দীর্ঘ এক যুগ ধরে বিকল রাডার নিয়ে চলা রংপুর আবহাওয়া কার্যালয়ে নতুন ডপলার রাডার স্থাপনে গতি ফিরেছে। ইতোমধ্যে প্রকল্পের কাজের সার্বিক অগ্রগতি হয়েছে ৯২ শতাংশ। এর ফলে রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলে খুলছে আবহাওয়ার তথ্য জানার নতুন দুয়ার। আট বছর আগে শুরু হওয়া রাডার স্থাপনের কাজের অগ্রগতিতে স্বস্তি ফিরেছে আবহাওয়া দপ্তরেও।
দীর্ঘ এক যুগ ধরে বিকল রাডার নিয়ে চলা রংপুর আবহাওয়া কার্যালয়ে নতুন ডপলার রাডার স্থাপনে গতি ফিরেছে। ইতোমধ্যে প্রকল্পের কাজের সার্বিক অগ্রগতি হয়েছে ৯২ শতাংশ। এর ফলে রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলে খুলছে আবহাওয়ার তথ্য জানার নতুন দুয়ার। আট বছর আগে শুরু হওয়া রাডার স্থাপনের কাজের অগ্রগতিতে স্বস্তি ফিরেছে আবহাওয়া দপ্তরেও।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগামী বছরের ৩০ এপ্রিলের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করার কথা। সে অনুযায়ী নির্মাণকাজ এগিয়ে চলছে। আগামী বছর নির্ধারিত সময়ের আগেই রাডার ব্যবহার কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হবে। ডপলার রাডার স্থাপন হলে আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে আগাম প্রস্তুতি গ্রহণের সুযোগ থাকায় দুর্যোগে কমবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ।
রাডার স্থাপনের কাজটি তত্ত্বাবধান করছে জাপানের সিমিজু করপোরেশন। কর্মকর্তারা রংপুর আবহাওয়া কার্যালয়ে অবস্থান করছেন এবং মাঠপর্যায়ে কাজের তদারকি করছেন। এ রাডার স্টেশনের সরঞ্জামাদি সরবরাহ করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মারুবিনি করপোরেশন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জাপান সরকারের অনুদানে আবহাওয়া অফিসে একটি ডপলার রাডার স্থাপনের কথা ছিল। কিন্তু ২০১৫ সালের ৩ অক্টোবর রংপুরের কাউনিয়ার আলুটারী গ্রামে জাপানি নাগরিক হত্যার ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনার পর নিরাপত্তার অভাব বোধ করায় জাপানের প্রকৌশলীরা রংপুরে রাডার স্থাপনের কাজের জন্য আর আসেননি। এরপর ২০১৬ সালে রাজধানী ঢাকার গুলশানে হোলি আর্টিজানের ক্যাফে হামলার ঘটনায় নিহত ২০ জনের সাতজনই জাপানি নাগরিক ছিল। এরপর থেকে নিরাপত্তাজনিত কারণে রাডার স্থাপনে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়।
পরে জাপানি প্রকৌশলীদের চাহিদা মোতাবেক নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করে আবহাওয়া অফিসে পুলিশ ব্যারাক ও ডরমিটরি নির্মাণ এবং সীমানা প্রাচীর কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়। তাদের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা একটি প্রতিনিধি দল রংপুর আবহাওয়া অফিস পরিদর্শন করে নিরাপত্তা নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন। এরপর প্রকৌশলীরা রংপুরে আসার প্রস্তুতি নিলে মহামারি করোনার কারণে আবার পিছিয়ে যায় রাডার স্থাপনের কাজ।
মূলত ২০১৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত প্রকল্পের উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি হয়নি। ২০২১-২২ অর্থবছর থেকে রাডার স্থাপনের প্রকল্পে গতি আসে। আনুষ্ঠানিকভাবে রাডার স্থাপনের কাজ শুরু হয় ২০২৩ সালের ৩১ মার্চ থেকে। জাপান সরকারের অনুদানে প্রায় ১২০ কোটি টাকা ব্যয়ে এটি নির্মাণ করার কথা থাকলেও পরবর্তীতে প্রকল্প ব্যয় ১৫০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। যার বেশি অংশই দিচ্ছে জাপানের দাতাসংস্থা জাইকা।
এদিকে রংপুর আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা যায়, রংপুর নগরীর কলেজ রোড মাস্টারপাড়া এলাকায় ১৯৭৭-৭৮ অর্থবছরে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের অধীনে আবহাওয়া, রাডার ও ভূ-কম্পন পর্যবেক্ষণাগার স্থাপন করা হয়। আড়াই একর জমির ওপর নির্মিত এ আবহাওয়া কেন্দ্রে জাপান সরকারের অর্থায়নে ১৯৯৯ সালে ১০০ কোটি টাকা ব্যয়ে কনভেনশনাল রাডার স্থাপন করা হয়। এ রাডারের সাহায্যে ভূমিকম্প পরিমাপ, দুর্যোগের পূর্বাভাস ও প্রতিদিনের আবহাওয়া পরিস্থিতি ঢাকার প্রধান কার্যালয়ে প্রদান করা হতো। রাডারটির আয়ুষ্কাল ছিল ১০ বছর। কিন্তু ২০০৭ সালে রাডারে ত্রুটি ধরা পড়ে। স্থানীয় প্রকৌশলীদের প্রচেষ্টায় ২০১২ সাল পর্যন্ত রাডারটিকে সক্রিয় রাখা সম্ভব হয়েছিল।
এরপর থেকে ১৩ বছর ধরে বিকল হয়ে পড়ে আছে রংপুর আবহাওয়া, রাডার ও ভূকম্পন পর্যবেক্ষণাগারের একমাত্র রাডারটি। ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় আবহাওয়ার পূর্বাভাস না পাওয়ায় প্রায় ৪০০ কিলোমিটার এলাকার মানুষজন আগাম প্রস্তুতি নিতে ব্যর্থ হচ্ছে। আগাম বার্তা পেতে ঢাকাসহ অন্যান্য আবহাওয়া অফিসের তথ্যের ওপর নির্ভর করতে হয়। এতে সময়ক্ষেপণ হয় বেশি। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে রংপুর ও এর আশপাশের কৃষিকাজ। এতে কৃষকের উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে উত্তরাঞ্চলের মানুষকে আবহাওয়া সম্পর্কে পূর্বাভাস দিতে নতুন রাডার স্থাপনের কাজ শুরু হয়।
আবহাওয়াবিদদের তথ্য অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উত্তরাঞ্চলের প্রকৃতিতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। জীববৈচিত্রও হুমকির মুখে পড়েছে। শীতকালে প্রচণ্ড শীত এবং শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যায় এই অঞ্চলে। গ্রীষ্মকালে ঝড়, টর্নেডো, অবিরাম বর্ষণ, বন্যাসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ লেগেই আছে। বলা চলে প্রায় বারো মাসই উত্তরাঞ্চলের মানুষ নানা প্রতিকূলতাকে মোকাবিলা করে চলছে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় এ অঞ্চলের আবহাওয়া অফিসগুলোকে কার্যকরভাবে গড়ে তোলা হয়নি। উত্তরাঞ্চলের আবহাওয়া অফিসগুলোর মধ্যে একমাত্র রংপুরে ছিল রাডার এবং ভূমিকম্প পরিমাপক যন্ত্র। রাডারটি নষ্ট হওয়ায় আবহাওয়ার অনেক তথ্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছিল এই অঞ্চলের মানুষ। রাডারটি স্থাপন হলে রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলার মানুষ সঠিক সময়ে আবহাওয়ার সঠিক তথ্য পাবে।
নতুন রাডার স্থাপনের দায়িত্বে থাকা সিমিজু করপোরেশনের কনসালটেন্টরা জানিয়েছে, নতুন রাডারের মাধ্যমে রংপুর আবহাওয়াকেন্দ্র থেকে চারদিকে ৪০০ কিলোমিটার এলাকা পর্যন্ত ঘূর্ণিঝড়, মেঘের গতিবিধি, বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রা, বজ্রপাতসহ আবহাওয়ার আগাম নানা তথ্য দেওয়া সম্ভব হবে। দুর্যোগের বেশ কয়েক ঘণ্টা আগে তথ্য পাওয়ায় সংশ্লিষ্টদের সঠিকভাবে পূর্বাভাস দেওয়া যাবে। কালবৈশাখি মেঘের অস্তিত্ব, টর্নেডোর মেঘ, বজ্রপাতের ধরণ বলে দিতে পারবে এই রাডার।
এ বিষয়ে রংপুর আবহাওয়া, রাডার ও ভূকম্পন পর্যবেক্ষণাগারের কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, রাডার স্থাপনে নতুন ভবন, অফিস রুম এবং পর্যবেক্ষণ রুমের কাজ শেষের দিকে। এখন চলছে প্রয়োজনীয় ইকুইপমেন্ট স্থাপনের কাজ। ভবন নির্মাণ ও ইকুইপমেন্ট সংযোজনসহ সার্বিক কাজের অগ্রগতি শতকরা ৯২ শতাংশ এগিয়েছে। নতুন স্থাপিত ডপলার রাডারের মেয়াদকাল ২০ বছর। আশা করছি, আগামী বছরে নির্দিষ্ট সময়ের আগে এই রাডার ব্যবহারের কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হবে।
তিনি আরও বলেন, উত্তরাঞ্চলের অর্থনীতি কৃষির সঙ্গে জড়িত। প্রতি বছর খরা, বন্যা, অতিবৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড়ের কারণে আমাদের কোটি কোটি টাকার ফসলহানি হয়। বজ্রপাতের কারণে দিন দিন মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে চলছে। আবহাওয়ার পূর্বাভাস না থাকায় মৌসুমি রোগব্যাধিও বাড়ছে। তাই এখানে ডপলার রাডার স্থাপন করা অত্যন্ত জরুরি ছিল।
নতুন এ রাডার স্টেশন চালু হলে মেঘের অবস্থান, গতি, দিক, তাপমাত্রা জানতে পারব। বজ্রপাতের পূর্বাভাস দেওয়ার মাধ্যমে মৃত্যুর হার কমানো সম্ভব হবে। রেডজোনে অবস্থিত রংপুরে ভূমিকম্প ও বড় ধরনের বন্যার তথ্য দেওয়া যাবে। আগাম বৃষ্টিপাতের তথ্য দেওয়ার মাধ্যমে কৃষকদের ফসলের ক্ষতি থেকে রক্ষা করা যাবে। সেই সঙ্গে রংপুরের আবহাওয়ার অবস্থা ও পরিবর্তনজনিত কারণগুলো গবেষণা করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা যাবে-যোগ করেন ওই আবহাওয়া কর্মকর্তা।
ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এএমকে