ভারত এত উত্তাল কেন?

ভারত এত উত্তাল কেন?

সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ছিল যে, এমন একটি গুরুতর ঘটনার পর অভিযুক্ত কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। কিন্তু মমতার এই সিদ্ধান্ত থেকে বোঝা যাচ্ছে, তিনি মূলত অভিযুক্তদের পক্ষেই অবস্থান নিয়েছেন….

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বর্তমানে অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছে। ৯ আগস্ট ২০২৪ কলকাতার আরজি কর মেডিকেল কলেজে একজন প্রশিক্ষণরত চিকিৎসককে শারীরিক নির্যাতন, ধর্ষণ এবং হত্যা করা হয়। এই ঘটনাটি গোটা রাজ্যে বিপুল প্রতিবাদের ঢেউ তুলেছে।

জনগণের মনে তীব্র ক্ষোভ জন্ম দিয়েছে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিক্রিয়ায়, যেখানে তিনি অভিযুক্ত কলেজের অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষকে দীর্ঘ ছুটি বা বরখাস্ত করার পরিবর্তে আরেকটি সরকারি মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে স্থানান্তরিত করেন। মমতার এই পদক্ষেপ স্পষ্টতই জনসাধারণের বিরোধিতা সৃষ্টি করেছে, যা তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী বিরোধী ধারা তৈরি করেছে।

পশ্চিমবঙ্গ বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত উদ্বেগজনক সময় পার করছে। পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় ডাক্তার ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনার পর এই অস্থিরতা নতুন করে সামনে এসেছে। আরজি কর মেডিকেল কলেজের একজন প্রশিক্ষণরত চিকিৎসকের ওপর শারীরিক নির্যাতন, ধর্ষণ এবং হত্যার ঘটনা শুধুমাত্র চিকিৎসক মহলেই নয়, সাধারণ জনগণের মাঝেও তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ এবং তার প্রভাবকে বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, রাজনৈতিক অস্থিরতার পাশাপাশি একটি বৃহত্তর সামাজিক বিপর্যয়ের সম্ভাবনাও দেখা দিচ্ছে।

অন্যদিকে, কর্ণাটকে সংঘটিত ব্যাংক কেলেঙ্কারি নিয়ে ভারতের রাজনীতিতে বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে। আরটিআই অনুসারে, সিবিআই এই কেলেঙ্কারি নিয়ে তদন্ত করছে না বলে জানিয়েছে, যদিও সিদ্দারামাইয়া দাবি করেছিলেন যে সিবিআই এই কেলেঙ্কারির তদন্ত করছে।

ডাক্তার ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনার পর, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সানন্দ ঘোষকে একই কলেজের অধ্যক্ষের পদ থেকে সরিয়ে অন্য একটি সরকারি মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগের সিদ্ধান্ত বেশ বিতর্কিত হয়েছে।

সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ছিল যে, এমন একটি গুরুতর ঘটনার পর অভিযুক্ত কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। কিন্তু মমতার এই সিদ্ধান্ত থেকে বোঝা যাচ্ছে, তিনি মূলত অভিযুক্তদের পক্ষেই অবস্থান নিয়েছেন, যা জনগণের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ তৈরি করেছে।

মমতার এই সিদ্ধান্ত এবং তার প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিকভাবেই জনবিরোধী আখ্যা পেয়েছে। জনগণের ধারণা, সরকার ও শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস তাদের নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য জনমানুষের পাশে দাঁড়ানোর পরিবর্তে ক্ষমতাসীনদের পক্ষপাতিত্ব করছে।

সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ছিল যে, এমন একটি গুরুতর ঘটনার পর অভিযুক্ত কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। কিন্তু মমতার এই সিদ্ধান্ত থেকে বোঝা যাচ্ছে, তিনি মূলত অভিযুক্তদের পক্ষেই অবস্থান নিয়েছেন….

মমতার এহেন অবস্থান জনগণের আস্থাহীনতা ও ক্রোধকে বাড়িয়ে দিয়েছে। তার অভিযোগ যে, বামফ্রন্ট ও বিজেপি যৌথভাবে তৃণমূলের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে, তা অনেকাংশেই রাজনৈতিক প্রচারণা বলে মনে হয়।

দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতাসীন দল হিসেবে তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভ ও অসন্তোষ ধীরে ধীরে বাড়ছে। এই ক্ষোভ বামফ্রন্ট বা বিজেপির ষড়যন্ত্রের ফল নয়, বরং শাসক দলের ভুল পদক্ষেপ এবং জনবিরোধী নীতির ফল।

এই রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ও অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও অশান্ত করছে। ভারতের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি এক গভীর সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যেখানে কলকাতার চিকিৎসক ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনার পাশাপাশি কর্ণাটক ব্যাংক কেলেঙ্কারিতে সিবিআই তদন্ত না হওয়ার বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

তৃণমূল কংগ্রেসের ভেতরে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার একদিকে জনমনে তীব্র ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে, অন্যদিকে মানুষের প্রকৃত সমস্যার প্রতি সরকারের অবহেলা রাজ্যজুড়ে গভীর হতাশা তৈরি করেছে। কলকাতায় এক চিকিৎসকের ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা প্রমাণ করে দিয়েছে যে, রাজ্য সরকার সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে।

চিকিৎসক সমাজ, যারা মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য নিজেদের নিবেদিত করে, তারাও এখন নিজেদের নিরাপত্তাহীন বোধ করছেন। এই ঘটনায় তৃণমূল সরকারের দুর্বল প্রশাসনিক ক্ষমতার একটি প্রতিফলন দেখা গেছে। সাধারণ মানুষ সরকারের ওপর তাদের আস্থা হারাচ্ছে, কারণ সরকার জনগণের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হচ্ছে।

এদিকে, কর্ণাটক ব্যাংক কেলেঙ্কারির তদন্তের প্রসঙ্গে সিবিআই-এর নিষ্ক্রিয়তাও নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তথ্য অধিকার আইনের (RTI) মাধ্যমে জানা গেছে যে, এই কেলেঙ্কারির তদন্তে কোনো প্রকৃত অগ্রগতি হচ্ছে না। এই কেলেঙ্কারির সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেতাদের সংশ্লিষ্টতার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না, যা জনসাধারণের মনে এক গভীর সন্দেহের জন্ম দিয়েছে।

তৃণমূল কংগ্রেসের ভেতরে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার এই পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে। ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের বিরুদ্ধে বারবার দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পরেও সরকার তাতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে। এর ফলে জনগণের মধ্যে ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ তৈরি হয়েছে।

তৃণমূল কংগ্রেসের শাসনামলে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ নতুন কিছু নয়। কিন্তু, সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোয় দেখা যাচ্ছে যে, এই দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার এখন এমন এক স্তরে পৌঁছে গেছে, যেখানে সাধারণ মানুষের জীবনে এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে।

এছাড়াও, সাধারণ মানুষের প্রকৃত সমস্যা নিয়ে সরকার মোটেও চিন্তিত নয়। বরং, তারা নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করতে এবং ক্ষমতা ধরে রাখতে ব্যস্ত। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থান ইত্যাদি মৌলিক বিষয়গুলোয় সরকারের যে অবহেলা, তা জনগণের দৈনন্দিন জীবনে ক্রমবর্ধমান চাপ তৈরি করছে।

কলকাতায় এক চিকিৎসকের ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা প্রমাণ করে দিয়েছে যে, রাজ্য সরকার সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে।

জনগণের সমস্যাগুলো সমাধানের পরিবর্তে, সরকার নিজেদের স্বার্থের পেছনে ছুটছে, যা সাধারণ মানুষের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। এর মধ্যে, রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র তত্ত্বও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তৃণমূল কংগ্রেসের নেতারা এই ঘটনাগুলোর পেছনে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনে জনরোষ কমানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু, এই অভিযোগগুলো জনসাধারণের মনে তেমন কোনো প্রভাব ফেলছে না।

বরং, জনগণ এই ধরনের ষড়যন্ত্র তত্ত্বকে ক্ষমতাসীন দলের দুর্বলতার পরিচয় হিসেবেই দেখছে। জনগণের ক্রমবর্ধমান ক্ষোভকে চাপা দিতে এই ষড়যন্ত্র তত্ত্ব যথেষ্ট প্রভাব ফেলতে পারছে না। এর ফলে, সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা আরও কমছে এবং জনরোষ আরও তীব্রতর হচ্ছে। তৃণমূল কংগ্রেসের ভেতরে দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং জনগণের প্রকৃত সমস্যা উপেক্ষা করার প্রবণতা সরকারের প্রতি জনসাধারণের আস্থা কমিয়ে দিচ্ছে।

সরকারের এই ব্যর্থতার ফলে, একদিকে রাজ্যজুড়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়ছে, অন্যদিকে সাধারণ মানুষের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা ও হতাশা আরও গভীর হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে, রাজনৈতিক অস্থিরতা আরও দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে, যা রাজ্যের সামগ্রিক উন্নয়নকে পিছিয়ে দিতে পারে।

সার্বিকভাবে, ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বর্তমানে এক অস্থির সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তৃণমূল কংগ্রেসের দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার, জনগণের প্রকৃত সমস্যা সমাধানে সরকারের অবহেলা এবং রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র তত্ত্ব জনমনে গভীর হতাশা ও ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন সরকারের কার্যকর উদ্যোগ, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা এবং জনগণের সমস্যাগুলোর প্রতি যথাযথ মনোযোগ।

অন্যথায়, রাজনৈতিক অস্থিরতা আরও তীব্র হতে পারে, যা রাজ্যের ভবিষ্যতের জন্য অশনি সংকেত। ভারতের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল এবং অশান্ত। পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় ডাক্তার ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে যে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে, তা শুধুমাত্র একটি সাময়িক সমস্যা নয়, বরং গভীরতর রাজনৈতিক সংকটের প্রতিফলন।

তৃণমূল কংগ্রেস এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্য এ এক কঠিন সময়, যেখানে জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। দুর্নীতি দমন, জনগণের স্বার্থ রক্ষা এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা শক্তিশালী করার মাধ্যমে এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ সম্ভব হতে পারে।

অন্যথায়, ভারতের রাজনৈতিক অঙ্গনে আরও বড় ধাক্কা আসার সম্ভাবনা রয়েছে। যদি পশ্চিমবঙ্গ এই সংকটটি সঠিকভাবে সমাধান না করতে পারে, তাহলে এটি অন্যান্য রাজ্যেও ছড়িয়ে পড়তে পারে, যা ভারতের জন্য একটি বড় সংকট হয়ে উঠবে। বর্তমানে মোদি সরকারের নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার একটি জোট পার্লামেন্টে চলছে, যেখানে বিভিন্ন দলের স্বার্থ এবং মতামতের পার্থক্য প্রতিনিয়ত উত্তেজনা সৃষ্টি করছে।

এই পরিস্থিতিতে পশ্চিমবঙ্গের সংকট অন্যান্য রাজ্যে ছড়িয়ে পড়লে, তা শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, পুরো ভারতের রাজনৈতিক এবং সামাজিক স্থিতিশীলতার ওপর গুরুতর প্রভাব ফেলতে পারে। এটি কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জের সৃষ্টি করবে, যা সরকারের স্থিতিশীলতা ও কার্যক্ষমতা কমিয়ে দিতে পারে।

অধ্যাপক ড. সুজিত কুমার দত্ত ।। সাবেক সভাপতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

Visit Source Page

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *