ভারতীয় গ্যাংস্টার কে এই লরেন্স বিষ্ণোই?

ভারতীয় গ্যাংস্টার কে এই লরেন্স বিষ্ণোই?

ভারত সরকারের এজেন্টরা কানাডায় খালিস্তানপন্থী আন্দোলনের নেতাদের নিশানা করতে ‘‘বিষ্ণোই গ্রুপের মতো সংগঠিত অপরাধী গোষ্ঠীগুলোকে’’ ব্যবহার করছে। সোমবার এক সাংবাদিক সম্মেলনে কানাডার পুলিশ এই অভিযোগ করেছে।

ভারত সরকারের এজেন্টরা কানাডায় খালিস্তানপন্থী আন্দোলনের নেতাদের নিশানা করতে ‘‘বিষ্ণোই গ্রুপের মতো সংগঠিত অপরাধী গোষ্ঠীগুলোকে’’ ব্যবহার করছে। সোমবার এক সাংবাদিক সম্মেলনে কানাডার পুলিশ এই অভিযোগ করেছে।

পৃথক শিখ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি করে এই খালিস্তানি আন্দোলন। গত বছর কানাডার মাটিতে শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হরদীপ সিং নিজ্জরের হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে ভারত এবং কানাডার মধ্যে তিক্ততা বাড়তে থাকে।

এরপর সোমবার দুই দেশ একে অন্যের শীর্ষ কূটনীতিকদের বহিষ্কার করার সিদ্ধান্ত নেয়। তার কয়েক ঘণ্টা পর পুলিশের সাংবাদিক সম্মেলনে এই অভিযোগ উঠেছে। দিল্লি এই অভিযোগকে ‘অযৌক্তিক’ বলে উড়িয়ে দিয়ে পাল্টা বলেছে, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো রাজনৈতিক ফায়দার জন্য কানাডার বিশালসংখ্যক শিখ সম্প্রদায়কে ব্যবহার করছে।

সোমবারের সাংবাদিক সম্মেলনে কানাডার পুলিশ যে ব্যক্তির প্রসঙ্গ টেনে এনেছে, তিনি লরেন্স বিষ্ণোই। ৩১ বছর বয়সী এই ভারতীয় যুবকের নাম একাধিক বড়সড় অপরাধের সঙ্গে জড়িয়েছে।

দেশের তো বটেই আন্তর্জাতিক স্তরেও শিরোনামে উঠে এসেছেন তিনি। গত সপ্তাহে মহারাষ্ট্রের সাবেক প্রতিমন্ত্রী তথা ন্যাশানলিস্ট কংগ্রেস পার্টির নেতা বাবা সিদ্দিকীকে মুম্বাইয়ে তার ছেলের দপ্তরের কাছেই হত্যা করা হয়। ভারতের পুলিশের অভিযোগ, ৬৬ বছরের এই বহুল পরিচিত নেতার হত্যার সঙ্গে লরেন্স বিষ্ণোই গোষ্ঠীর যোগ রয়েছে।

এই ঘটনায় তিনজন সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে ইতিমধ্যে হেফাজতে নিয়েছে পুলিশ। বিষ্ণোইয়ের এক সহযোগী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটা পোস্ট শেয়ার করে বাবা সিদ্দিকীর হত্যার এপছনে তাদের গোষ্ঠীর হাত রয়েছে বলে দাবি জানিয়েছিল।

এক সময় ভারতের ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ তালিকায় থাকা লরেন্স বিষ্ণোই ২০১৫ সাল থেকে কারাগারে বন্দি রয়েছেন। আপাতত তিনি তার জন্মস্থান পাঞ্জাব থেকে বহুদূরে গুজরাটের কারাগারে আছেন। তা সত্ত্বেও তার ‘দুঃসাহসিক প্রভাব’ এখনও বহাল রয়েছে বলেই মনে করছে পুলিশ।

সিধু মুসেওয়ালা নামে এক জনপ্রিয় পাঞ্জাবি গায়ক ২০২২ সালের অক্টোবরে তার গ্রামের কাছে গুলিবিদ্ধ হন। অভিযোগ আছে, এই চাঞ্চল্যকর হত্যার মামলাতেও বিষ্ণোই প্রধান অভিযুক্ত। তার বিরুদ্ধে অভিযোগের তালিকা দীর্ঘ। বলিউড তারকা সালমান খানকে হুমকি দেওয়ার অভিযোগও উঠেছে তার বিরুদ্ধে।

অভিনেতা সালমান খানের বিরুদ্ধে রাজস্থানে দুটি কৃষ্ণসার হরিণ শিকারের অভিযোগ তুলে লরেন্স বিষ্ণোইয়ের পক্ষ থেকে হুমকি দেওয়া হয়েছিল। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে শিরোনামে আসেন তিনি, ‘কুখ্যাতিও’ জোটে।

প্রসঙ্গত রাজস্থানের বিষ্ণোই সম্প্রদায়ের কাছে কৃষ্ণসার প্রজাতির হরিণ পুজনীয়। যেদিন যোধপুরের আদালতে হাজির করা হয়েছিল বিষ্ণোইকে, সেদিন কোনওরকম রাখ ঢাক না করে অপেক্ষারত মিডিয়াকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেছিলেন, ‘‘সালমান খানকে এখানে, যোধপুরে হত্যা করা হবে… তখন সে আমাদের আসল পরিচয় জানতে পারবে।’’

ঘটনাক্রমে দিন কয়েক আগে বাবা সিদ্দিকী নামে যে রাজনীতিবিদকে হত্যা করা হয়েছে, তিনি বলিউড তারকা সালমান খানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। গত বছরের মার্চ মাসে ভারতীয় একটি টিভি চ্যানেল পাঞ্জাবের জেল থেকেই লরেন্স বিষ্ণোইয়ের দুটি সাক্ষাৎকার সম্প্রচার করে। এরপরই হাইকোর্টের পক্ষ থেকে এই ঘটনার তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়।

তবে কারাগার থেকে একজন ‘হাই-সিকিউরিটি’ বন্দি কীভাবে ফোন মারফত সাক্ষাৎকার দিতে পারেন, তা রহস্যই রয়ে গেছে। ফেডারেল তদন্তকারীদের অনুমান, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, রাজস্থান ও দিল্লিজুড়ে ৭০০ সদস্যের একটি বড় অপরাধমূলক গোষ্ঠীকে তিনি নিয়ন্ত্রণ করেন।

এই গোষ্ঠীর সদস্যরা তারকাদের থেকে চাঁদা আদায়, মাদক ও অস্ত্রের চোরাচালান এবং টার্গেট কিলিংয়ের মতো বিভিন্ন অপরাধমূলক ঘটনার সঙ্গে জড়িত। তার সঙ্গী গোল্ডি ব্রার কানাডায় বসে দূর থেকেই এই দলকে পরিচালনা করছে বলে পুলিশ জানিয়েছে।

প্রসঙ্গত, গায়ক সিধু মুসেওয়ালার হত্যার ঘটনায় গোল্ডি ব্রারও অভিযুক্তের তালিকায় রয়েছেন। এদিকে, লরেন্স বিষ্ণোইয়ের বিরুদ্ধে ৩০টিরও বেশি মামলা রয়েছে, যার মধ্যে ১৯টি মামলা বর্তমানে আদালতে বিচারাধীন অবস্থায় আছে।

পাঞ্জাবের ‘অ্যান্টি গ্যাংস্টার টাস্ক ফোর্স’র সিনিয়র অফিসার গুরমিত চৌহান বলেন, ‘‘ও (লরেন্স বিষ্ণোই) জেল থেকেই নির্বিঘ্নে নিজের গ্যাংকে পরিচালনা করে। এর জন্য ওর সমস্ত কিছু সমন্বয় করার প্রয়োজন পড়ে না।’’

‘‘ও একটা অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ অন্যান্য গ্যাংস্টারদের মতো নয়। ওর চিন্তা বড়সড় মাপের।’’

লরেন্স বিষ্ণোইয়ের জন্ম পাঞ্জাবের এক সচ্ছল পরিবারে। গ্রামের সবচেয়ে ধনীদের মধ্যে রয়েছে তাদের পরিবার। ১০০ একরেরও বেশি জমি দ্বারা বেষ্টিত প্রশস্ত বাংলোতে বাস করে বিষ্ণোই পরিবার। তার বাবা একজন সাবেক পুলিশ কর্মী। যদিও পারিবারিক জমি দেখাশোনা করার জন্য পুলিশের চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি। লরেন্স বিষ্ণোইয়ের মা একজন গৃহবধূ।

এই দম্পতির দুই ছেলে, লরেন্স এবং অনমোল বিষ্ণোই। দুজনই এখন সিধু মুসেওয়ালা হত্যা মামলায় প্রধান অভিযুক্ত। রমেশ বিষ্ণোই নামে এক আত্মীয় ‘দ্য ট্রিবিউন’ পত্রিকার সাংবাদিক এবং ‘হু কিলড মুসেওয়ালা’র লেখক জুপিন্দরজিৎ সিংকে জানিয়েছিলেন, পার্বত্য শহর সানাওয়ারের নামী বিদ্যালয় লরেন্স স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ব্রিটিশ অফিসার হেনরি মন্টগোমারি লরেন্সের নামানুসারে লরেন্সের নামকরণ করা হয়েছিল।

প্রাচুর্যে মোড়া ছিল লরেন্স বিষ্ণোইয়ের জীবন। সেখানকার একটি কনভেন্ট স্কুলে পড়াশোনা করেছেন তিনি। অষ্টম শ্রেণি থেকেই নিজের বাইক চালাতেন, পায়ে থাকত দামী জুতা। এমন বিলাসিতা অনেক মানুষেরই কল্পনাতীত।

সাংবাদিক জুপিন্দরজিৎ সিং বলেছেন, স্থানীয় অভাবী পরিবারের শিশুদের চুপিচুপি সাহায্য করার জন্য পরিচিত পাওয়া এই একজন অন্তর্মুখী ব্যক্তিত্বের প্রভাব অস্বীকার করার উপায় নেই। ২০০৮ সালে স্কুল শেষ করার পর চণ্ডীগড়ের একটি কলেজে ভর্তি হন তিনি। এরপর ছাত্র রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। সেখানে নিজের জায়গা তৈরি করতে সময় লাগেনি।

কত সহজেই তার অনুগামীদের আকৃষ্ট করতে সফল হয়ে ছিলেন সেই বিষয়ে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে চণ্ডীগড়ের এক পুলিশ কর্মকর্তা সিংকে বলেছিলেন, ‘‘ওর (লরেন্স বিষ্ণোইয়ের) অর্থ, স্টাইল এবং সাহস ছিল।’’

তিনি একটি ছাত্র সংগঠনে যোগ দেন। এরপর ছাত্র নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং হেরে যান। এই হারকে ব্যক্তিগতভাবে গ্রহণ করেছিলেন বিষ্ণোই। পুলিশের রেকর্ড বলছে, এই সময়েই সাবেক ছাত্রনেতা থেকে অপরাধী হয়ে ওঠা কয়েকজনের সংস্পর্শে আসেন তিনি। এটাই তার জীবনের ‘টার্নিং পয়েন্ট’ (মোড় ঘোরানো মুহূর্ত) হিসাবে কাজ করেছে; যা তাকে সহিংসতার জগতের কাছাকাছি নিয়ে যায়।

পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, কলেজ ক্যাম্পাসে মারামারি, অগ্নিসংযোগ ও গোলাগুলি চালানোর ঘটনায় লরেন্স বিষ্ণোইয়ের নাম জড়িয়েছিল। তার নিজের রাজ্য অর্থাৎ,পাঞ্জাব মাদক ও অস্ত্র চোরাচালান, তোলা আদায় করে এমন গোষ্ঠীতে ভর্তি। এই অপরাধমূলক গোষ্ঠীর সঙ্গে স্থানীয় চলচ্চিত্র ও সংগীত ইন্ডাস্ট্রির যোগ রয়েছে।

অনেকের মতে, মাদক, রিয়েল এস্টেট এবং অবৈধ মদ বিক্রি করে পাওয়া নগদ টাকা দ্বারা পরিচালিত সেই রাজ্যের অর্থনীতি এই গোষ্ঠীগুলোর উত্থানকে আরও উৎসাহ দিয়েছে। একই সঙ্গে এমন একটা বাস্তুতন্ত্রও তৈরি করেছে যা পাঞ্জাবি ‘পপ সংস্কৃতির’ সঙ্গে অপরাধ জগতকে মিলিয়ে দিয়েছে। পাঞ্জাবের গ্যাংস্টাররা শুধু সম্পদের জন্য ‘আন্ডারওয়ার্ল্ডে’ (অন্ধকার জগতে) আসেন না। তারা ‘কুখ্যাতি’ চান, ‘কিছু একটা হয়ে ওঠার’ গভীর আকাঙ্ক্ষা মনে মনে পোষণ করেন।

খ্যাতির এই ‘বিকৃত’ সাধনার শিকড় রয়েছে সামন্ততান্ত্রিক এবং পুরুষতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম একে আরও বেশি করে উস্কানি দিয়েছে। অপরাধ জগতের সঙ্গে যুক্ত অনেকেই অনলাইনে নিজেদের জাহির করতে পছন্দ করেন। অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের জীবনধারা জাহির করেন। এই দুনিয়ায় অপরাধকে প্রায়ই দ্রুত অর্থ উপার্জন এবং গ্ল্যামারের পথ হিসাবে দেখা হয়।

এটাই পাঞ্জাবের বহু অবসরপ্রাপ্ত ক্রীড়াবিদ এবং তরুণ প্রজন্মের একটা বড় অংশকে অন্ধকার দিকে প্রলুব্ধ করেছে বলেও মনে করা হয়। পুলিশ ২০২১ সালের মাঝামাঝি থেকে এমন ৫০০টিরও বেশি অপরাধমূলক গোষ্ঠীকে ভেঙে দিয়েছে। ১ হাজার ৪০০ জনেরও বেশি ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে; যারা ওই গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে যুক্ত।

পুলিশের সাথে সংঘর্ষে ১৬ জন নিহত এবং ৮০ জনেরও বেশি আহত হয়েছেন। সংঘর্ষে তিনজন পুলিশ অফিসারের মৃত্যু হয়েছে এবং ২৬ জন পুলিশ কর্মী আহত হয়েছেন। পুলিশ বলছে, এর সঙ্গে সম্পর্কিত চারটি মামলায় দোষী সাব্যস্ত হলেও খুনের মতো গুরুতর অপরাধের মামলাতে লরেন্স বিষ্ণোই এখনও দোষী সাব্যস্ত হননি।

লরেন্স বিষ্ণোইয়ের পরিপাটি করে ছাঁটা দাড়ি, হুডি দিয়ে প্রায় ঢাকা তার দুই সতর্ক চোখ। সাধারণত তার বয়সের অন্যান্য যুবকের মতোই বেশভূষায় দেখা যায় লরেন্স বিষ্ণোইকে। তবে পরিস্থিতি বিশেষে নিজের ভাবমূর্তি তুলে ধরার ক্ষেত্রে ‘চতুরতাও’ প্রদর্শন করতে দেখা যায়।

একবার আদালতে হাজিরার সময় তাকে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামী বিপ্লবী ভগৎ সিংয়ের ছবি আঁকা একটা টি-শার্ট পরতে দেখা গিয়েছিল। কারাগারে রেকর্ড করা একটা বহুল প্রচারিত ভিডিওতে তাকে বলতে শোনা গিয়েছিল, ‘‘আমাদের হৃদয়ে বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষা রয়েছে। দেখা যাক শত্রুপক্ষের শক্তি কতটুকু।’’ যদিও তার এই কথার সঠিক অর্থ অস্পষ্টই রয়ে গেছে।

লরেন্স বিষ্ণোইয়ের উত্থান অপরাধ জগতের সঙ্গে যুক্ত অন্য যে কোনও ব্যক্তির উত্থানের মতো নয়। কারাগারে থাকা সত্ত্বেও তিনি নিজের গোষ্ঠীকে পরিচালনা করছেন বলে মনে হয়। কে তাকে এর জন্য রসদ দিয়ে থাকে বা গণমাধ্যমের অ্যাক্সেস সরবরাহ করে? শক্তিশালী মিত্র ছাড়া এই জাতীয় নিয়ন্ত্রণ কিন্তু অসম্ভব, বলছেন সিং। তবে এসব বিষয় বরাবর অধরাই থেকে গেছে। বিবিসি বাংলা।

এসএস

Visit Source Page

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *