্ট কারণ রয়েছে। যেমন এই দুই দেশের অতিরিক্ত রাজনৈতিক খবরদারি, ঋণের নামে প্রলোভন, নিজেদের স্বার্থে বাণিজ্য, জলপথের আধিপত্য, সমুদ্র বন্দর ব্যবহার নিয়ে টানাটানি, জাতিগত বিভাজন (তামিল), ভারত মহাসাগরের নৌ-মহড়া ও সামরিক শক্তির আগ্রাসন ইত্যাদি। এছাড়া জড়িত আছে দোষারোপের রাজনীতি।
ভারত ও চীন ঘেঁষা নেতাদের শ্রীলঙ্কার জনগণ ভোট না দেওয়ার কারণগুলোও কিন্তু সুস্পষ্ট বিদেশি শক্তি রাষ্ট্রেরগুলোর প্রতি নেতাদের তোষামোদের রাজনীতি, অর্থনৈতিক প্রকল্পের নামে বিদেশি এজেন্ডা বাস্তবায়ন, আকাশছোঁয়া মুদ্রাস্ফীতির সুরাহ না করা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমা ও বাজার দর নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা।
এখনই আমাদের সময় এসেছে বিদেশিদের স্বার্থ বা এজেন্ডা বাস্তবায়ন না করে স্বনির্ভর ও স্বাধীন দেশ হিসেবে নিজেদের সুপ্রতিষ্ঠিত করা। যেখানে থাকবে না কোনো বৈষম্য ও বৈশ্বিক রাজনীতির সমীকরণ।
আরও অনেক কারণ জড়িত থাকলেও এগুলো ছিল মূল কারণ। শ্রীলঙ্কার জনগণের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো তাদের শিক্ষার হার। শিক্ষিত হওয়াই তারা ভালোভাবে বৈশ্বিক রাজনীতি জানে ও বুঝে। তাই তো ভোটের বিনিময়ে দেশকে বিক্রি করা কোনো জনপ্রতিনিধির হাতে তারা দেশকে তুলে দেয়নি।
শ্রীলঙ্কার নির্বাচনের ফলাফল পরোক্ষভাবে কিন্তু আমাদেরও বার্তা দিয়ে গেলো। অতীতে আমাদের নতজানু পররাষ্ট্র নীতির দোহাই দিয়ে বরাবরই বিদেশি শক্তিদের সমীহ করেছি। চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর পরও তাদের কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারেনি। বারবার তাদের স্বার্থে নিজেদের বিকিয়ে দিয়েছি।
এখনই আমাদের সময় এসেছে বিদেশিদের স্বার্থ বা এজেন্ডা বাস্তবায়ন না করে স্বনির্ভর ও স্বাধীন দেশ হিসেবে নিজেদের সুপ্রতিষ্ঠিত করা। যেখানে থাকবে না কোনো বৈষম্য ও বৈশ্বিক রাজনীতির সমীকরণ। জনগণের মতামতের ওপর ভিত্তি করেই রাষ্ট্র কাঠামো পরিচালিত হবে।
দিশানায়েক স্পষ্টতই ভারত ও চীনা প্রভাব রুখতে সজাগ ছিলেন। তার নির্বাচনী প্রচারণায়ও তা দৃশ্যমান হয়েছে। তার ভাষণ ও বক্তৃতায় একটি বিষয় দিবালোকের মতো সত্য প্রমাণ করেছেন যে তিনি শ্রীলঙ্কাকে এই দুই দেশের প্রভাব থেকে দুরে রাখতে চান। এখন ভবিষ্যতই ঠিক করবে দিশানায়েকর দিশা কি হবে।
আদৌও তিনি কি পারবেন এই বৃহৎ শক্তিগুলোকে এড়িয়ে শ্রীলঙ্কায় প্রভাবহীন সমাজ চালু করতে? কৃষক পরিবার থেকে উঠে আসা এই রাজনীতিবিদ কতটা নিজেকে বৈশ্বিক রাজনীতিতে মেলে ধরতে পারবেন এটা এখন দেখার বিষয়।
প্রশান্ত কুমার শীল ।। শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক[email protected]