‘ঠিক মতো দুবেলা খাওনই পাই না, আবার পড়ালেখা’

‘ঠিক মতো দুবেলা খাওনই পাই না, আবার পড়ালেখা’

প্রায় আট বছর আগে বাবা অভিজিৎ মারা যাওয়ার পর থেকে এলোমেলো হয়ে যায় ১৩ বছর বয়সী শিশু রোকসানার জীবন। মা থেকেও নেই। বেশিরভাগ সময় অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকেন বিছানায়। অনিশ্চিত জীবনের পথচলায় সঙ্গী হয় কয়েকজন ভবঘুরে শিশু। ধীরে ধীরে অন্য শিশুদের সঙ্গে ড্যান্ডির নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ে রোকসানা।

প্রায় আট বছর আগে বাবা অভিজিৎ মারা যাওয়ার পর থেকে এলোমেলো হয়ে যায় ১৩ বছর বয়সী শিশু রোকসানার জীবন। মা থেকেও নেই। বেশিরভাগ সময় অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকেন বিছানায়। অনিশ্চিত জীবনের পথচলায় সঙ্গী হয় কয়েকজন ভবঘুরে শিশু। ধীরে ধীরে অন্য শিশুদের সঙ্গে ড্যান্ডির নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ে রোকসানা।

সমাজের অন্য শিশুদের মতো পরিবারের সঙ্গে সুন্দর সময় কাটানো যেন স্বপ্নের মতো। তার বয়সী শিশুরা যখন স্কুলে লেখাপড়া করতে যায়, তখন সে থাকে ড্যান্ডির নেশায় বিভোর। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে দেখা ছাড়া কিছু করার নেই তার। তবে রোকসানারও ইচ্ছা ছিল অন্য শিশুদের মতো সুন্দর ও স্বাভাবিক জীবন গড়ে তোলার। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, ভবঘুরে শিশুদের সঙ্গেই কাটছে জীবনের সোনালী সময়।

শুধু শিশু রোকসানাই নয়, তার মতো জেলা শহরের বিভিন্ন স্থানে দেখা মিলে ভবঘুরে এসব শিশুর। ১২ বছরের গোপাল ভাজা ও তার ভাই আট বছর বয়সী জয়ন্ত ভাজার জীবনও কাটছে এভাবে।

মা কবে দুই ভাইকে রেখে না ফেরার দেশে চলে গেছেন মনে করতে পারে না গোপাল। মায়ের মৃত্যুর পর বাবা রিপন ভাজা নিজের সুখের জন্য অন্যত্র বিয়ে করে সংসার শুরু করেন। বাবার নতুন সংসারে ঠাঁই হয়নি মাতৃহারা দুই ভাইয়ের। বাবার দ্বিতীয় বিয়ের পর ছেলেদের খোঁজখবরও রাখেননি। তারপর থেকে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছে শিশু গোপাল ভাজা ও জয়ন্ত ভাজার।

দিনের বেলায় রাস্তায় রাস্তায় ঘুরলেও রাতে থাকার জন্য জায়গা খুঁজে নেয় জেলা শহরের খালপাড় ব্রিজের নিচে। সেখানেই তাদের বসবাস। এভাবে চলতে চলতে এক সময় ড্যান্ডির নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ে শিশু গোপাল ভাজা ও তার ভাই জয়ন্ত ভাজা।

জেলা শহরের বেশিরভাগ ভবঘুরে শিশুর বসবাস খালপাড় সেতুর নিচে। শহরের বিভিন্ন অলিগলিতে থাকা এসব শিশু খালপাড় সেতুর নিচে পলিথিনের ভেতরে আঠা ভরে নেশা করে থাকে। ওরা এটাকে ড্যান্ডির নেশা বলে। মানুষের কাছে হাত পেতে যে অর্থ পায় তা দিয়ে খাবার না কিনে ড্যান্ডির নেশা করে। এ কারণে এখন তেমন সহযোগিতাও করে না অনেকে। আর স্থানীয়রা ভবঘুরে এসব শিশু দেখলেই ধমক দিয়ে দূরে সরিয়ে দেন।

পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন এসব ভবঘুরে শিশুর পুনর্বাসনে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের নজরদারি কম থাকায় অন্ধকারে ডুবতে বসেছে তাদের ভবিষ্যৎ। তবে তারাও চায় অন্য শিশুদের মতো  সুন্দরভাবে বেঁচে থাকতে।

১৩ বছরের শিশু রোকসানার সঙ্গে কথা বলা চেষ্টা করেন এই প্রতিবেদক। তবে, নিজের এই অবস্থার বিষয়ে কথা বলতে রাজি হয়নি সে। 

অনেক জোরাজুরির পর কথা বলতে রাজি হয় গোপাল ভাজা। সে বলে, ‘ঠিক মতো দু-বেলা খাওনই পাই না, আবার পড়ালেখা। সুন্দর-স্বাভাবিক জীবন তো সবাই চায় কিন্তু আমাগো কপালে তো সেটা নাই। রাস্তার পাশ দিয়ে হগলেই আমাগো দেখে, কই কেউ তো আগাইয়া আসে না। সবাই দূর দূর করে। কেউ আদার করে কাছে নেয় না।’

গোপাল ভাজা বলে, ‘কখনও হোটেলে বাসি খাবার খেয়ে, আবার কখনও মানুষের কাছে হাত পেতে আমাগো দিন পার হয়। এই বিরিজের নিচেই রাত কাটে। তয় আমার ইচ্ছা ছিল লেখাপড়া করমু, ভালো পোশাক পরমু। কিন্তু হেইয়া তো কপালে নাই।’

কেন ড্যান্ডির নেশা করো— জানতে চাইলে গোপাল ভাজা মুখ ঘুরিয়ে থাকে। কোনো কথা না বলে চলে যায়। যেতে যেতে বলে, পারলে আমারে একটা দোকান কইরা দেন।

শিশু জয়ন্ত ভাজা বলে, ‘আমাগো জীবন তো নষ্ট অইয়্যা গেছে। অনেকে আমাগো কাছে আসে, নাম ঠিকানা নিয়া যায়। কিন্তু এরপর আর কেউ আসে না। আমাগোর খোঁজও নেয় না।’

ড্যান্ডি কেন খাও— জানতে চাইলে সে বলে, ‘ভাইয়ের লগে থাকতে থাকতে এইটা শিখা গেছি।’

কীভাবে দিন চলে— প্রশ্ন করতেই জয়ন্ত বলে, ‘টুকাইয়ের কাজ করি। রাস্তায় রাস্তায় পেলাস্টিকের বোতল কুড়াই। খিদা (ক্ষুধা) লাগলে মানুষের কাছে হাত পেতে টাকা চাই, নাইলে হোটেলে গিয়ে খাবার চাইয়া খাই। তয়, অনেক ইচ্ছা করে ভালো খাবার খাইতে কিন্তু পাই না। আমাগো বাপ-মা নাই।’

মানিকগঞ্জ কর্নেল মালেক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নবজাতক ও শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মো. হুমায়ুন কবির বলেন, ভবঘুরে এসব শিশুদের সামাজিক, পারিবারিক ও মানসিক সেবা দরকার, সেটা তারা পাচ্ছে না। ফলে তাদের জীবন-যাপনের ক্ষেত্রে নানাবিধ সমস্যা দেখা দিচ্ছে। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার কারণে ভবঘুরে শিশুদের পোশাক, খাবার ও ভালো পরিবেশ না পাওয়ায় শিশুস্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ছে এবং বিকাশও ব্যাহত হচ্ছে। অনেক সময় তারা বাসি-পচা খাবার খাচ্ছে, নোংরা পরিবেশে থাকছে। এতে বিভিন্ন রোগী-জীবাণু যেমন- ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন রোগে এসব শিশু আক্রান্ত হচ্ছে। এসব শিশু আবার নেশায় আসক্ত হওয়ার ফলে তাদের ফুসফুস, লিভার, কিডনি, হার্ট ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এতে দিন দিন এসব শিশুদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকিও বাড়ছে।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) মানিকগঞ্জের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বিশ্বাস বলেন, ‘পথশিশু বা ছিন্নমূল শিশুদের ক্ষেত্রে আমাদের আরও আন্তরিক ও যত্নশীল হতে হবে। সামজের সচেতন নাগরিকদেরও এগিয়ে আসতে হবে, যাতে ভরঘুরে শিশুরাও সুস্থ সুন্দর একটি স্বাভাবিক জীবন ফিরে পায়। 

প্রশাসনের নজরদারিতে ঘাটতি আছে কি না- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এসব শিশুর অধিকার বা পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে আমাদের সকলের সহযোগিতার করার মানসিকতা থাকতে হবে। প্রশাসনের কিছুটা নজরদারি কমতি রয়েছে, তবে আমরা সুশীল সমাজের ব্যক্তিরা এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে অবশ্যই সহযোগিতা করতে পারি। কারণ আমার-আপনার ঘরেও শিশু বাচ্চা রয়েছে। ওরাও (ভবঘুরে শিশু) এই সমাজ, রাষ্ট্রের সম্পদ বলে আমি করি।

জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক আবদুল বাতেন বলেন, আমাদের জেলায় বেসরকারিভাবে এসব শিশুর অধিকার বা পুনর্বাসন নিয়ে কাজ করে এমন কোনো এনজিও নাই। তবে তাদের শিশুর সুস্থতা ও পুনর্বাসনের সুযোগ রয়েছে। সরকারিভাবে দেশের বিভিন্ন শিশু উন্নয়নকেন্দ্র বা কিশোর সংশোধনাগারে এসব শিশুর পুনর্বাসন হয়ে থাকে। সে ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটটের আদেশের প্রেক্ষিতে আইনানুযায়ী গাজীপুরে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক ড. মানোয়ার হোসেন মোল্লা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভবঘুরে এসব শিশুদের বিষয়ে জানতে পেরেছি। এসব শিশুরা শুধু নেশায় আসক্ত নয়, তারা বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকান্ডেও জড়িয়ে পড়ছে। অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া ও নোংরা পরিবেশে বসবাস করার কারণে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে এসব ভবঘুরে শিশু। আমরা দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে তাদেরকে আটক করে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। 

আরএআর

Visit Source Page

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *