দুই সন্তান নিয়ে দিশেহারা পুলিশের গুলিতে নিহত মনজুর স্ত্রী

দুই সন্তান নিয়ে দিশেহারা পুলিশের গুলিতে নিহত মনজুর স্ত্রী

‌স্ত্রীর কাছে স্বামীই সবচেয়ে দামি সম্পদ। আমার সেই সম্পদ আর নেই। পুলিশ আমার স্বামীকে গুলি করে হত্যা করেছে। আমাদের বেঁচে থাকার স্বপ্নটুকু কেড়ে নিয়েছে। বাচ্চা দুইটার ভবিষ্যতের কথা ভেবে কত আশা নিয়ে ঢাকায় গেছিলাম। এখন তো আমার আর কিছুই থাকলো না। কে দেখবে আমার অবুঝ বাচ্চাদের? কার কাছে বিচার চাইবো, আমরা তো গরীব মানুষ। আল্লাহর কাছে বিচার চাইছি।—অশ্রুসিক্ত নয়নে কাঁদতে কাঁদতে এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন স্বামী হারানো রাহিমা বেগম (২৯)।

‌স্ত্রীর কাছে স্বামীই সবচেয়ে দামি সম্পদ। আমার সেই সম্পদ আর নেই। পুলিশ আমার স্বামীকে গুলি করে হত্যা করেছে। আমাদের বেঁচে থাকার স্বপ্নটুকু কেড়ে নিয়েছে। বাচ্চা দুইটার ভবিষ্যতের কথা ভেবে কত আশা নিয়ে ঢাকায় গেছিলাম। এখন তো আমার আর কিছুই থাকলো না। কে দেখবে আমার অবুঝ বাচ্চাদের? কার কাছে বিচার চাইবো, আমরা তো গরীব মানুষ। আল্লাহর কাছে বিচার চাইছি।—অশ্রুসিক্ত নয়নে কাঁদতে কাঁদতে এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন স্বামী হারানো রাহিমা বেগম (২৯)।

সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থার সংস্কারের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গত ২০ জুলাই ঢাকার বড়বাড়ী জয়বাংলা রোড এলাকায় পুলিশের গুলিতে রিকশাচালক মনজু মিয়ার মৃত্যু হয়। ওই দিন খাবার নেওয়ার জন্য বাসার বাইরে বের হলে হঠাৎ গুলিবিদ্ধ হন তিনি। পুলিশের গুলিতে ঝাঁঝরা শরীরে ছটফট করতে করতে লুটিয়ে পড়েন মনজু মিয়া। স্থানীয় লোকজনের সহযোগিতায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

মনজু মিয়া (৪০) রংপুরের পীরগাছা উপজেলার ছাওলা ইউনিয়নের জুয়ানের চর গ্রামের এনছের আলীর ছেলে। তিনি পরিবার নিয়ে ঢাকার বড়বাড়ী জয়বাংলা রোড এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন। ভূমিহীন মনজু মিয়া কষ্টের সংসার গোছাতে দুই বছর আগে স্ত্রী রাহিমা বেগমকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। সেখানে তিনি রিকশা চালাতেন, আর তার স্ত্রী স্থানীয় একটি গার্মেন্টসে চাকরি করত। তাদের চার বছরের কন্যা ও দুই বছর বয়সী পুত্র সন্তান তাম্বুলপুর ইউনিয়নের রহমতচর গ্রামে নানার বাড়িতে থাকত।

স্বামীকে হারিয়ে শোকে কাতর রাহিমা বেগম। যখনই মনজু মিয়ার কথা মনে পড়ছে তখনই সন্তানদের বুকে টেনে নিয়ে হু হু করে কাঁদতে থাকেন। ভিটেমাটি না থাকলেও তাদের সংসারে অশান্তি ছিল না। কমতি ছিল না সুখের। অনেক স্বপ্ন নিয়ে গ্রামের মেঠোপথ ছেড়ে একটু ভালো থাকার আশায় স্বামীর হাত ধরে রাজধানীতে পা বাড়ানো রাহিমা বেগম বলেন, আমার স্বামীর কোনো জমিজমা নেই। আমরা দুজন ঢাকায় গিয়েছিলাম, কাজ করে গ্রামে কিছু একটা করব। সংসারটা সুন্দর করে সাজাবো। বাচ্চাদের জন্য কিছু একটা করব, যাতে ওরা ভালো থাকে। ওদের (সন্তানদের) ভবিষ্যৎ নিয়ে সবসময় উনি (স্বামী মনজু মিয়া) ভাবতেন। আমাদের সেই আশা আর পূরণ হলো না। এখন স্বামী নেই, থাকার জায়গা নেই, ঘরও নেই। কোথায় যাবো কি করব, কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। বর্তমানে আমার বাবার বাড়িতে আছি।

এখন পর্যন্ত কারো কাছ থেকে তেমন কোনো সহযোগিতা পাননি দাবি করে রাহিমা বেগম বলেন, আমরা গরিব মানুষ। আমার স্বামী রিকশাচালক ছিলেন। আমাদের মতো গরিবের খবর কেউ রাখে না। আমি বাচ্চা দুটো নিয়ে খুব চিন্তায় আছি। এখন তো বাঁচতে হবে, কিছু একটা করতে হবে। সেই আশা কে দেবে, কার কাছ থেকে সহযোগিতা পাবো? আমি আমার স্বামীকে ফিরে পাব না কিন্তু ন্যায় বিচার তো চাওয়ার অধিকার রাখি। সরকারের কাছে আমার স্বামী হত্যার বিচার চাই। বাচ্চা দুটোর জন্য সহায়তা চাই।

ঢাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর এক দিন পর ২১ জুলাই (রোববার) পীরগাছার ছাওলা ইউনিয়নের জুয়ানের চর গ্রামে মনজু মিয়াকে দাফন করা হয়। উপার্জনক্ষম স্বামী মনজু মিয়াকে হারিয়ে অন্ধকার দেখছেন স্ত্রী রাহিমা বেগম। দুই সন্তানকে নিয়ে অতিকষ্ঠে দিন পার করতে হচ্ছে তাকে।

নিহত মনজু মিয়ার বাবা এনছের আলী জানান, আমার ছেলে ঢাকায় থাকত। ছাত্রদের আন্দোলন চলাকালে ২০ জুলাই বাসার বাইরে বের হলে পুলিশের গুলিতে গুরুতর আহত হন। পরে তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। সন্তানের মৃতদেহ দেখলে কোনো বাবাই ঠিক থাকতে পারে না। আজকে কান্না ছাড়া আমার আর কিছুই করার নেই। আমার ছেলে পুলিশের গুলিতে শহীদ হয়েছেন। আমি সবার কাছে আমার ছেলের জন্য দোয়া চাই।

রাহিমা বেগমের বাবা তাম্বুলপুর ইউনিয়নের রহমতচর গ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা আব্দুর রহমান। এমন নিদানকালে তিনিও অসহায় মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে। এত অল্প বয়সেই স্বামী হারা হতে হবে তার মেয়েকে, এটা মনে করে তিনিও কাঁদছেন। আব্দুর রহমান বলেন, আমার জামাই ঢাকায় কাজ করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে লাশ হয়ে বাড়ি ফিরলো। জামাই মনজু মিয়ার কোনো বসতভিটা না থাকায় বর্তমানে মেয়ে ও তার দুটি সন্তান আমার বাড়িতে রয়েছে। আমি গরিব মানুষ, আমি তাদের কীভাবে ভরণপোষণ দেবো। আমার মেয়ে বর্তমানে নাবালক দুটি সন্তান নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভুগছেন। যেন দিশেহারা অবস্থা।

এ ব্যাপারে ছাওলা ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. নাজির হোসেনের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, আমার ইউনিয়নে মনজু ও মামুন নামে দুজন ঢাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। নিহতদের পরিবারের খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে সহযোগিতা করেছি। উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গে কথা হয়েছে, কাল-পরশুর মধ্যে সহযোগিতার জন্য নিহতদের পরিবারের কাগজপত্র জমা করব। আশা করছি, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত পরিবারের সদস্যরা সরকারি সহায়তা পাবে।

অন্যদিকে তাম্বুলপুর ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. বজলুর রশিদের সঙ্গে কথা বলতে তার মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি কল রিসিভ করেননি। এ কারণে তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

পীরগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. নাজমুল হক সুমন জানান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ঢাকায় নিহত মনজু মিয়ার পরিবারের খোঁজখবর নেওয়া হয়েছে। তার পরিবারকে সহযোগিতা করা হবে। এ জন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধিকে নিহতের পরিবারের প্রয়োজনীয় তথ্যসহ কাগজপত্র সংগ্রহ করতে বলা হয়েছে।

ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এএমকে

Visit Source Page

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *