দুর্গাদর্শনে সত্যজিৎ ও ঋতুপর্ণ

দুর্গাদর্শনে সত্যজিৎ ও ঋতুপর্ণ

দুর্গাপূজার দুটি বিষয় আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়—এক, দেবী রূপে নারীর প্রতীকায়ন ও দুই, পূজাকে কেন্দ্র করে উৎসব পালন।

দুর্গাপূজার দুটি বিষয় আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়—এক, দেবী রূপে নারীর প্রতীকায়ন ও দুই, পূজাকে কেন্দ্র করে উৎসব পালন। দেবী দুর্গার দশভুজা প্রতিমা আমাদের সামনে হাজির হয় শক্তিমান ও দুর্গতিনাশিনী হিসেবে অর্থাৎ এ মহাবিশ্বের যাবতীয় দুঃখ-কষ্ট বিনাশকারিণী দেবী তিনি।

একই সাথে তিনি মহামায়া, দুরধিগম্য—সহজ সাধনায় তাকে পাওয়া দুষ্কর। দেবী দুর্গার এমন আধ্যাত্মিক প্রতীকায়ন আদতে মিলে যায় নারীর রহস্যময়ী সত্তা, প্রেমময়ী অন্তর ও স্নেহময়ী মাতৃরূপের সাথে। নারীর এই সম্মিলনকে উদযাপন ও শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের পেছনে মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার পাটাতন যেমন আছে, তেমনি আছে এই বহু ক্ষমতার উন্মেষকে ভক্তি করার রীতি। তাই উৎসবের ভেতর দিয়েই নারীশক্তির প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা প্রদর্শিত হয়।

যদিও বাস্তবতা ভিন্ন কথা বলে। সারা দুনিয়ায় তো বটেই, এই দক্ষিণ এশিয়ায় নারী নির্যাতনের যেসব ঘটনা ঘটে চলেছে, তা দেখলে আমরা শিউরে উঠি। পত্রিকার পাতা খুললে বোঝার উপায় নেই, এই ভূখণ্ডের মানুষই নারীকে তার ধর্মাচরণের মধ্য দিয়ে এতটা ভক্তিশ্রদ্ধা করে।

নারীশক্তিকে বেশি বেশি পূজা করা হয় বলেই কি নারীকে বেশি পীড়নের শিকার হতে হয়? আপনা মাঁসে হরিণা বৈরী? মানে আরেকটু গভীরে গিয়ে যদি বলা যায়, নারীশক্তির প্রাবল্য অনুভূত হয় বলেই কি পুরুষতন্ত্র এতটা নারীবিদ্বেষী হয়ে ওঠে? পুরুষকুল নারীকে পীড়ন ও দুর্ভোগের দিকে ঠেলে দেয়? এটা কি তবে পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার একধরনের মানসিক কূট?

এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছিলেন, অন্তত আমার মতে, সত্যজিৎ রায়, ‘দেবী’ চলচ্চিত্রে। এই ছবির পাঠ আরও নানাভাবে করা যেতে পারে। অনেকে হয়তো বলবেন স্রেফ ধর্মীয় কূপমণ্ডূকতার কথা, কিন্তু আমি বলবো তিষ্ঠ ক্ষণকাল, এর অন্য পাঠও কিন্তু বাহুল্য নয়।

নারীশক্তির প্রতি আকৃষ্টবোধ করা এবং দুরধিগম্য জ্ঞানে তাকে পূজার আসনে বসিয়ে দেওয়ার ভেতর ফ্রয়েডিয় মনোবিশ্লেষণের একটি বড় ধরনের পরিসর বিরাজ করে বলে আমার বিশ্বাস।

সত্যজিৎ রায়ের বিখ্যাত ছবিটি শুরু হয় দেবী দুর্গার পূজা ও পশু বলির দৃশ্য দিয়ে। ফ্রয়েডের ইডিপাস কূট সম্পর্কে যারা জানেন, তাদের কাছে ইডিপাসের মাতৃগমন, অতঃপর চক্ষু উৎপাটন বা ক্যাসট্রেশনের রূপকধর্মী আখ্যান পরিচিত।

ফ্রয়েডের স্বপ্ন দর্শন মেনে শ্বশুর কালীকিঙ্কর চৌধুরীর স্বপ্নে যখন দেবীর ত্রিনয়নের মুখাবয়ব প্রতিস্থাপিত হয় পুত্রবধূ দয়াময়ীর মায়াবতী মুখমণ্ডল দিয়ে, তখন তিনি দয়াময়ীকে মাতৃজ্ঞান করতে শুরু করেন। আগে থেকে তিনি দয়াময়ীকে মা বলেই ডাকতেন, তবে এবার সাক্ষাৎ দেবী।

স্বপ্ন দেখা ভোরে উঠেই তিনি করলেন সাষ্টাঙ্গে প্রণাম, দয়াময়ী কুঁকড়ে যায়, এই বুঝি শ্বশুরের হাত তার পা ছুঁয়ে ফেলবে! সত্যজিৎ কি অসাধারণ ফ্রেম ধরেছেন এইখানে। দেবীর অবতার ঘোষণা দিয়ে শ্বশুর দয়াময়ীকে সবার পূজার পাত্র বানিয়ে ফেলতে চান।

দেবত্ব আরোপ ও এর আচার যত বাড়তে থাকে সাধারণ মেয়ে দয়াময়ীর জীবন ততটাই দুর্বিষহ হয়ে উঠতে থাকে। তারপরও তাকে বেঁচে থাকার স্বপ্নকে অবলম্বন করতে হয়। দেবী দুর্গা যেমন দুর্গম নামের এক অসুরকে বধ করেছিলেন, সেভাবে সমাজের দয়াময়ীদেরও দুর্গম পথ পাড়ি দিতে হয়, নানাবিধ অসুরের (বা শ্বশুরের) মোকাবিলা করতে করতে।

সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্রে যদি পূজা ছাপিয়ে দেবী ও মানবীর সংশ্লেষ হাজির হয়, তাহলে আরেক পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘উৎসব’ ছবিটিতে আমরা দেখি পূজার উৎসবকে পেছনে রেখে মানবিক সম্পর্কের টানাপোড়েন, যা আদতে গোটা মানবজীবনেরই দুঃখ ও বেদনার এক সংমিশ্রণ।

ভগবতীর চার ছেলেমেয়ে পূজার ছুটিতে বাড়ি আসে। তারা প্রত্যেকেই সঙ্গে করে নিয়ে আসে তাদের যাপিত জীবনের সঙ্কট ও শঙ্কা। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, এরা জীবনের উৎসবটাকে উদযাপন করতে চায় বলেই এই আসা।

দুর্গা যেমন ছেলেমেয়েদের নিয়ে ধরণীতে আসেন, এরাও সেরকম পৈতৃকনিবাসে এসেছে। পুরাণের দেবদেবীদের ওপর ঋতুপর্ণ ঘোষ যেন মনুষ্যত্ব আরোপ করেছেন এখানে। এ যেন সত্যজিতের ‘দেবী’র ‘অ্যান্টিথিসিস’। সেখানে মানুষের ওপর দেবত্ব আরোপ হয়, আর এখানে দেবদেবীর ওপর মনুষ্যত্ব।

দেবী দুর্গার দশভুজা প্রতিমা আমাদের সামনে হাজির হয় শক্তিমান ও দুর্গতিনাশিনী হিসেবে অর্থাৎ এ মহাবিশ্বের যাবতীয় দুঃখ-কষ্ট বিনাশকারিণী দেবী তিনি।

চরিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় অসিত ও নিশীথের সাথে মিল পাওয়া যায় যথাক্রমে গণেশ আর কার্তিকের। পারুল ও কেয়ার চরিত্রের সঙ্গে সাযুজ্য দেখা যায় লক্ষ্মী ও সরস্বতীর। এই চার চরিত্রের সঙ্গে যুক্ত চরিত্ররা এদের ঘিরেই আবর্তিত এবং মানবিক সঙ্কটে জর্জরিত।

বাংলা চলচ্চিত্রে এই দুটি কাজ ছাড়াও আরও বহু ছবিতে দুর্গাপূজা নানাভাবে উপস্থাপিত হয়েছে, নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, কখনো বা একেবারে সনাতনী ধর্মের জায়গা থেকে, আবার কখনোবা মা রূপক মিশ্রিত জাতীয়তাবাদী অবস্থান থেকে।

তবে ওসব কাজের বাইরে সত্যজিৎ ও ঋতুপর্ণের এই দুটি চলচ্চিত্র আমার কাছে আকর্ষণীয় লাগে দুজনের দেখার অবস্থানের কারণে। যদি কথার খাতিরে ধরে নিই, এরা দেবতা ও মানুষকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে নিরীক্ষা করতে চেয়েছেন, তবে বলতে হয় সত্যজিৎ ও ঋতুপর্ণ শেষপর্যন্ত একটা বিন্দুতে এসেই মিলেছেন, সেটা হলো সব ছাপিয়ে মানুষের সঙ্কট অনিঃশেষ। এটাই শেষ সত্যি।

এটা জানে বলেই হয় তো মানুষ প্রত্যাশা করে দৈবক্রমে তাদের ভাগ্যের লিখন পাল্টাবে আর ক্লেদময় জীবনের ভেতর উৎসবের আয়োজন করলে দুয়েকটি শুভ্র পদ্ম ফুটবে অন্তত।

বিধান রিবেরু ।। চলচ্চিত্র সমালোচক

Visit Source Page

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *