একাকিত্ব, শারীরিক ও মানসিক নিপীড়ন, চাকরি হারানো, ঠিক মতো বেতন না পাওয়াসহ সুনির্দিষ্ট কিছু কারণে প্রবাসে থাকা বাংলাদেশি অভিবাসী কর্মীরা মানসিক নানা সংকটের সম্মুখীন হন। দেশে ফেরার পরে অনেকের এই সংকট ভিন্ন মাত্রা পায়।
অভিবাসী ও বিদেশ-ফেরত অভিবাসীদের মনোসামাজিক সংকট নিয়ে করা ব্র্যাকের এক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে।
এতে আরও বলা হয়েছে, বিশেষ করে যারা ব্যর্থ হয়ে বা অনেকদিন পর দেশে ফেরেন তাদের এই সংকট বেশি। পুরুষের চেয়ে নারীদের সংকট আবার জটিল। সংকট সমাধানে অভিবাসী কর্মী ও বিদেশ-ফেরতদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা জরুরি। কারণ কাউন্সেলিং পেলে তারা দ্রুত স্বাভাবিক হতে পারেন।
আজ (বুধবার) রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এ গবেষণার তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরা হয়।
গবেষণার তথ্য বলছে, দেশে কাউন্সেলিং ও মনোচিকিৎসক সংকটের কারণে পর্যাপ্ত সেই সেবা মেলে না। কাজেই অভিবাসন অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে কাউন্সেলিংয়ের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।
সুইজারল্যান্ডের সহায়তায় ‘রিইন্টিগ্রেশন অব মাইগ্রেন্ট ওয়ার্কার্স ইন বাংলাদেশ’ প্রকল্পের আওতায় গবেষণাটি করা হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক এবং নাসিরুল্লাহ সাইকোথেরাপি ইউনিটের পরিচালক কামাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরীর নেতৃত্বে এই গবেষণা হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক এবং নাসিরুল্লাহ সাইকোথেরাপি ইউনিটের পরিচালক কামাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, আমরা বিদেশ-ফেরতদের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি একাকিত্ব, শারীরিক ও মানসিক নিপীড়ন, চাকরি হারানো, ঠিকমতো বেতন না পাওয়াসহ সুনির্দিষ্ট কতোগুলো কারণে অভিবাসীরা মানসিক সংকটে পড়েন। কিন্তু বাংলাদেশের অন্য সবার মতো প্রবাসীরাও মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টিকে সেভাবে গুরুত্ব দেন না। তবে আমরা দেখেছি যারা কাউন্সেলিং সেবা নিয়েছেন বা পেয়েছেন তারা দ্রুত আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছেন। বিশেষত নারীরা পুরুষদের চেয়েও দ্রুত সুস্থ হয়েছেন।
কামাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, অভিবাসী শ্রমিকদের মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা বিষয়ক এডভোকেসি গন্তব্য দেশ থেকেই শুরু করতে হবে। পাশাপাশি সরকারের পুনরেকত্রীকরণ নীতিতে ফেরত আসা অভিবাসী শ্রমিক এবং পাচার হওয়া ব্যক্তিদের জন্য মনোসামাজিক সহায়তা সেবাকে (পিএসএস) অন্তর্ভুক্ত করার ওপরেও আমাদের জোর দিতে হবে।’
অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য তৈরি মানসিক স্বাস্থ্য মডেলগুলো ব্র্যাকের অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিভাগ এবং অংশীদারদের মধ্যেও ছড়িয়ে দেওয়ার আহ্বান জানান প্রধান গবেষক।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আব্দুল মান্নান বলেন, মানসিক স্বাস্থ্য যে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সেটা অনেক সময় আমরা বুঝে উঠতে পারি না। সরকার বিষয়টিতে গুরুত্ব দিচ্ছে। মানসিক স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আমরা কাজ করবো।
অনুষ্ঠানের সভাপতি ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের রেইজ প্রকল্পের পরিচালক ড. এ.টি.এম. মাহবুব-উল করিম বলেন, বিদেশ-ফেরতদের দৃশ্যমান সহায়তা করা আমাদের লক্ষ্য। বিদেশ থেকে ফেরত আসার পর আমরা যেমন তাদের কাউন্সেলিংয়ের প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পারছি তেমনি বিদেশগামী কর্মীদেরকে মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি জানাতে হবে।
অনুষ্ঠানে নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা বলেন ওমান ও সৌদি আরব ফেরত দুইজন প্রবাসী। গন্তব্য দেশে প্রতারণা ও নির্যাতনের কারণে তাদের যে নানা মানসিক সংকটে ভুগতে হয়েছে সে অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে এক নারী কর্মী বলেন, আমাদের কথা তো কেউ শোনে না। ব্র্যাকের কাউন্সিলররাই প্রথম আমাদের কথা সময় নিয়ে শুনেছেন। তারা আমাদের পরামর্শ দিয়েছেন কীভাবে সুস্থ থাকতে হবে। তাদের কাছ থেকে মনোসামাজিক সহায়তা পেয়ে আমরা আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছি।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ডা. মো. দেলোয়ার হোসেন বলেন, সারা দেশে যে পরিমাণ কাউন্সেলর ও মনোচিকিৎসক দরকার সেটা কীভাবে পূরণ করা যায় তা আমাদের দেখতে হবে।
ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম ও ইয়ুথ প্ল্যাটফর্মের সহযোগী পরিচালক শরিফুল হাসান অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন।
এ ছাড়া, সুইস এজেন্সি ফর ডেভলপমেন্ট অ্যান্ড কো-অপারেশনের (এসডিসি) প্রোগ্রাম ম্যানেজার নাজিয়া হায়দার, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ন্যাশনাল প্রোগ্রাম ম্যানেজার রাহনুমা সালাম খান, ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশনের (আইওএম) প্রকল্প ব্যবস্থাপক আসমা খাতুন, ব্র্যাকের শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়ন এবং অভিবাসন কর্মসূচির পরিচালক সাফি রহমান খানসহ দেশি ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিরা অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন।
এনআই/এনএফ