বাংলাদেশের শিল্প ও ব্যবসা খাত : যা করণীয়

বাংলাদেশের শিল্প ও ব্যবসা খাত : যা করণীয়

কোভিড মহামারি, ইউক্রেন যুদ্ধ, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা সবকিছুরই নেতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশের শিল্প ও ব্যবসা খাতের ওপরে পড়েছে—উৎপাদন ও কর্মনিয়োজন উভয় ক্ষেত্রেই।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে শিল্প ও ব্যবসা খাতের গুরুত্ব তিনদিক থেকে বোঝা যায়—জাতীয় আয়ে এর গুরুত্ব, কর্ম নিয়োজনে এর অবদান এবং রপ্তানি আয়ে এর ভূমিকা। বাংলাদেশের জাতীয় আয়ের প্রায় ৩৮ শতাংশ আসে শিল্পখাত থেকে।

বলা প্রয়োজন যে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় আয়ে শিল্প খাতের অবদান উত্তরোত্তর বেড়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যতজন মানুষ কাজ করেন, তার প্রতি চারজনের একজন নিয়োজিত শিল্পখাতে। ২০২৩ সালে পোশাক খাতের রপ্তানি থেকে বাংলাদেশে প্রায় ৪৭ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে। বাংলাদেশের জাতীয় আয়ে সেবাখাতের অংশ প্রায় ৫৩ শতাংশ এবং এ অর্থনীতিতে কর্ম নিয়োজিত জনশক্তির ৪১ শতাংশ সেবাখাতে কাজ করেন। সেবাখাতের একটি বড় অংশ হচ্ছে ব্যবসা।

তবে যদিও বাংলাদেশের শিল্প ও ব্যবসা খাতকে মোটাদাগে আমরা সমসত্তাসম্পন্ন বলে মনে করছি, আসলে কিন্তু এর গঠন ও প্রকৃতির মধ্যে নানান বিভাজন ও বৈচিত্র্য আছে। শিল্প ও ব্যবসার মধ্যে মৌলিক তফাত আছে, এ খাতে বড়, মাঝারি এবং ছোট শিল্প ও ব্যবসা আছে, এখানে আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠান যেমন আছে তেমনি আছে অনানুষ্ঠানিক কাঠামো। বাংলাদেশের শিল্প ও ব্যবসা খাতের বিশ্লেষণ ও নীতিমালার ক্ষেত্রে এসব পার্থক্যের কথা মনে রাখা প্রয়োজন। 

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দেখা গেছে যে, বহির্বিশ্বের ঘটনাপ্রবাহ যেমন বাংলাদেশের শিল্প ও ব্যবসা খাতকে প্রভাবিত করেছে, তেমনি এ খাতের নানান অন্তর্নিহিত দুর্বলতাও এ খাতের বিকাশে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সাম্প্রতিক সময়ে কোভিড মহামারি, ইউক্রেন যুদ্ধ, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা সবকিছুরই নেতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশের শিল্প ও ব্যবসা খাতের ওপরে পড়েছে—উৎপাদন ও কর্মনিয়োজন উভয় ক্ষেত্রেই। আমাদের পোশাক শিল্পের রপ্তানির ক্ষেত্রেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি।

অভ্যন্তরীণ নানা বিষয়ও বাংলাদেশের শিল্প ও ব্যবসাখাতের ওপরে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলেছে—এর কিছু নীতিমালা-দুর্বলতা প্রসূত, কিছু প্রাতিষ্ঠানিক-দুর্বলতা প্রসূত। নীতিমালার ক্ষেত্রে যথাযথ প্রণোদনা সঠিক শিল্পকে দেওয়া হয়নি।

মুদ্রানীতি, ঋণনীতি, করনীতির ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক, পক্ষপাতমূলক নীতিমালার কারণে বহু শিল্প ও ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বৈদেশিক বাণিজ্য খাতে এ জাতীয় নীতি রপ্তানি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করেছে।

কোভিড মহামারি, ইউক্রেন যুদ্ধ, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা সবকিছুরই নেতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশের শিল্প ও ব্যবসা খাতের ওপরে পড়েছে—উৎপাদন ও কর্মনিয়োজন উভয় ক্ষেত্রেই।

রাজনৈতিক কারণে বহু শিল্পকে নানান অবৈধ সুবিধা দেওয়া হয়েছে। দলগত কারণে অন্যায়ভাবে নিষ্পেষিত হয়েছে নানান শিল্প। রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় ফুলে-ফেঁপে উঠেছে নানা ব্যবসা। এরা অবৈধ ঋণ সুবিধা পেয়েছে, কিন্তু ঋণ ফেরত দেয়নি, ঋণের অর্থ আত্মসাৎ করেছে, খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে। এইসব শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দেশের বাইরে অর্থ পাচার করেছে।

শিল্প ও ব্যবসার বলয়ে অনানুষ্ঠানিক খাত তার প্রার্থিত প্রণোদনা পায়নি। ঋণনীতি বা করনীতি এই খাতকে যেসব সহায়তা প্রদান করা উচিত ছিল, তা করা হয়নি। তাদের সাহায্য করা হয়নি জুতসই প্রযুক্তির ক্ষেত্রে। এ খাতকে প্রয়োজনীয় পরিমাপে রপ্তানীমুখী করা হয়নি। ফলে তারা তাদের সৃষ্টিশীলতা, সৃজনশীলতা এবং সম্ভাবনাকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারেনি।

এর অনেককিছুই সম্ভব হয়েছে কারণ শিল্প ও ব্যবসার ক্ষেত্রে একটি সার্বিক প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণ কাঠামো গড়ে তোলা যায়নি। যা করা হয়েছে, তা খণ্ডিতভাবে এবং যেটুকু কাঠামো ছিল, সেটাকেও ব্যবহার করে একটি ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করা যায়নি রাজনৈতিক ও দলীয় হস্তক্ষেপের কারণে, আইনের অনুশাসনের অনুপস্থিতির কারণে, মাস্তান-সংস্কৃতির লুটপাটের কারণে।

সবকিছু মিলিয়ে তৈরি হয়েছে দুর্নীতির কাঠামো, শ্রমিকদের অধিকার হরণ করার প্রক্রিয়া এবং মুনাফার পাহাড় গড়ার প্রচেষ্টা। এইসব কার্যকারণের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থান-সম্পৃক্ত অস্থিরতা এবং অনিশ্চয়তা।

অস্থিরতার উৎস হচ্ছে পারিপার্শ্বিক সামাজিক অস্থিরতা—যে অস্থিরতা ব্যক্তিগত মানুষ, গোষ্ঠী সত্তা এবং সামাজিক জীবনে। অনিশ্চয়তার কারণ হচ্ছে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা-কতদিন লাগবে বাংলাদেশ অর্থনীতিকে তার আগের জায়গায় ফিরিয়ে নিতে, কেমন হবে আগামী দিনের সামষ্টিক অর্থনৈতিক কৌশল। সেই সঙ্গে এটাও বলা দরকার যে অভ্যুত্থান পরবর্তী অবস্থা একটি সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে সংস্কারের-যে সংস্কার শিল্প ও ব্যবসা খাতেও ব্যপ্ত হবে।

উপযুক্ত প্রেক্ষিতের পরিপ্রেক্ষিতে নিম্নোক্ত নীতিমালা এবং কৌশলগুলো বিবেচনা করা যেতে পারে স্বল্প এবং মধ্যমেয়াদে—

প্রথমত, শিল্প ও ব্যবসা খাতের উদ্যোক্তা এবং শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বসে তাদের আশ্বস্ত করতে হবে যে এ খাতের উদ্যোক্তা ও শ্রমিক স্বার্থ সংরক্ষিত হবে।

সেই সঙ্গে নিশ্চিত করতে হবে যে এ খাতকে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করা হবে এবং এ খাতের সাহায্যকল্পে প্রয়োজনীয় সামষ্টিক এবং খাতওয়ারী নীতিমালা গ্রহণ করার হবে। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে অতিসত্বর একটি নতুন সামগ্রিক শিল্পনীতি প্রণয়ন করা অত্যন্ত প্রয়োজন।

নারী কর্মশক্তির বড় অংশ অনানুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত। প্রাসঙ্গিক নীতিমালার মাধ্যমে তাদের আশ্বস্ত করতে হবে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে তাদের ভূমিকা সংহত করতে প্রয়োজনীয় সবকিছুই করা হবে।

দ্বিতীয়ত, শিল্পখাতকে সচল এবং বেগবান করার জন্য এই মুহূর্তে যেসব উৎপাদন উপকরণ প্রয়োজন হবে, তার লভ্যতা নিশ্চিতকরণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করা। এ জন্য জোগান ব্যবস্থাকে ক্রিয়াশীল করা প্রয়োজন। উপকরণ জোগান ও প্রাপ্তি যদি আমদানি-নির্ভর হয়, তাহলে সেই প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ, দক্ষ এবং কার্যকর করা প্রয়োজন।

তৃতীয়ত, শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান স্বস্তি পাবে এবং আশ্বস্ত হবে যদি এটা নিশ্চিত করা যায় যে তাদের কর্মকাণ্ড কোনো রাজনৈতিক সুবিধা, পক্ষপাত বা পৃষ্ঠপোষকতার ভিত্তিতে হবে না, তা হবে অর্থনৈতিক দক্ষতা, সমতার লক্ষ্য, পরিবেশ-বন্ধুত্বের জন্য।

রাষ্ট্রীয় নীতিমালা সেই লক্ষ্যেই পরিচালিত হবে। সেই সঙ্গে শিল্প প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসার কার্যক্রমের প্রক্রিয়া দৃশ্যমান ও সহজ করে দিতে হবে যাতে শিল্পপ্রতিষ্ঠান বা ব্যবসা অযথা হয়রানির শিকার না হয়।

চতুর্থত, শিল্পখাত ও ব্যবসায় প্রয়োজনীয় প্রণোদনার জন্য মুদ্রা, ঋণ, কর, বাণিজ্য ও আমদানি-রপ্তানি নীতিসমূহ শিল্প ও ব্যবসাবান্ধব করা দরকার। এ প্রক্রিয়ায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিশেষ চাহিদাকে মনে রেখে জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে নীতিমালা কাঠামেতে।

পঞ্চমত, শিল্প ও ব্যবসা বলয়ে অনানুষ্ঠানিক খাতের জন্য আলাদা প্রণোদনার প্রয়োজন হবে। প্রচলিত নীতি কাঠামোর বাইরে এই খাতের সৃষ্টিশীলতা এবং সৃজনশীলতাকে পরিপূর্ণ সম্ভাবনায় নিয়ে যাওয়ার জন্যে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। প্রযুক্তি ক্ষেত্রেও নানান প্রণোদনার প্রয়োজন আছে।

ষষ্ঠত, শিল্প এবং ব্যবসার প্রণোদনা কাঠামোতে নারী উদ্যোক্তাদের জন্যে বিশেষ সহায়তা ব্যবস্থা থাকবে। এখানে মনে রাখা দরকার যে, নারী কর্মশক্তির বড় অংশ অনানুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত। প্রাসঙ্গিক নীতিমালার মাধ্যমে তাদের আশ্বস্ত করতে হবে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে তাদের ভূমিকা সংহত করতে প্রয়োজনীয় সবকিছুই করা হবে।

সপ্তমত, শিল্পখাতে এবং ব্যবসায় যেসব প্রাতিষ্ঠানিক অন্তরায় রয়েছে, সেগুলো দূর করার জন্য নিয়ন্ত্রণ কাঠামোকে শক্ত আইনগত কাঠামোর ওপরে দাঁড় করাতে হবে, যেখানে সুশাসন থাকবে, দৃশ্যমানতা এবং দায়বদ্ধতা নিশ্চিত হবে।

ড. সেলিম জাহান ।। ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র

Visit Source Page

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *