ব্রিকস সম্মেলন : সত্যিকার অর্থেই কি ঐক্যবদ্ধ শক্তি গড়ে উঠবে?

ব্রিকস সম্মেলন : সত্যিকার অর্থেই কি ঐক্যবদ্ধ শক্তি গড়ে উঠবে?

ভারত ও চীন তাদের সীমান্ত সমস্যা সত্ত্বেও, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশ তথা বাংলাদেশের উপর প্রভাব বিস্তার করতে ব্রিকসকে ব্যবহার করতে পারে।

ব্রিকস জোট তার প্রাথমিক পাঁচটি সদস্য দেশ থেকে সম্প্রসারিত হয়ে নয়টি দেশে পরিণত হয়েছে। মিসর, ইথিওপিয়া, ইরান এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের যুক্ত হওয়া এই জোটকে আরও বেশি বহুমাত্রিক এবং বৈশ্বিক করেছে। এছাড়া প্রায় তিন ডজন দেশ ব্রিকসে যোগ দেওয়ার জন্য আবেদন করেছে, যা ব্রিকসের শক্তিশালী প্রভাবের প্রমাণ।

বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির একটি জোট হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার মাধ্যমে, ব্রিকস এখন জি-৭-এর বিকল্প একটি শক্তি কেন্দ্র হিসেবে কাজ করতে পারে। জনসংখ্যার দিক থেকে এই সম্প্রসারিত জোট বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪৬ শতাংশকে প্রতিনিধিত্ব করে, যা জি-৭-এর মাত্র ৮.৮ শতাংশের তুলনায় অনেক বৃহৎ। এই সম্প্রসারণ বৈশ্বিক অর্থনীতি এবং বাণিজ্যে বিশাল প্রভাব ফেলতে পারে।

ব্রিকসের সদস্য দেশগুলো যেমন চীন এবং ভারত ইতিমধ্যেই বৃহৎ অর্থনৈতিক শক্তি এবং সম্প্রসারিত সদস্য দেশগুলোর সংযোজনের ফলে এই জোটের আর্থিক এবং বাণিজ্যিক প্রভাব আরও বাড়বে। এটির পাশাপাশি ব্রিকস প্লাস জোট এখন পশ্চিমা দেশগুলোর ওপর নির্ভরতা কমাতে এবং একটি স্বাধীন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নীতি গড়ে তোলার দিকে মনোযোগ দিচ্ছে।

ব্রিকসের (BRICS) সাম্প্রতিক শীর্ষ সম্মেলনটি ২০২৪ সালের ২২ থেকে ২৪ অক্টোবর রাশিয়ার কাজান শহরে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ সম্মেলন বিশ্ব অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়, যেখানে উন্নয়নশীল দেশগুলো পশ্চিমা অর্থনৈতিক আধিপত্য থেকে মুক্তির উপায় নিয়ে আলোচনা করা হবে।

ব্রিকস সহযোগিতা মডেলটি উন্নয়নশীল দেশগুলো নতুন অর্থনৈতিক পরিসরে উন্নয়নের সুযোগ প্রদানের জন্য তৈরি করা হয়েছে। পশ্চিমা শক্তির অধীন অর্থনৈতিক মডেল থেকে সরে এসে, বৈশ্বিক অর্থনীতিতে নতুন ধারার বিকাশের প্রয়োজনীয়তাও এ সম্মেলনে তুলে ধরা হয়। আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলোর দীর্ঘদিনের আধিপত্য রয়েছে। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে গড়ে ওঠা এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পশ্চিমা দেশের আধিপত্যকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হয়েছে। তবে, বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে, বিশেষ করে সাম্প্রতিক বছরগুলোয়, এই ব্যবস্থার সংকটগুলো আরও প্রকট হয়েছে। অর্থনৈতিক অসমতা, বাণিজ্য যুদ্ধ এবং আর্থিক সংকট এই ব্যবস্থার গভীর সংকটের প্রমাণ দিচ্ছে।

পশ্চিমা বিশ্বের নেতৃত্বে গঠিত বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কাঠামো বহু দশক ধরে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বাণিজ্যের ওপর প্রভাব বিস্তার করেছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জি-৭ এবং অন্যান্য পশ্চিমা সংস্থাগুলো বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক নিয়ম ও প্রভাব নিয়ন্ত্রণ করেছে। কিন্তু ব্রিকস তার সম্প্রসারণের মাধ্যমে এই হেজিমনিক ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করতে চাইছে।

তবে এটি করতে গিয়ে, ব্রিকসের সদস্যদের মধ্যে মতপার্থক্য এবং তাদের অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জগুলোও রয়েছে। চীন ও রাশিয়া এই জোটের মধ্যে পশ্চিমা আধিপত্যের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় বিরোধী শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এই দুই দেশ যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থার বিপক্ষে সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে প্রস্তুত। চীন, যার অর্থনীতি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম এবং রাশিয়া, যার ভূরাজনৈতিক অবস্থান পশ্চিমা দেশের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে, তারা জোটের ভেতরে সবচেয়ে আগ্রাসী ভূমিকায় আছে।

অন্যদিকে ব্রাজিল ও ভারত তাদের পশ্চিমা সম্পর্ককে পুরোপুরি ত্যাগ করতে চাইছে না। তারা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আরও ভারসাম্যপূর্ণ নীতি গ্রহণের পক্ষে। ব্রাজিল এবং ভারত উভয় দেশই পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বজায় রাখতে চায় এবং তারা বৈশ্বিক ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে কোনো সংঘাত এড়াতে আগ্রহী।

এটি একটি মৌলিক চ্যালেঞ্জ তৈরি করে যে, ব্রিকস কি সত্যিকার অর্থেই একটি ঐক্যবদ্ধ শক্তি হিসেবে গড়ে উঠতে পারবে? নাকি এর সদস্য দেশগুলোর মধ্যকার মতভেদ এর ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে?

ভারত ও চীনের মতো দুটি বৃহত্তম অর্থনীতি ব্রিকসের অন্যতম প্রধান শক্তি হিসেবে রয়েছে। এই দুই দেশের ব্রিকসের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ায় একটি বিকল্প শক্তি কেন্দ্র গড়ে তোলার সম্ভাবনা রয়েছে। ভারত ও চীন তাদের সীমান্ত সমস্যা সত্ত্বেও, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশ তথা বাংলাদেশের উপর প্রভাব বিস্তার করতে ব্রিকসকে ব্যবহার করতে পারে।

দক্ষিণ এশিয়ার ছোট ছোট দেশগুলো যেগুলো পশ্চিমা দেশের চাপের মধ্যে রয়েছে, তারা ব্রিকসের একটি বিকল্প অর্থনৈতিক মডেল থেকে উপকৃত হতে পারে। তবে, ভারত ও চীনের মধ্যকার প্রতিযোগিতামূলক সম্পর্ক ব্রিকসের মধ্যে একটি অন্তর্দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করতে পারে। যদি এই দুই দেশ নিজেদের মধ্যে সমঝোতা করতে সক্ষম হয়, তাহলে দক্ষিণ এশিয়ায় ব্রিকসের ভূমিকা আরও প্রভাবশালী হতে পারে। কিন্তু যদি এই প্রতিযোগিতা আরও বাড়ে, তবে ব্রিকস দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষেত্রে তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখতে পারবে না।

ব্রিকস দেশগুলো উন্নয়নশীল দেশগুলোর স্বার্থ রক্ষার জন্য সমতাভিত্তিক বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। বর্তমানে, বিশ্ব অর্থনীতিতে পশ্চিমা দেশগুলো বাণিজ্যিক সম্পর্কের ওপর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ রাখে। এই পরিস্থিতিতে, ব্রিকস দেশগুলো একটি নতুন মডেল তৈরি করার প্রয়াস চালাচ্ছে, যেখানে প্রত্যেক দেশ স্বাধীনভাবে তাদের অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারণ করতে পারবে এবং আর্থিক স্বাধীনতা বজায় রাখতে পারবে।

ব্রিকস দেশগুলো আর্থিক হেজিমনি মোকাবিলার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন SWIFT আর্থিক লেনদেন ব্যবস্থা দীর্ঘদিন ধরে বৈশ্বিক আর্থিক লেনদেনের কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে আসছে। তবে, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বিশেষ করে রাশিয়ার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞার পর থেকে, এই ব্যবস্থা রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্র SWIFT সিস্টেমকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক আর্থিক লেনদেনকে নিয়ন্ত্রণ করছে। এই পরিস্থিতি উন্নয়নশীল দেশগুলোর আর্থিক স্বাধিকারকে হুমকির মুখে ফেলেছে। এই প্রেক্ষাপটে, ব্রিকস দেশগুলো SWIFT-এর বিকল্প একটি আর্থিক লেনদেন ব্যবস্থা তৈরি করার প্রয়াস চালাচ্ছে, যা তাদের নিজস্ব আর্থিক স্বাধিকার রক্ষা করতে সক্ষম হবে।

পশ্চিমা আধিপত্যের অর্থনৈতিক মডেলটি বাণিজ্য, বিনিয়োগ এবং আর্থিক নিয়ন্ত্রণের ওপর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। এই মডেলটি বিশেষভাবে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষে কাজ করেছে। তবে, উন্নয়নশীল দেশগুলো তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য এই মডেল থেকে সরে আসার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে।

ব্রিকস একটি সম্ভাবনাময় মডেল, যা পশ্চিমা আধিপত্য থেকে সরে এসে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য একটি সমতাভিত্তিক অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলার সুযোগ সৃষ্টি করছে। যদিও ব্রিকস এখনো একটি সম্পূর্ণ বিকল্প মডেল হিসেবে গড়ে ওঠেনি, তবে এটি অর্থনৈতিক বিকাশের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। 

ব্রিকস তার সম্প্রসারণের মাধ্যমে বৈশ্বিক কূটনীতিতে একটি নতুন মঞ্চ তৈরির চেষ্টা করছে। ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রাশিয়া পশ্চিমা দেশগুলোর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে এবং এই বিচ্ছিন্নতা ব্রিকসকে আরও শক্তিশালী করেছে। রাশিয়া তার কৌশলগত ও অর্থনৈতিক সম্পর্কগুলো ব্রিকসের মধ্যে পুনর্গঠন করার চেষ্টা করছে। পশ্চিমা বিশ্ব রাশিয়াকে বৈশ্বিক অঙ্গন থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করলেও, ব্রিকসের মাধ্যমে রাশিয়া তার গুরুত্ব বজায় রাখার সুযোগ পেয়েছে।

একইভাবে, চীনও ব্রিকসের মাধ্যমে তার কূটনৈতিক অবস্থানকে শক্তিশালী করতে চায়। বিশেষ করে, আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সাথে তার বাণিজ্যিক সম্পর্কগুলো ব্রিকসের মধ্য দিয়ে আরও গভীর হচ্ছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিসর, ইথিওপিয়ার মতো দেশের যোগদান চীনের এই কৌশলকে আরও শক্তিশালী করছে।

তবে, পশ্চিমা দেশগুলো ব্রিকসের এই সম্প্রসারণকে তাদের বৈশ্বিক আধিপত্যের জন্য একটি হুমকি হিসেবে দেখছে। তাই, ব্রিকসের মধ্যে থাকা বিভিন্ন দেশগুলোর মধ্যে ঐক্য বজায় রাখা এবং তাদের অভ্যন্তরীণ সমস্যা সমাধান করাই হবে ভবিষ্যতের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

ব্রিকসের সম্প্রসারণের মাধ্যমে বিশ্ব রাজনীতি এবং অর্থনীতিতে একটি নতুন ধারা গড়ে উঠতে পারে। পশ্চিমা আধিপত্যের বিকল্প হিসেবে একটি নতুন শক্তি কেন্দ্র তৈরি করার জন্য ব্রিকসকে তার সদস্য দেশগুলোর মধ্যে ঐক্য ও সহযোগিতা বাড়াতে হবে। তবে এই নতুন মডেল কতটা কার্যকর হবে, তা অনেকাংশেই নির্ভর করবে ব্রিকসের নেতৃত্ব এবং সদস্য দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ কৌশলগুলোর ওপর।

ব্রিকস যদি সঠিকভাবে তার সম্প্রসারণ পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন করতে পারে, তাহলে এটি একটি নতুন বৈশ্বিক অর্থনৈতিক এবং কূটনৈতিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে।

অধ্যাপক ড. সুজিত কুমার দত্ত ।। সাবেক সভাপতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

 

Visit Source Page

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *