বৈষম্যহীন সমাজের প্রত্যাশায়

বৈষম্যহীন সমাজের প্রত্যাশায়

গণঅভ্যুত্থানে সমাজের নানান শ্রেণি পেশার মানুষের অংশগ্রহণ থাকে। তাদের অকৃত্রিম অবদান থাকে। তাদের সক্রিয় অংশীদারিত্ব থাকে। ফলে, অংশীদারিত্বের দাবিদার হিসেবে অর্জনের ভাগ চাইবে এটা খুবই স্বাভাবিক।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে সাধারণ শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে আগস্টের ৫ তারিখ একটি ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছর রাজত্বের সমাপ্তি ঘটে। যাত্রা শুরু হয় এক নতুন বাংলাদেশের।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে। ফলে, চতুর্দিকে প্রত্যাশার পারদ ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। এবং সেটা খুবই স্বাভাবিক। গণঅভ্যুত্থানে সমাজের নানান শ্রেণি পেশার মানুষের অংশগ্রহণ থাকে। তাদের অকৃত্রিম অবদান থাকে। তাদের সক্রিয় অংশীদারিত্ব থাকে। ফলে, অংশীদারিত্বের দাবিদার হিসেবে অর্জনের ভাগ চাইবে এটা খুবই স্বাভাবিক।

পৃথিবীর গণঅভ্যুত্থানের ইতিহাসে অভ্যুত্থান-পরবর্তী রাষ্ট্র নির্মাণে অংশীজনের এসব দাবি-দাওয়াকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। এরকম অসংখ্য দৃষ্টান্ত আছে। বাংলাদেশে বিষয়টি দুইটি জায়গা থেকে প্রাসঙ্গিক—এক. এ আন্দোলন ছিল বৈষম্য বিরোধিতার দর্শনে প্রাণিত এবং দুই. শিক্ষার্থীরাই ছিল এ আন্দোলন এবং অভ্যুত্থানের মূল নেতৃত্বে।

ফলে, আজকের শিক্ষার্থীরাই যেহেতু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ এবং শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় যখন তারা সমাজে বিদ্যমান বৈষম্যের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলে সরকারের পতন ঘটাতে সমক্ষ হয়, তখন স্বাভাবিক কারণে তাদের কাছে প্রত্যাশা থাকবে বৈষম্যহীন সমাজ নির্মাণেও তাদের সুদৃঢ় অবস্থান থাকবে।

আর বৈষম্যহীন সমাজ নির্মাণই হবে রাষ্ট্র সংস্কারের মূলমন্ত্র। তাই, বৈষম্যহীন সমাজের প্রত্যাশা আমাদের সবার। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, রাষ্ট্রের কোন কোন জায়গায় সংস্কার করলে সমাজে সত্যিকার সাম্য বিরাজ করবে এবং বৈষম্য দূরীভূত হবে?  

সমাজের অনেকগুলো জায়গার মধ্যে অন্যতম দু’টি হচ্ছে বহুমুখী শিক্ষার মৌলিক সংস্কার এবং ধ‍‍র্মীয় ও জাতিগত বিদ্বেষ দূরীকরণ। এ দু’টি ক্ষেত্রে যদি বৈষম্য দূর করা সম্ভব হয়, তাহলে বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ অনেকটা এগিয়ে যাবে বলে আমি মনে করি।

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় জারি আছে বহুমুখী শিক্ষা। এখানে প্রাথমিক পর্যায় থেকেই সমাজের মানুষের অর্থনৈতিক সক্ষমতা এবং বিদ্যমান শ্রেণি বিভাজনের বিবেচনায় শিক্ষার কাঠামো নানানভাবে বিভক্ত। বিশেষ করে ইংরেজি মাধ্যম, বাংলা মাধ্যম এবং মাদ্রাসা শিক্ষার নামে কোমলমতি শিশুদের শিক্ষা প্রদানের শুরুতেই এক ধরনের বিভক্তি ও বিভাজনের ভেতর দিয়ে যেতে হয়।

সমাজে যাদের আর্থিক সক্ষমতা আছে এবং সমাজে উচ্চবিত্ত বা উচ্চ-মধ্যবিত্তের অর্থনৈতিক ক্যাটাগরিতে বাস করে, তাদের ছেলেমেয়েরা সাধারণত ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করে। আর সাধারণ মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও কিছু কিছু নিম্নবিত্ত বর্গের মানুষের সন্তানরা বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনা করে (তার মধ্যেও আছে আবার সরকারি ও প্রাইভেট স্কুল), আর সমাজের আরেকটা শ্রেণির মানুষ তাদের সন্তানদের মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিত করে। ফলে শিক্ষার ক্ষেত্রে এই যে বহুমুখী প্রবণতা, এর কারণে সমাজে এক ধরনের বিভক্তি এবং বৈষম্য তৈরি করে।

আবার অনেকে তাদের সন্তানদের ইংরেজি মাধ্যমে পড়ানোর আর্থিক সক্ষমতা না থাকলেও তারা চায় তাদের ছেলেমেয়েরা ইংরেজিতে পড়াশোনা করুক। ফলে, এ শ্রেণির ইচ্ছে মেটানোর জন্য বাংলা মাধ্যমের ভেতরেই আবার সৃষ্টি করা ‘ইংরেজি ভার্সন’ বলে আরেকটা বর্গ।

প্রাথমিক শিক্ষার পর মাধ্যমিক শিক্ষা, উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গিয়েও সেই প্রাথমিক শিক্ষায় যে বহুমুখিতা, তার ভিত্তিতেই যে সমাজে ভিন্ন ভিন্ন সামাজিক বর্গ তৈরি হয়, সেটা শিক্ষার শেষ পর্যায়ে গিয়েও অবশিষ্ট থাকে। ফলে প্রাথমিক পর্যায়ে বাংলাদেশের বিদ্যমান বহুমুখী শিক্ষাব্যবস্থা যে শ্রেণি ও বর্গ তৈরি, করে সেটা শিক্ষার শেষ পর্যায়েও অবশিষ্ট থাকে বিধায় পুরো সমাজদেহে এক ধরনের স্তরবিন্যাসের সৃষ্টি হয়।

যেহেতু আর্থিকভাবে সচ্ছল এবং অর্থনৈতিক সক্ষমতার বিবেচনায় উচ্চবিত্ত ও উচ্চ-মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেমেয়েরা ইংরেজি মাধ্যমে পড়ে এবং তাদের বড় একটা অংশ দেশের বাইরে চলে যায় উচ্চশিক্ষার জন্য। তাদের অনেকে আর দেশে ফিরে আসে না।

অন্যদিকে সাধারণ শিক্ষায় যারা গ্র্যাজুয়েট হয় তারাও জব মার্কেটে গিয়ে একটা নিজস্ব বর্গ এবং বলয় তৈরি করে। ফলে, শিক্ষার বহুমুখিতা যেটা প্রাথমিক স্তরে শুরু হয় সেটার প্রভাব থাকার কারণে সমাজে বৈষম্য সৃষ্টি হয়। সুতরাং সমাজ থেকে বৈষম্য দূর করার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের দর্শন হিসেবে যে রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ চলছে, সেখানে শিক্ষায় সংস্কার অত্যন্ত জরুরি।

বিশেষ করে প্রাথমিক পর্যায়ে থেকে শিক্ষার যে বহুমুখী ব্যবস্থা সেটা কী করে একটি একমুখী শিক্ষা নীতির আওতায় নিয়ে এসে ভবিষ্যতে যাতে শিক্ষার কারণে যাতে সমাজে কোনো বৈষম্য সৃষ্টি না হয়, তার জন্য সুচিন্তিত একটা শিক্ষানীতি তৈরি করা জরুরি এবং শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার জরুরি। শিক্ষার মৌলিক কাজ যেখানে বৈষম্য দূরীকরণ, সেখানে শিক্ষাই সমাজে সবচেয়ে বড় বৈষম্য সৃষ্টি করছে। এটা অনাকাঙ্ক্ষিত ও অনভিপ্রেত।

অন্য আরেকটি ক্ষেত্রে বিশেষ করে সমাজে বিদ্যমান ধ‍‍র্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সুরক্ষা নিশ্চিত এবং সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে হলে দ্রুততম সময়ে সমাজে বিদ্যমান বৈষম্য দূরীকরণের উদ্যোগ নিতে হবে। সংবাদপত্রের তথ্যানুযায়ী এবং বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ ও বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের তথ্যানুযায়ী শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর কেবল ৫ ও ৬ আগস্ট সারাদেশে ৫২টি জেলায় কমপক্ষে ২০৫টি সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটেছে।

বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের অন্যতম সভাপতি নির্মল রোজারিও, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক প্রেস কনফারেন্সে বলেন, ‘অনেক মন্দির হামলার পর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, অনেক নারী নিগৃহীত হয়েছেন। কয়েকটি স্থানে হত্যার ঘটনাও ঘটেছে। আক্রান্ত হয়েছে অন্য সংখ্যালঘুরাও। মূলত ৫ আগস্ট থেকে এই সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। সারা দেশের সংখ্যালঘুদের মধ্যে গভীর শঙ্কা, উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তা ছড়িয়ে পড়েছে।’

বাংলাদেশ সৃষ্টির পর থেকেই ধ‍‍র্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর সাম্প্রদায়িক হামলা চলছে। সুতরাং, এটা বাংলাদেশে নতুন নয়। আমি পত্রিকান্তরে লিখেছি, ২০২২ এর জুলাই থেকে ২০২৩ এর জুন পর্যন্ত এক বছরে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় সংঘটিত মোট সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ১ হাজার ৪৫টি।

উইকিপিডিয়ার ডাটাবেজ অনুযায়ী, এর মধ্যে ৪৫টি হত্যাকাণ্ড, ৭টি মরদেহ উদ্ধারের ঘটনা, ১০ জনকে হত্যার চেষ্টা, ৩৬ জনকে হত্যার হুমকি, ৪৭৯ জনকে হামলা বা নির্যাতন, ১১ জনের কাছে চাঁদা দাবি, ১০২টি হামলা বা ভাঙচুরের ঘটনা, ৪৭টি জমি দখলের ঘটনা, ৪৫টি দখল বা উচ্ছেদের হুমকির ঘটনা, ১১টি দেশত্যাগের হুমকি, ১৫টি দেবোত্তর সম্পত্তি দখলের চেষ্টা, ৭টি শ্মশানভূমি দখলের চেষ্টা, ১৪টি মন্দিরে হামলা, ৪০টি প্রতিমা ভাঙচুর, ২৫টি ধর্ষণ বা ধর্ষণের চেষ্টা, ১২টি অপহরণ বা ধর্মান্তরকরণের ঘটনা, ৮ জন ধর্ম অবমাননার অভিযোগে আটক, ৩২টি জাতীয় নির্বাচনে এবং ৫টি স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে।

তাই, রাষ্ট্র সংস্কারের অংশ হিসেবে গুরুত্বের সাথে সমাজে বিদ্যমান এ ধ‍‍র্মীয় ও জাতিগত বৈষম্য দূর করতে হবে। বৈষম্য দূরীকরণের যে অঙ্গীকার নিয়ে দেশে গণঅভ্যুত্থান হয়েছে, সেটার সামাজিক ও বাস্তবিক অনুবাদ করতে হলে, ধ‍‍র্মীয় ও জাতিগত দূর করতে হবে। 

আশার কথা হচ্ছে, সাম্প্রদায়িক হামলার পাশাপাশি এবার কিছু চমৎকার দায়িত্বশীলতার চিত্রও দেখা গেছে। দুর্বৃত্তরা যখন একের পর এক ধ‍‍র্মীয় সংখ্যালঘুর ঘর-বাড়ি, বসত-ভিটা এবং মন্দিরে হামলা করার চেষ্টা করছে, তখন সাধারণ শিক্ষার্থীরা, স্থানীয় জনগণ, এমনকি কিছু মাদ্রাসার শিক্ষার্থীও রাত জেগে পাহারা দিয়ে সনাতনধ‍‍র্মীদের ঘরবাড়ি ও মন্দিরের সুরক্ষা দিয়েছে।

মূলধারার মিডিয়া এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তা বেশ গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ ও প্রচার করেছে। নিঃসন্দেহে এটা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির একটি চমৎকার নজির স্থাপন করেছে।

তাই, আমরা আজকের তরুণ প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের ওপর আস্থা রাখতে চাই; তাদের ওপর বিশ্বাস রাখতে চাই এবং তাদের অঙ্গীকারের ওপর ভরসা রাখতে চাই। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ফসল বাংলাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা এবং বাংলাদেশে বসবাসরত ধ‍‍র্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায় পাবে।

একটি সত্যিকার বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে হলে, প্রথমেই তার শিক্ষাব্যবস্থার অভ্যন্তরীণ ভুল শোধরাতে হবে এবং সমাজে বসবাসরত সব ধর্ম, বর্ণ, জাতি, লিঙ্গ এবং বিশ্বাস নির্বিশেষে সকলের সমমর্যাদার সহাবস্থান নিশ্চিত করতে হবে। মনে রাখতে হবে—

‘ছোটদের বড়দের সকলেরগরিবের নিঃস্বের ফকিরেরআমার এ দেশ সব মানুষের, সব মানুষের।।’

ড. রাহমান নাসির উদ্দিন ।। নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

Visit Source Page

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *