‘বাইরে বের হলে সাদাছড়িই আমার একমাত্র ভরসা। তবে নানা প্রতিবন্ধকতায় ঠিকভাবে চলাফেরা করতে পারি না। ফুটপাতে বৈদ্যুতিক খুঁটি, ব্যবসায় পরিচালনা করে চলাচলে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। আবার কিছু জায়গায় ফুটপাত থাকার পর কোনও বাড়ি বা ভবনের গেটের সামনে সেটা নিচু হয়ে যায়। সবমিলিয়ে এখন ফুটপাত দিয়ে চলাচল করাও আমাদের জন্য অনিরাপদ।’ এভাবে দৃষ্টিহীন জীবনে নিজের দুর্ভোগের কথাগুলো বলছিলেন ফেনীর বিজয় সিং এলাকার চল্লিশোর্ধ্ব রেজিয়া আক্তার।
‘বাইরে বের হলে সাদাছড়িই আমার একমাত্র ভরসা। তবে নানা প্রতিবন্ধকতায় ঠিকভাবে চলাফেরা করতে পারি না। ফুটপাতে বৈদ্যুতিক খুঁটি, ব্যবসায় পরিচালনা করে চলাচলে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। আবার কিছু জায়গায় ফুটপাত থাকার পর কোনও বাড়ি বা ভবনের গেটের সামনে সেটা নিচু হয়ে যায়। সবমিলিয়ে এখন ফুটপাত দিয়ে চলাচল করাও আমাদের জন্য অনিরাপদ।’ এভাবে দৃষ্টিহীন জীবনে নিজের দুর্ভোগের কথাগুলো বলছিলেন ফেনীর বিজয় সিং এলাকার চল্লিশোর্ধ্ব রেজিয়া আক্তার।
শহরতলীর লালপোল এলাকার দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী আক্তার হোসেন। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, আই (আমি) লাডি (লাঠি) দি ই (দিয়ে) হাঁটাচলা করি। সাদাছড়ি বা ডিজিটাল সাদাছড়ি এগিনের (এগুলোর) কথা হুনলেও (শুনলেও) কখনো কিনতাম (কিনতে) হারিনো (পারিনি)। আর আন্ডার (আমাদের) খবর কনে (কে) লর (নেয়)। অন্ধের জীবনে সবকিছুই অন্ধকার।
এমন একই গল্প সমাজের বিভিন্ন স্তরে বসবাসরত প্রায় সব দৃষ্টিহীনদের। নিজেদের সামাজিক ও আর্থিক নিরাপত্তা, পারিবারিক যত্নসহ নানা বিষয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন ফেনীর দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, ফেনীতে মোট প্রতিবন্ধীর সংখ্যা ২০ হাজার ৫০৮ জন। তবে জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের একটি তথ্যে দেখা গেছে, জেলায় মোট প্রতিবন্ধী ভাতা পান ২৩ হাজার ১৩৯ জন। যেখানে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীর সংখ্যা ৩ হাজার ২৩০ জন। এ দৃষ্টিহীন জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশ পরিবার ও সমাজ থেকে অবহেলা আর উপেক্ষার শিকার হচ্ছেন।
জেলা সমাজসেবা কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য মাসিক ভাতা, শিক্ষা উপবৃত্তি, সুদমুক্ত ক্ষুদ্র ঋণ, সহজে বিভিন্ন সুবিধা নিশ্চিতে সুবর্ণ নাগরিক কার্ড ও সাদাছড়ি প্রদান করা হয়। তবে এসবের নির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি।
পরশুরামের বীরচন্দ্র নগর এলাকার ষাটোর্ধ্ব জাফর আহম্মদ বলেন, অন্ধ জীবনে অন্যের ওপর নির্ভর করেই চলতে হচ্ছে। কত প্রযুক্তির কথা শুনি, কিন্তু আমাদের জন্য কেউ কিছু করে না। এসব বাধার মুখে কখনো পড়াশোনা করারও সুযোগ পাইনি। আগে ভাতার টাকা পেলেও তা এখন বন্ধ। শেষ বয়সে এসে খুব কষ্টে দিন পার করছি।
জেলা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ক্ষুধা নিবারণ সমিতির সভাপতি নাসির উদ্দিন ভূঁইয়া সবুজ ঢাকা পোস্টকে বলেন, দৃষ্টিহীনরা ঘরে-বাইরে সব জায়গায় অবহেলিত। রাস্তায় বের হলেও বেশিরভাগ সময় চালকরা গাড়তে নিতে চান না।
তিনি বলেন, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের সুরক্ষায় দেশে আইন বা নানা সুযোগ-সুবিধার কথা উল্লেখ থাকলেও তা শুধুমাত্র কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। বাস্তবে এ জনগোষ্ঠীকে সমাজ থেকেই একপ্রকার আলাদা করে দেওয়া হয়েছে।
এ ব্যাপারে জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সাইফুল ইসলাম চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য নানা ধরনের কাজ চলমান রয়েছে। আমাদের কাছে কেউ আবেদন করলে বিভিন্ন দিবস উপলক্ষ্যে বা অন্য কোনো মাধ্যমে তাদের সাদাছড়ি প্রদান করা হয়। এছাড়া দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য বিভাগীয় পর্যায়ে চট্টগ্রামে একটি বিশেষায়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। তবে সেখানে ফেনীর দৃষ্টিহীনদের বিষয়ে কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই।
সমাজসেবা ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যের গড়মিল প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তারা একবারে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে তা দীর্ঘদিন ব্যবহার করে। কিন্তু আমরা সবসময় এসব নিয়ে কাজ করি। এজন্য আমাদের তথ্য হালনাগাদ করা হয়। এখানে প্রতিবন্ধীদের নিয়ে সমাজসেবার পরিসংখ্যানই সঠিক।
প্রসঙ্গত, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিরাপদে চলাচলের প্রতীক হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে সাদাছড়ি ব্যবহারের প্রচলন শুরু হয় ১৯৩০ সালে। ১৯৬৪ সালে মার্কিন কংগ্রেসে একটি আইন পাসের মাধ্যমে সাদাছড়ি নিরাপত্তা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত হয়। ১৯৯৬ সাল থেকে বাংলাদেশে জাতীয়ভাবে দিবসটি পালন করছে সরকার ও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠন।
জানেন না প্রযুক্তি সম্পর্কে
চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিতের কথা বিভিন্ন সময় আলোচনায় উঠে এলেও এখনো পিছিয়ে দৃষ্টিহীন জনগোষ্ঠী। নানা প্রতিবন্ধকতায় দৃষ্টিহীনরা ঘরে-বাইরে সব জায়গায় থাকছে অবহেলিত। প্রযুক্তিগত বিষয়েও নেই তাদের কোনো ধারনা। মাঠপর্যায়ে সংশ্লিষ্ট বিভাগের পক্ষ থেকে এ নিয়ে দেখা যায়নি কোন উদ্যোগ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, ফেনীতে ১৫ বছরের ঊর্ধ্বে মোট জনগোষ্ঠীর ৭৩ দশমিক ৬১ শতাংশ মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন। আবার ৫২ দশমিক ৩ শতাংশ ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। তবে এখানেও দৃষ্টিহীন জনগোষ্ঠীর নির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি।
সদর উপজেলার মাথিয়ারা এলাকার দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হামিদুল্লাহ বলেন, পড়াশোনা করার অনেক ইচ্ছে থাকলেও চোখে দেখি না বলে সেটি থেকে বঞ্চিত। এখন আশপাশের সবাই মোবাইল ফোন ব্যবহার করলেও আমি পারছি না।
রেহানা আক্তার নামে আরেক দৃষ্টিহীন নারী বলেন, ছেলে-মেয়েরা সবাই নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত। সংকেত দেওয়া সাদাছড়ির কথা শুনেছি। তবে কখনো এ বিষয়ে কেউ বুঝিয়ে বলেনি। সেজন্য লাঠিতে ভর করেই একা একা জীবন কাটাতে হচ্ছে।
প্রযুক্তিগত জ্ঞানে এ জনগোষ্ঠীর সম্ভাবনা নিয়ে কথা হয় জেলা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ক্ষুধা নিবারণ সমিতির সভাপতি নাসির উদ্দিন ভূঁইয়া সবুজের সঙ্গে। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের যদি হাতে কলমে কোনো ধরনের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে তারা কর্মসংস্থানের মাধ্যমে কিছু একটা করতে পারবে। অনেকে নিরুপায় হয়ে ভিক্ষাবৃত্তিতে জড়িয়ে পড়ে। সবমিলিয়ে প্রযুক্তিগত জ্ঞান নিশ্চিত করা গেলে অনেক সমস্যা কেটে যাবে।
এ ব্যাপারে জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সাইফুল ইসলাম চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও সংগঠনকে ডিজিটাল সাদাছড়ি দেওয়া হয়। তবে সেক্ষেত্রে একটি আবেদন করতে হয়। ডিজিটাল সাদাছড়ির পাশাপাশি দৃষ্টিহীনদের চলাচলের পরিবেশেও পরিবর্তন আনতে হবে। তবে প্রযুক্তিগত বিষয়ে এ জনগোষ্ঠীর জন্য বর্তমান কোনো কার্যক্রম নেই বলে জানান এ কর্মকর্তা।
এমএসএ