মর্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অতিথির বেশে শান্তিতে নোবেলজয়ী বিশ্ব বরেণ্য অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস, এ যেন নতুন কিছু নয়। জাতিসংঘের বিভিন্ন ফোরামে ভাষণ থেকে শুরু করে বিভিন্ন সংস্থার দায়িত্ব পালন যেন তার জন্য নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। তবে এবার সবকিছু ঠিক থাকলে সেই যুক্তরাষ্ট্রে নতুন রূপে দেখা মিলবে বিশ্ব বরেণ্য এ ব্যক্তির। এবার কোনো অতিথি বক্তা হিসেবে নয় সরকারপ্রধান হিসেবে বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশকে তুলে ধরবেন তিনি।
মর্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অতিথির বেশে শান্তিতে নোবেলজয়ী বিশ্ব বরেণ্য অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস, এ যেন নতুন কিছু নয়। জাতিসংঘের বিভিন্ন ফোরামে ভাষণ থেকে শুরু করে বিভিন্ন সংস্থার দায়িত্ব পালন যেন তার জন্য নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। তবে এবার সবকিছু ঠিক থাকলে সেই যুক্তরাষ্ট্রে নতুন রূপে দেখা মিলবে বিশ্ব বরেণ্য এ ব্যক্তির। এবার কোনো অতিথি বক্তা হিসেবে নয় সরকারপ্রধান হিসেবে বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশকে তুলে ধরবেন তিনি।
গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে ভিন্ন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দেবেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তার সফর ঘিরে জাতিসংঘে নতুন দৃশ্য অবতরণ হতে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক ফোরাম থেকে শুরু করে বিশ্বনেতাদের নজর থাকবে বিশ্ব বরেণ্য এ অর্থনীতিবিদের দিকেই। তার মুখ থেকে নতুন বাংলাদেশের কথা উঠবে বিশ্বমঞ্চে।
যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে অবস্থিত জাতিসংঘের দপ্তরে সাধারণ অধিবেশন ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। বেশিরভাগ বিশ্বনেতারাও অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের পথে রয়েছেন ড. ইউনূস। সবকিছু ঠিক থাকলে স্থানীয় সময় সোমবার (২৩ সেপ্টেম্বর) তার যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছার কথা রয়েছে।
সূচি অনুযায়ী, ২৭ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনে ভাষণ দেবেন ড. ইউনূস। তার ভাষণ ঘিরে সবার আগ্রহ। কারণ, বাংলাদেশে হওয়া বিরল ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে নজর ছিল বিশ্ববাসীর। আর বিক্ষোভের মুখে পতন হয় দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে একনায়কতন্ত্র চালানো শেখ হাসিনার।
জানা যায়, জাতিসংঘের অধিবেশনে বাংলাদেশে জুলাই-আগস্টে সংঘটিত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রেক্ষাপট এবং ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের বীরত্ব গাথা কথা তুলে ধরবেন প্রধান উপদেষ্টা। একই সঙ্গে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর রাষ্ট্র মেরামতের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের নেওয়া সংস্কার কার্যক্রম বিশ্ববাসীর সামনে উপস্থাপন করবেন তিনি।
জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনের কর্মকর্তারা বলছেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূস সারাবিশ্বেই জনপ্রিয় ও পরিচিত এক মুখ। তার ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণ তত্ত্ব আজ বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। এর আগে তিনি জাতিসংঘসহ বিশ্বের বিভিন্ন নামি প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। ভাষণ দিয়েছেন সিনেটসহ অনেক রাষ্ট্রের আইনসভায়। তবে এবারের জাতিসংঘ অধিবেশন সম্পূর্ণ ভিন্ন। কারণ, তিনি হাজির হয়েছেন সরকারপ্রধান হিসেবে। এমনকি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারপ্রধান ও সংস্থার প্রধান ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাতের আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।
কর্মকর্তারা আরও জানান, মূল অধিবেশনের পাশাপাশি বেশ কয়েকটি সাইট ইভেন্টে যোগ দেবেন প্রধান উপদেষ্টা। বিভিন্ন সংস্থা প্রধান ও রাষ্ট্র প্রধানের সঙ্গে তার দেখা হওয়ার কথা রয়েছে। এবার ড. ইউনূসের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফর খুবই সংক্ষিপ্ত হওয়ায় অনেকের সঙ্গে তার বৈঠক সম্ভব হবে না। তবে এবার জাতিসংঘে সবার নজর যে তার দিকে থাকবে সেটা আগে থেকেই আঁচ করা যাচ্ছে।
প্রথম সফরে নজর কাড়বেন সবাই
জুলাই-আগস্ট মাসে বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার আন্দোলন সারাবিশ্বে দৃষ্টি কেড়েছে। গত ৫০ বছরের এমন ছাত্র বিক্ষোভ বিশ্ববাসী দেখেনি। তাই এবার জুলাই বিপ্লবের দিকে নজর ছিল বিশ্ববাসী। তীব্র গণঅভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে ৮ আগস্ট দায়িত্ব নেন ড. ইউনূস।
দেশের দায়িত্ব নিয়েই বিভিন্ন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি। প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায় অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। সরকারপ্রধানের দায়িত্ব নেওয়ার পর এটি তার প্রথম বিদেশ সফর।
ইউনূস-বাইডেন বৈঠকে নজর থাকবে সবার
নিউইয়র্কের কূটনৈতিক সূত্রে জানা যায়, ৩০ বছরের ইতিহাসে এবার প্রথম বাংলাদেশের কোনো সরকারপ্রধানের সঙ্গে অধিবেশনের ফাঁকে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করতে যাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। গত বৃহস্পতিবার বিকেলে ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে ইউনূস-বাইডেন বৈঠকের বিষয়টি চূড়ান্ত করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২৪ সেপ্টেম্বরের পরিবর্তে ড. ইউনূস আজ (২৩ সেপ্টেম্বর) নিউইয়র্কের উদ্দেশে রওনা হয়েছেন।
সাধারণত জাতিসংঘ অধিবেশনে নির্ধারিত বক্তৃতার দিন সকালে নিউইয়র্কে পৌঁছান যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। তিনি সেদিন সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বক্তৃতা দেন। এরপর বিকেলে অধিবেশনে আগত রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের সম্মানে সংবর্ধনার আয়োজন করেন।
সাধারণ পরিষদের অধিবেশন চলার ফাঁকে কোনো দেশের শীর্ষ নেতার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের দ্বিপক্ষীয় সাক্ষাৎ প্রায় বিরল। বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সবসময় সংবর্ধনায় দেখা হয়েছে বা কথা হয়েছে। কিন্তু গত তিন দশকে জাতিসংঘের অধিবেশনের ফাঁকে বাংলাদেশের কোনো শীর্ষ নেতার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের কোনো বৈঠক হয়নি, যা এবার ঘটতে যাচ্ছে এবং বিষয়টি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও সম্মানের। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদল গত ১৫ সেপ্টেম্বর ঢাকা সফর করে গেছে। তার দুই সপ্তাহের মাথায় প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বৈঠক করছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে।
এ ছাড়া, সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্তদের সঙ্গে একের পর এক বৈঠক করে যাচ্ছেন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার প্রতিনিধিরা। আর্থিক, সাংবিধানিকসহ বিভিন্ন খাতের সংস্কারসহ বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় যুক্তরাষ্ট্র সব ধরনের সহায়তা করতে প্রস্তুত, নিউইয়র্কের আসন্ন বৈঠক তারই ইঙ্গিত বহন করছে।
জানতে চাইলে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সেক্রেটারি শফিকুল আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের ফাঁকে বাংলাদেশের সরকারপ্রধানের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের দ্বিপাক্ষিক বৈঠক বিগত তিন দশকে হয়নি। এটা নিঃসন্দেহে সম্মান ও গৌরবের।
তিনি আশা করেন, নতুন বাংলাদেশ ঘিরে ড. ইউনূসের চিন্তাভাবনা, রাষ্ট্র সংস্কারের ভাবনা সেখানে স্থান পাবে। এটা অবশ্যই দেশের গর্ব করার মতো একটা ঘটনা। বাইডেন-ইউনূসের এই বৈঠক শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বনেতারাও নজর রাখবেন বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
একাধিক সংস্থা প্রধান ও রাজনৈতিক ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাৎ
তিনদিনের সংক্ষিপ্ত সফরে প্রফেসর ড. ইউনূস বিভিন্ন সংস্থা প্রধান, ব্যক্তি ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। এর মধ্যে রয়েছে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ও জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার টুর্ক।
এ ছাড়া, ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লিয়েনের সঙ্গে বৈঠক করবেন ড. ইউনূস। বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট অজয় বাঙ্গা এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভার সঙ্গেও দেখা করার কথা রয়েছে।
ইউনূসের সঙ্গে নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলি, বাহরাইনের ক্রাউন প্রিন্স হামাদ বিন ইসা আল খালিফা, নেদারল্যান্ডসের প্রধানমন্ত্রী ডিক শফ, মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুইজ্জু, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের সৌজন্য সাক্ষাতের কথা রয়েছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) প্রধান কৌঁসুলি করিম খান, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার পরিচালক সামান্থা পাওয়ার, জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্রান্ডি, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) মহাপরিচালক গিলবার্ট এফ. হংবোসহ জাতিসংঘের আরও অনেক সংস্থার প্রধান ড. ইউনূসের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন।
সফরের সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সেক্রেটারি শফিকুল আলম বলেন, জাতিসংঘে নিঃসন্দেহে বিশ্বনেতাদের নজর কাড়বেন ড. ইউনূস। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর বাংলাদেশের অর্থনীতি সহনশীল করতে উন্নয়ন সহযোগী ও দাতা সংস্থারা যেভাবে এগিয়ে আসছেন তা বিস্ময়কর। তারা বাংলাদেশের সংস্কার ও রাষ্ট্রীয় মেরামতে সাহায্যের আগ্রহ প্রকাশ করছেন।
শফিউল আলম বলেন, ভোটার তালিকা হালনাগাদ, আর্থিক খাত, প্রশাসনিক রিফর্ম বা সংস্কার করতে গেলে অনেক ক্ষেত্রে অর্থের প্রয়োজন হয়। এসব সংস্কারে বিশ্ব ব্যাংকসহ অন্যান্য সংস্থা আর্থিক সহায়তা প্রদান করতে প্রস্তুত বলে তারা জানিয়েছে।
এনএম/এমজে