রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে পদ্মা ও যমুনা নদীতে জেলেদের জালে প্রায়ই ধরা পড়ে বিভিন্ন প্রজাতির বড় মাছ। এসব মাছ জেলেরা সরাসরি দৌলতদিয়া মাছ বাজার ও ফেরিঘাট এলাকায় মৎস্য আড়তে নিয়ে নিলামে বিক্রি করেন। সরাসরি জেলেদের কাছ থেকে বেশিরভাগ বড় মাছগুলো কিনে নেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। তারা এই মাছগুলো অনলাইনে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, আমলা, শিল্পী ও প্রবাসী ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করেন।
রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে পদ্মা ও যমুনা নদীতে জেলেদের জালে প্রায়ই ধরা পড়ে বিভিন্ন প্রজাতির বড় মাছ। এসব মাছ জেলেরা সরাসরি দৌলতদিয়া মাছ বাজার ও ফেরিঘাট এলাকায় মৎস্য আড়তে নিয়ে নিলামে বিক্রি করেন। সরাসরি জেলেদের কাছ থেকে বেশিরভাগ বড় মাছগুলো কিনে নেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। তারা এই মাছগুলো অনলাইনে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, আমলা, শিল্পী ও প্রবাসী ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করেন।
দৌলতদিয়া ঘাটের সুনাম দীর্ঘ দিনের। পাবনা, মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ী ও ফরিদপুরের জেলেরা এ ঘাট দিয়ে পদ্মা ও যমুনা নদীতে মাছ ধরেন। জেলেরা যে মাছ ধরেন তা দৌলতদিয়ায় নিয়ে বিক্রি করেন। রাতে পাওয়া মাছগুলো ভোরে ফজরের আজানের পরপরই দৌলতদিয়া মাছ বাজারে নিলামের মাধ্যমে বিক্রি হয়। তবে দাম বেশি হওয়ায় বেশিরভাগ বড় রুই, কাতল, পাঙাশ, বোয়াল, আইড়, চিতল, রিঠা, বাগাইড়, ঢাই মাছগুলো স্থানীয়রা কিনতে পারেন না। নিলামে এই মাছগুলো দৌলতদিয়ায় স্থানীয় মাছ ব্যবসায়ীরা কিনে নেন।
এছাড়া জেলেরা দিনে যে মাছগুলো ধরেন সেগুলো দৌলতদিয়া ৫নং ফেরিঘাটের কাছে নিলাম হয়। নিলামে বড় মাছ থাকলে সেই মাছগুলোও বড় মাছ ব্যবসায়ীরা কিনে নেন।
পরে তারা মাছের ভিডিও করে অথবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লাইভে তা প্রচার করেন। মাছের ভিডিও দেখে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে বড় ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, প্রবাসী, শিল্পী, ধনী লোকেরা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। দামে হলে মাছগুলো কুরিয়ার কিংবা বাসে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। অনেক সময় ব্যবসায়ীরা নিজেরা গিয়েও মাছগুলো ক্রেতাদের কাছে পৌঁছে দেন।
সরেজমিনে গত শুক্রবার সকালে দৌলতদিয়া ঘাটে গিয়ে দেখা যায়, দৌলতদিয়া বাস টার্মিনালের পাশের একটি জায়গায় মাছের আড়ত। জেলেরা পদ্মা নদী থেকে মাছ ধরে সরাসরি সেখানে বিক্রি করতে নিয়ে এসেছেন। সেখানে উন্মুক্ত নিলামে বড় বড় মাছগুলো বিভিন্ন জায়গার পাইকার ও স্থানীয় ব্যবসায়ীরা এসে কিনে নিচ্ছেন।
দৌলতদিয়ার ৫ নং ফেরিঘাটে গিয়ে দেখা যায়, সুমাইয়া মৎস্য আড়তের সামনে জেলে কৃষ্ণ হালদার একটি ১০ কেজি ওজনের নদীর ব্ল্যাক কার্প ও ৬ কেজি ওজনের নদীর একটি পাঙাশ মাছ বিক্রির জন্য নিয়ে এসেছেন। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর পাইকারি মাছ ব্যবসায়ীরা এলে উন্মুক্ত নিলাম শুরু হয়। নিলামে ব্ল্যাক কার্প মাছটি ৫০০ টাকা কেজি দরে ও পাঙাশ মাছটি ১৩০০ টাকা কেজি দরে ব্যবসায়ী শাহজাহান শেখ কিনে নেন। পরে ব্ল্যাক কার্প মাছটি কেটে কেজি দরে বিক্রি করেন।
সেখানে বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে দেখা যায় জেলেরা নদী থেকে সরাসরি মাছ শিকার করে দৌলতদিয়া ৫নং ফেরিঘাটে এসে নিলামে পাইকারদের কাছে বিক্রি করছেন।
চাঁদনী এন্ড আরিফা মৎস্য আড়তের মালিক মাছ ব্যবসায়ী চান্দু মোল্লা। তিনি দৌলতদিয়া লঞ্চ ঘাট এলাকার মজিদ শেখের পাড়া এলাকার বাসিন্দা। তিনি ২০০৬ সাল থেকে দৌলতদিয়ায় মাছের ব্যবসা করে আসছেন। তিনি বলেন, জেলেরা নদী থেকে যে মাছগুলো ধরে নিয়ে আসেন সে মাছগুলো দৌলতদিয়া মাছ বাজারে নিলামে উঠে। আমরা যারা ব্যবসায়ী আছি তারা নিলামের মাধ্যমে সেই মাছগুলো কিনে থাকি। মাছগুলো কেনার পর মাছের ভিডিও করে ফেসবুকে আপলোড করি। অনলাইনে ক্রেতার ভালোই সাড়া পাচ্ছি। অনলাইনে আমার অনেক কাস্টমার।
বড় মাছের ক্রেতা কারা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আগে যখন পদ্মা সেতু ছিল না তখন বড় বড় ব্যবসায়ী, শিল্পপতি দৌলতদিয়া ঘাট দিয়ে গাড়ি নিয়ে যাতায়াত করতো তখন এই সমস্ত ক্রেতারাই বড় মাছগুলো কিনতো। কিন্তু পদ্মা সেতু চালুর পর এই ঘাট দিয়ে তাদের যাতায়াত কমে গেছে। এছাড়া যাত্রী ও যানবাহন সংখ্যাও অনেক কমে গেছে। তাই বর্তমানে মাছ অনলাইনে বিক্রি করি। আমার কাছে বেশিরভাগ প্রবাসী ভাইয়েরা মাছগুলো অর্ডার করেন। প্রবাসী ভাইয়েরা তাদের মা-বাবার জন্য, বোনের জন্য, স্ত্রী-সন্তানদের জন্য, পরিবারের জন্য মাছ কিনে গিফট করেন। ঢাকায় কোনও মাছের অর্ডার থাকলে আমি মোটরসাইকেলে গিয়ে দিয়ে আসি।
ক্রেতাদের কাছ থেকে অনেক সময় অভিযোগ আসে দৌলতদিয়ার বড় মাছগুলো বেশিরভাগ পুকুরের মাছ। পুকুরের মাছগুলো দড়ি দিয়ে নদীতে বেঁধে রেখে তা নদীর মাছ হিসেবে বেশি দামে বিক্রি হয়। এ বিষয়ে তিনি বলেন, যারা এ অভিযোগ করেন তারা তো এই মাছগুলো কেনেন না। তারা শুধু অভিযোগই করতে পারেন। সত্য মিথ্যা যাচাই করার জন্য দৌলতদিয়া ঘাটে আসতে হবে। যারা অভিযোগ করেন আমি তাদের বলবো আপনারা দৌলতদিয়া ঘাটে আসেন, এক দুই দিন থাকেন। তাহলে বুঝতে পারবেন মাছগুলো নদীর নাকি পুকুরের।
দৌলতদিয়া ৫নং ফেরিঘাটের অপর এক মাছ ব্যবসায়ী শাহজাহান শেখ। দৌলতদিয়া ঘাটের বড় বড় মাছগুলো তিনিও কেনেন । ফেরিঘাটে শাকিল-সোহান মৎস্য আড়ত নামে তার একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
মাছ ব্যবসায়ী শাহজাহান শেখের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, আমি প্রায় ৩০ বছর দৌলতদিয়া ঘাটে মাছের ব্যবসা করি। মাছ অনলাইনে বিক্রি করি। পদ্মা ও যমুনা নদী থেকে জেলেরা মাছ ধরে দৌলতদিয়ায় নিয়ে এলে আমি নিলামে মাছগুলো কিনি। জেলেরা মাছ নিয়ে আড়তদারদের কাছে দেয়। আমরা আড়তদারদের কাছ থেকে মাছগুলো কিনে নেই। জেলে অথবা আড়তদারদের কাছ থেকে সরাসরি মাছগুলো কিনে তাজা মাছগুলো আমরা নদীতে বেঁধে রাখি। সেগুলো ভিডিও করে ফেসবুকে ছেড়ে দিলে ক্রেতারা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে মাছ কেনেন। আমার মাছের ক্রেতা বড় বড় গার্মেন্টস ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, ঠিকাদার।
দৌলতদিয়া ঘাটের মাছের আড়তদার রেজাউল ইসলাম বলেন, দৌলতদিয়া ঘাটে পদ্মা নদীর তাজা মাছ পাওয়া যায়। ভোর ৫টা থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত নিলামে মাছগুলো বিক্রি হয়। বিভিন্ন জায়গা থেকে পাইকাররা এখানে মাছ কিনতে আসেন। আবার স্থানীয়দের মধ্যে উল্লেখযোগ্য চান্দু মোল্লা, শাহজাহান শেখ, নুরু, সোহেল মোল্লাসহ আরও অনেকে আছেন যারা নিলামে বড় মাছগুলো কিনে থাকেন।
দৌলতদিয়ার স্থানীয় বাসিন্দা সোহেল বলেন, জেলেরা সরাসরি পদ্মা নদী থেকে মাছগুলো ধরে দৌলতদিয়া ঘাটে নিয়ে আসেন।
গণমাধ্যম কর্মী দেবাশীষ বিশ্বাস বলেন, দৌলতদিয়া ঘাটে যে মৎস্য আড়ত রয়েছে এটি রাজবাড়ীর মধ্যে একটি বড় আড়ত। পদ্মা পাড়ে যারা আছেন তারা এই নদীতে মাছ শিকার করেন। এই জেলেরা নদী থেকে মাছ শিকার করে দৌলতদিয়া মৎস্য আড়তে নিয়ে নিলামে বিক্রি করেন। দৌলতদিয়ার স্থানীয় কিছু মাছ ব্যবসায়ী নিলামে বড় মাছগুলো কিনে নেন।
তিনি বলেন, দেশের যারা শিল্পপতি, কোটিপতি, বড় আমলা তারাই এই মাছগুলো ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কেনেন। মাছগুলো সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। এই মাছ সাধারণ মানুষ খেতে পারেন না। আমার প্রত্যাশা থাকবে- দৌলতদিয়া ঘাটের মাছের দাম এতো বেশি কেন তা কর্তৃপক্ষ যাচাই-বাছাই করুক। সহজলভ্য মূল্য করুক যাতে সাধারণ মানুষ এই মাছগুলো কিনে খেতে পারেন।
রাজবাড়ী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) ও সদর উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মোস্তফা আল রাজীব বলেন, পদ্মা নদীতে রুই, কাতলা, পাঙাশ, বোয়াল, আইড়, বাগাইড় মাছগুলো পাওয়া যাচ্ছে। এটা আমাদের জন্য একটি পজেটিভ দিক। এই মাছগুলো আগের চেয়ে বেশি পরিমাণে জেলেদের জালে ধরা পড়ছে। তবে নদীতে এখন ইলিশের আধিক্য কমে গেছে কিন্তু এই বড় মাছগুলো বেড়েছে।
তিনি বলেন, আমাদের যখন মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান চলে তার পরপরই দেখতে পাই পাঙাশ ব্যাপক আকারে পাওয়া যায়। এছাড়াও রুই, কাতলা, বোয়াল, আইড় মাছও বেশি পাওয়া যায়। এই মাছগুলো জেলেরা দৌলতদিয়া আড়তে এনে বিক্রি করেন। রাজবাড়ী, ফরিদপুর, মানিকগঞ্জ, সাভার থেকে ব্যবসায়ীরা দৌলতদিয়ায় এসে নিলামে মাছগুলো কিনে নেন। অনেক সময় ধনীরা এই মাছগুলো দৌলতদিয়া থেকে নিয়ে যান। জেলে, আড়তদার ও মাছ ব্যবসায়ী উভয়ই এতে লাভবান হচ্ছেন।
এমএসএ