বন্যা কেড়ে নিয়েছে সব, মাথা গোঁজার ঠাঁই পেতে আকুতি হাজারো মানুষের

বন্যা কেড়ে নিয়েছে সব, মাথা গোঁজার ঠাঁই পেতে আকুতি হাজারো মানুষের

ভারতের ডম্বুর লেকের বাঁধ খুলে দেওয়া ও কয়েক দিনের টানা ভারী বর্ষণের ফলে ভয়াবহ বন্যার সম্মুখীন হয় কুমিল্লার ১৪টি উপজেলার কয়েক লাখ মানুষ। বানের পানি নামতে শুরু করলে দৃশ্যমান হতে থাকে ক্ষয়ক্ষতির চিহ্ন।

ভারতের ডম্বুর লেকের বাঁধ খুলে দেওয়া ও কয়েক দিনের টানা ভারী বর্ষণের ফলে ভয়াবহ বন্যার সম্মুখীন হয় কুমিল্লার ১৪টি উপজেলার কয়েক লাখ মানুষ। বানের পানি নামতে শুরু করলে দৃশ্যমান হতে থাকে ক্ষয়ক্ষতির চিহ্ন।

স্মরণকালের ভয়াবহ এই বন্যায় শতশত পরিবারের ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গোমতীর ভেঙে যাওয়া বাঁধের কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার ষোলনল ইউনিয়নের বুড়বুড়িয়া অংশের মানুষ। বাঁধ ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে ধসে পড়েছে বহু মানুষের মাথা গোঁজার ঠাঁই, স্রোতে ভেসে গেছে ঘরের আসবাবপত্র। বানের পানি চলে যাওয়ার পর সেসব পরিবারের এখনো পুনর্বাসন হয়নি। ভেঙে যাওয়া ঘরবাড়ি নিয়ে অনিশ্চিত জীবনের মুখে নিম্ন আয়ের বাসিন্দারা।

গত ২২ আগস্ট রাত ১২টার দিকে গোমতীর বুড়বুড়িয়া অংশের বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করা শুরু করে। সেই পানি বাঁধের পূর্ব অংশের বুড়িচং, ব্রাহ্মণপাড়া, দেবিদ্বার, মুরাদনগরসহ বেশ কয়েকটি উপজেলার লাখ লাখ মানুষকে ভয়াবহ দুর্যোগের মুখে ফেলে। বন্যা আঁচ করতে পেরে কেউ কেউ ঘরের আসবাবপত্র, স্ত্রী-সন্তান ও গৃহপালিত পশুপাখি নিয়ে গোমতীর বাঁধের ওপর আশ্রয় নিলেও বেশির ভাগ মানুষই তা করতে পারেননি। নিরুপায় হয়ে জীবন বাঁচাতে আশ্রয় নিয়েছিলেন সড়কে, কেউ আবার দূরের আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে।

গোমতীর বাঁধ ভাঙার রাতেই বুড়িচং উপজেলার ৫টি ইউনিয়নের অন্তত ৪০টি গ্রাম প্লাবিত হয়। স্রোতের তীব্রতা এত বেশি ছিল যে বাঁধের মুখের বুড়বুড়িয়া এলাকার কয়েকশ ঘরবাড়ি লন্ডভন্ড হয়ে বানের জলের সঙ্গে ভেসে যায়। পরদিন থেকে নিম্নাঞ্চলের আরও বেশকিছু নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হতে থাকে। ভয়াবহ বন্যায় ভেসে গেছে শতশত মাছের ঘের, পশু-পাখির খামার। তলিয়ে গেছে হেক্টরের পর হেক্টর ফসলি জমি।

বানের পানিতে ঘরবাড়ি হারিয়ে দিশেহারা মানুষদের জন্য ত্রাণ সহায়তা নিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবী ছুটে এলেও পানি নামার পর সেসব মানুষদের পুনর্বাসনে নেই তেমন সাড়া। ফলে চোখের সামনে ঘরবাড়ি হারানো মানুষজন এখন পুনর্বাসনের জন্য তাকিয়ে আছেন সরকারের দিকে।

বুড়বুড়িয়া এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত দুলাল মিয়ার স্ত্রী শিউলি বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাঁধ ভাঙার সময় ট্রেনের মতো একটা শব্দ হয়েছে। কোনোরকম জীবন নিয়ে দৌড় দিয়ে বাঁধের ওপর গিয়ে উঠি। পরে এসে দেখি ঘরের সব ভেসে গেছে। আমাদের দুইটা ঘর ভেঙে পড়েছে। আমরা সেনাবাহিনীর কাছ থেকে চার বান টিন পেয়েছি। আর বিভিন্ন মাধ্যমে ৬০ হাজার টাকা নগদ সহায়তা পেয়েছি। কিন্তু এই অনুদান আমাদের জন্য পর্যাপ্ত নয়।

একই এলাকার আনিসুর রহমানের স্ত্রী রুজিনা আক্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার স্বামী ভ্যান চালিয়ে সংসার চালান। আমাদের ৭ ছেলে-মেয়ে। বন্যায় ঘরের একপাশের বেড়া ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ঘরের আসবাবপত্র সব ভেসে গেছে। সরকারের কাছে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি।

সরেজমিনে দেখা গেছে, বুড়বুড়িয়া, গাজিপুর, ইছাপুরা, ইন্দ্রাবতী এসব এলাকায় সবচেয়ে বেশি ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। এসব এলাকা নদীর তীরবর্তী ও নিম্নাঞ্চল হওয়ায় বেশির ভাগ মানুষই দিনমজুরের কাজ করেন। কেউ কেউ আবার বিত্তশালী হলেও সেই সংখ্যাটা খুবই নগণ্য। এসব এলাকার সিংহভাগ মানুষের জীবিকার অন্যতম উৎস চরের জমিতে কৃষিকাজ ও অটোরিকশা চালিয়ে জীবনযাপন করা। বন্যার পানির করাল গ্রাস সেসব মানুষদের ঘরবাড়ি কেড়ে নিয়ে বাড়িয়ে দিয়েছে দীর্ঘশ্বাস।

গত বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার বুড়বুড়িয়া গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, ভাঙন তীরবর্তী এলাকার ঘরবাড়িহারা মানুষ একচালা টিনের ছাউনি দিয়ে ত্রিপলের বেড়া দিয়ে কোনোরকম বেঁচে আছেন। পাশেই পড়ে আছে ধ্বংসস্তূপের চিহ্ন। ঘরবাড়ি, গাছপালা, বৈদ্যুতিক খুঁটিসহ, টয়লেট, হাঁস-মুরগির খোয়াড় থুবড়ে পড়ে আছে। কেউ কেউ সেসব পরিষ্কারের কাজ করছেন। সেসব মানুষদের জন্য সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে টিন ও নগদ অর্থ দিলেও তা অপ্রতুল বলে জানিয়েছেন বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তরা।

তারা জানান, বন্যার পানি কমে যাওয়ার পর সেনাবাহিনী ও বিভিন্ন সংস্থা থেকে চার বান করে টিন দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক প্রতি পরিবারকে নগদ ৬০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। তবে সেসব অনুদানে পুনর্বাসন কাজ সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন তারা। অপরদিকে এখন পর্যন্ত বানভাসি সেসব মানুষদের সরকারের তহবিল থেকে পুনর্বাসনের কোনো অনুদান দেওয়া হয়নি। বানের পানি শুধু ঘরবাড়ি কেড়ে নিয়েছে তা নয়, জলের স্রোতের সঙ্গে ঘরের মেঝে ও ভিটার মাটিও ভেসে গেছে। সৃষ্টি হয়েছে বড় গর্তের। ভিটা তৈরির মাটির ব্যবস্থা না করলে কোনোভাবেই পুনর্বাসনের কাজ করা যাবে না বলে জানিয়েছেন সেসব ক্ষতিগ্রস্ত মানুষজন।

অপরদিকে সেনাবাহিনীর দেওয়া টিন ও বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার দেওয়া অনুদান থেকেও বঞ্চিত হওয়ার অভিযোগ করেছেন অনেকেই। তাদের দাবি, স্থানীয় একটি চক্র পূর্ববিরোধের জের ধরে তাদের নাম বাদ দিয়েছেন। তবে ভয়ে তাদের নাম বলতে রাজি হননি বঞ্চিতরা।

তাদের একজন মো. গিয়াস উদ্দিন, বুড়বুড়িয়া গ্রামের নূরুল ইসলামের ছেলে। ভেঙে যাওয়া বাঁধের ৫০ গজের মধ্যেই তার ঘর। মানুষের জমিতে-খামারে দিনমজুরের কাজ করেন। বাঁধ ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে তার ঘরও ভাসিয়ে নেয় বানের পানি। অনেকেই টিন ও নগদ অর্থ পেলেও তিনি বঞ্চিত রয়েছেন সেসব থেকে।

গিয়াস উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে কী কারণে জানি না। বাঁধ ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে আমার ঘরটা ভেঙেছে। সবার আগে আমারই সহায়তা পাওয়ার কথা। আমার প্রতিবেশীরা টিন ও নগদ টাকা পেয়েছে। আমাকে একটা সুতাও দেওয়া হয়নি এখন পর্যন্ত। আমরা বৈষম্যের শিকার হয়েছি।

একই অভিযোগ সজীব মিয়া নামের এক যুবকের। তিনি বুড়বুড়িয়া এলাকার জামাল হোসেনের ছেলে। ভেঙে যাওয়া বাঁধের মুখেই ছিল তাদের ঘর। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, মুখ দেখে দেখে অনুদান দেওয়া হয়েছে। আমরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। ঘরের একটা পেরেকও খুঁজে পাইনি। অথচ আমাদেরকে বাদ রাখা হয়েছে অনুদান থেকে। যারা অনুদানের তালিকাগুলো করেছেন তারা আমাদের নাম কী কারণে বাদ রেখেছেন জানি না।

বুড়িচং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাহিদা আক্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা অনুদান দিচ্ছে। বন্যার্তদের পুনর্বাসনে সরকারি অনুদান বা বরাদ্দ এখনো আসেনি। আমরা যাচাই-বাছাই করে তালিকা তৈরি করছি, যাতে একজন মানুষও বাদ না পড়ে।

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসনের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বন্যায় জেলাজুড়ে ৮ হাজার ৬৭৪টি ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি বুড়িচং উপজেলায়। এ উপজেলায় ৪ হাজার ১৪৩টি ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। এ ছাড়া নাঙ্গলকোট উপজেলায় ৫০০টি, আদর্শ সদর উপজেলায় ১ হাজার ৫০০টি, চৌদ্দগ্রামে ১ হাজার ৪৫টি, মনোহরগঞ্জে ১ হাজার ৩০০টি, সদর দক্ষিণে ১৩২টি, ব্রাহ্মণপাড়ায় ৫টি এবং তিতাস উপজেলায় ৪৯টি ঘরবাড়ি পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়েছে বন্যায়। জেলাজুড়ে আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৭৪ হাজার ৮২টি ঘরবাড়ি।

জেলায় ভয়াবহ এই বন্যায় ঘরবাড়িতে ১ হাজার ৮৪ কোটি ১৪ লাখ ৫০ হাজার টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতির এই তালিকা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। তবে তার অনুমোদন এখন অবধি হয়নি। ঠিক কবে নাগাদ এই তালিকার অনুমোদন মিলবে তাও জানা নেই সংশ্লিষ্টদের। ঘরবাড়িহারা ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের প্রত্যাশা শিগগিরই সরকারের পক্ষ থেকে তাদের পুনর্বাসনের কাজ শুরু করা হবে।

এ বিষয়ে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আবেদ আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। সেটি অনুমোদন হয়ে এখনো আসেনি। তালিকা অনুমোদন হয়ে এলে সরকারি বরাদ্দে পুনর্বাসনের কাজ শুরু হবে।

এমজেইউ

 

Visit Source Page

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *