আখলিমা বেগম। বয়স ৬২। থাকেন কড়াইল বস্তিতে। এই বস্তিতে তিন যুগের বেশি সময় ধরে তার বাস। এর মধ্যে তিনি দেখেছেন অনেক কিছু। বাড়ি চাঁদপুরের খলিফাকান্দি। নদীভাঙন তার অতীত স্মৃতি, তবে এখনও সজীব। জিজ্ঞেস করলেই ইতিউতি করে বলা শুরু করেন।
আখলিমা বেগম। বয়স ৬২। থাকেন কড়াইল বস্তিতে। এই বস্তিতে তিন যুগের বেশি সময় ধরে তার বাস। এর মধ্যে তিনি দেখেছেন অনেক কিছু। বাড়ি চাঁদপুরের খলিফাকান্দি। নদীভাঙন তার অতীত স্মৃতি, তবে এখনও সজীব। জিজ্ঞেস করলেই ইতিউতি করে বলা শুরু করেন।
বিয়ে করেছেন নওয়াব আলীকে। তিনিও নদীভাঙনের প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগী। নওয়াব আলীর পরিবারের পাঁচ কানি জমি ছিল। বিভিন্ন সময় নদী ভেঙে দিয়েছে সেই জমি, ভিটাবাড়িসহ সবকিছু। ৭/৮ বার ভাঙার পর আখলিমা বেগম-নওয়াব আলীর কোনো সম্বলই আর অবশিষ্ট ছিল না। বড় ভাইয়ের সহায়তায় তারা ঠাঁই নেয় ঢাকায়। নতুন ঠিকানা হয় কড়াইল বস্তি।
নব্বইয়ের দশক থেকে এখনও তিনি কড়াইলে। দুর্যোগপূর্ণ সময় পার করে স্থিতিশীল সময়ের আশায় তিনি। বেঁচে থাকার তাগিদে আখলিমা গৃহকর্মী হিসেবে কাজ শুরু করেন। অবশ্য আগে কখনও গৃহকর্মীর কাজ করেননি। সারাদিন কাজ করে পেতেন ৩০০ টাকা। অন্যদিকে, নওয়াব আলী চালাতেন রিকশা। তার কাছে জানতে চাওয়া হয়, আগে কি রিকশা চালাতেন? উত্তর, না। রিকশা চালিয়ে দৈনিক আয় হতো ৮০-১০০ টাকা। দুইজনের আয়ে চলতো তাদের এবং পাঁচ ছেলে-মেয়ের। তাদের লেখাপড়া, থাকাখাওয়া ও বিয়ে— সবই হয়েছে দুইজনের আয়ে। পাঁচ ছেলে-মেয়ের মধ্যে সবাই অল্পবিস্তর পড়াশোনা করলেও সর্বোচ্চ পড়াশোনা করেছেন একজনই, এইচএসসি পর্যন্ত।
আখলিমা বলেন, ‘আমি তো কোনো কামকাইজ পারি না, তয় মাইনষের বাসায় কাম কইরা কোনোরহম শুরু করছিলাম। সারাদিন আরেক বাসায় কাম কইরা আবার কড়াইলে এক বাসায় কাম করতাম। হেইয়ানেও কিছু টাকা পাইতাম। কারণ, আমাগো তো পাঁচডা পোলা-মাইয়া। অল্প আয় দিয়া ওগো পড়াশোনাও বেশি চালাইতে পারি নাই। তয় বড় পোলা মাঝেমইধ্যে ওর বাপেরে সাহায্য করতো।’
নিজ গ্রামে যান কি না— জানতে চাইলে বলেন, ‘৭/৮ বার ভাঙার পর তো আর কিছুই নাই। সব নদীর পানিত তলায় গেছে। বাড়ি যায় না। কই যামু? কিছুই তো নাই।’
সত্যিই তো, আখলিমা-নওয়াব দম্পতির বাড়ি তো নদীর পেটে। শুধু কি তাদের বাড়ি? তাদের পাশের বাড়িঘরও বিলীন হয়ে গেছে নদীভাঙনের কারণে— জানান নওয়াব আলী।
সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিস (সিইজিআইএস)-এর ২০২৩ সালের প্রকাশিত তথ্য বলছে, গত ২২ বছরে পদ্মা ও যমুনা নদীর ভাঙনে পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষ গৃহহীন হয়েছেন। বিলীন হয়েছে ৫০ হাজার ৯৫৫ হেক্টর জমি, যা সেন্টমার্টিন দ্বীপের চেয়ে ছয় গুণ বড়।
সিইজিআইএসের নির্বাহী পরিচালক মালিক ফিদা আবদুল্লাহ খান বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের পরোক্ষ প্রভাবে নদীভাঙন হচ্ছে। ফলে অভিবাসী বাড়ছে। কী পরিমাণ মানুষ অভিবাসী বা মাইগ্রেট হচ্ছে, তা এখনও বের করা যায়নি। তবে, কারিগরি প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমরা বড় তিনটি নদী— যমুনা, পদ্মা, গঙ্গা কতটুকু ভাঙছে তা বের করতে পারছি। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেশের সব নদীর ভাঙনের চিত্র শনাক্ত করা সম্ভব। তখন অভিবাসী বা মাইগ্রেন্টদের সংখ্যাও নিরূপণ করা যাবে।
নদীভাঙনে প্রতি বছর যেসব মানুষ বাস্তুচ্যুত হন তারা জমি, ভিটেমাটি হারিয়ে অসহায় জীবনযাপন করছেন বিভিন্ন শহরে। তারা মূলত জলবায়ু অভিবাসী। তাদের ঠাঁই মেলে কখনও বেগুনবাড়ি বস্তিতে; কখনও কড়াইল, কাউনিয়া, লালবাগ বা মোহাম্মদপুরের বস্তিতে।
নদীভাঙনের সঙ্গে ‘জলবায়ু পরিবর্তন’-এর সংশ্লিষ্টতা কীভাবে? জানতে চাওয়া হয় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার অ্যান্ড ফ্লাড ম্যানেজমেন্টের (আইডব্লিউএফএম) অধ্যাপক এ কে সাইফুল ইসলামের কাছে। তিনি বলেন, নদীভাঙন প্রকৃতিগত বিষয় এবং স্বাভাবিক ঘটনা। এটা জলবায়ু পরিবর্তনের আগেও হয়েছে, এখনও হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। তবে, নদীভাঙনের স্বাভাবিক ঘটনার সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের সম্পর্ক আছে।
আন্তর্জাতিক উদ্ভিদ সংরক্ষণ সম্মেলন (আইপিসিসি)-এর রিপোর্ট বলছে, ভবিষ্যতে যত তাপমাত্রা বাড়বে, বৃষ্টির পরিমাণ তত বাড়বে। বৃষ্টি বেশি হলে বন্যা বেশি হবে আর বন্যা বেশি হলে নদীভাঙনের প্রভাব বাড়বে। নদীভাঙন স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হলেও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সেই ঝুঁকি আরও বাড়ছে এবং বাড়বে। আর নদীভাঙন বাড়লে সেসব জায়গায় যাদের বাড়িঘর, জমিজমা ছিল তারা সবকিছু হারাবেন। সব হারিয়ে মানুষ তখন অভিবাসী হয়। এক শহর থেকে অন্য শহরে ঠাঁই নেয়।
আখলিমা-নওয়াব দম্পতি যখন কড়াইলে ঠাঁই নেয় তখন বস্তিটি এত বিস্তৃত ছিল না। এখন এর আকার বেশ বড়। জনসংখ্যাও বিশাল। তাদের মতো ৮০ হাজারেরও বেশি মানুষের বসবাস সেখানে। ৯০ একর জমিকে ঘিরে তাদের স্বপ্ন। এই বস্তিতে যাদের বাস তারা কেউই স্থায়ী বাসিন্দা নন। সবাই বিভিন্ন জায়গা থেকে এসে সেখানে আশ্রয় নিয়েছেন। সরেজমিনে সেখানে গিয়ে এমন অসংখ্য মানুষের দেখা মেলে। তাদের চেহারায় টিকে থাকার জোর প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হয়।
বস্তিতে কারা আসেন?
উন্নয়নকর্মী সুলতানা রায়হান মনি থাকেন কড়াইলে। সেখানেই তার বেড়ে ওঠা। আলাপকালে তিনি বলেন, কড়াইলে যারা আসেন বা থাকেন, তারা মূলত বাধ্য হয়েই আসেন। তাদের বেশিরভাগই জলবায়ু অভিবাসী। বিভিন্ন ধরনের দুর্যোগে পড়ে তারা নিজের বাড়িঘর হারিয়ে কড়াইলে ঠাঁই নিয়েছেন।
২০০৯ সালে আইসিডিডিআর,বি ও ব্র্যাকের গবেষক দল কড়াইল বস্তির ওপর একটি সমীক্ষা চালায়। সমীক্ষা বলছে, দরিদ্র জনগোষ্ঠীরা গ্রামীণ এলাকা থেকে বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক ও নদীভাঙনের মতো পরিবেশগত বিপর্যয়ের কারণে ঢাকায় এসে কড়াইলে বসবাস শুরু করেন।
ঢাকায় ঠাঁই নেওয়া এসব মানুষ কি খুব আরামে থাকেন? সবকিছু হারিয়ে যারা নতুন ভূমিতে ঠাঁই নেন তাদের আসলে কেমন লাগে? তারা কি নওয়াব আলীর মতো ‘অনুভূতিহীন’ হয়ে পড়েন? বেঁচে থাকার তাগিদে তাদের হয়তো অনুভূতি বিকিয়ে দিতে হয়। পড়তে হয় নতুন অজানা সংকটে।
আখলিমা বেগম বলেন, ‘আমরা যহন এইহানে আইছিলাম তখন ঝুলন্ত পায়খানায় আমাগো যাওয়া লাগতো। আবার সংখ্যাও ছিল কম। অসংখ্য মানুষের ভিড়ে লাইন ধরে বাথরুমে যাওয়ার কষ্ট বড়ই বেদনাদায়ক।’ ধীরে ধীরে পরিস্থিতি বদলে যেতে থাকে। সব পরিস্থিতি বদলালেও বদলায় না সম্ভাবনা। কারণ, আখলিমা-নওয়াব দম্পতি তাদের ভিটেবাড়ি কখনও আর ফিরে পাবেন না।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঢাকায় অভিবাসী হয়ে ওঠার গল্প নেহাতই কম নয়। মাইগ্রেশন পলিসি ইনস্টিটিউটের তথ্যানুযায়ী, প্রতি বছর ৪০ লাখ অভিবাসী বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন জেলা বা শহর থেকে ঢাকায় আশ্রয় নেন।
সবাই কি ভালো থাকেন?
নিজ নিজ অবস্থান থেকে জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার জন্য সবাই প্রতিনিয়ত যুদ্ধে নামেন। যেমন নেমেছেন আখলিমা-নওয়াব দম্পতি। ইন্টারনাল ডিসপ্লেসমেন্ট মনিটরিং সেন্টারের তথ্য বলছে, ২০১৪ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত এক কোটি ৪৭ লাখ বার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে দুর্যোগে এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ার কারণে।
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন নিয়ে কাজ করছে ব্র্যাক আরবান ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম। এই বিভাগের প্রধান ইমামুল আজম শাহী বলেন, মূলত মাইগ্রেশনের দুইটা ফ্যাক্টর থাকে। প্রথমটা, পুশ ফ্যাক্টর এবং দ্বিতীয়টা, পুল ফ্যাক্টর। অর্থাৎ দুর্যোগ, সাইক্লোন বা নদীভাঙনের কারণে যিনি বা যে পরিবার মাইগ্রেশনের শিকার হন সেটা হলো পুশ ফ্যাক্টর। আর স্যালাইনিটি বা লবণাক্ততার কারণে যিনি বা যে পরিবার মাইগ্রেশনের শিকার হন সেটা হলো পুল ফ্যাক্টর। বাংলাদেশে দুই ধরনের মাইগ্রেশনই হয়। তবে, এসব মাইগ্রেশনের সঠিক তথ্য কারও কাছে নেই।
কড়াইলের আরেক বাসিন্দা তাসলিমা আক্তার। বয়স ৩৪। চাঁদপুরের বাবুরচরে বাড়ি তার। ছোটবেলার স্মৃতিতে তার বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ এখনও সজীব। জানতে চাওয়া হয়, কেন তাদের বিচ্ছেদ হয়েছিল? তাসলিমা জানান, বারবার নদীভাঙার কারণে তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল খারাপ। বাবা-মায়ের মধ্যে প্রায়ই ঝগড়া হতো। পরে তা নিয়মিত হতে থাকে। এই ঝগড়া একসময় বিচ্ছেদে রূপ নেয়।
এরপর কিছুদিন দাদীর কাছে থেকে নব্বইয়ের দশকে মায়ের সঙ্গে চলে আসেন ঢাকায়। ঠাঁই নেন কড়াইলে। সঙ্গে ছিলেন তার ভাই দেলোয়ার। তারা ছোট একটা বাসাও ভাড়া নেন। তাসলিমার মা মানুষের বাসায় কাজ নেন। জানতে চাওয়া হয়, আপনার মা আগে কি কখনও গৃহকর্মীর কাজ করেছেন? জানান, তার মা আগে কখনও মানুষের বাসায় কাজ করেননি। এখানে এসে শুরু করেন। ঢাকায় গৃহকর্মীর কাজের বিনিময়ে পেতেন ১৫০ টাকা। ভাই দেলোয়ার শুরু করেন ইট পরিষ্কারের কাজ। সেই কাজে প্রতিদিন পেতেন চার টাকা। তা দিয়েই তাদের সংসার চলতো।
চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ ২০২২ সালের মার্চে ‘অ্যাসেসমেন্ট অব ইম্প্যাক্টস অব ক্লাইমেট ইন্ডাক্টেড মাইগ্রেশন ইন বাংলাদেশে অন ফিমেল ওয়ার্কার্স’ শিরোনামে একটি জরিপ প্রকাশ করে। সেই জরিপে বলা হয়েছে, ৫০ শতাংশের বেশি মাইগ্রেন্ট নারী বাস্তুচ্যুত হওয়ার আগে ছিলেন গৃহিণী। ঢাকায় আসার পরে অভিবাসী নারীদের ৫১ শতাংশ গৃহকর্মীর কাজে নিয়োজিত হন। মজার ব্যাপার হলো, বাস্তুচ্যুত হওয়ার আগে তাদের কেউই গৃহকর্মীর কাজে জড়িত ছিলেন না।
জরিপে অংশগ্রহণকারী নারীদের মধ্যে ১৬ শতাংশই ছিলেন দিনমজুর, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, বর্জ্য সংগ্রহকারী ও কৃষি খামারে কর্মরত। ঢাকায় আসার পর ৩৫ শতাংশ নারী দিনমজুরের কাজে নিয়োজিত হন। ১০ শতাংশ গার্মেন্টস শ্রমিকের কাজ নেন।
ছোট থেকে তাসলিমার বেড়ে ওঠা কড়াইলে। ১৯৯৮ সালের বন্যা দেখেন এই কড়াইলে। এখানেই তার বিয়ে হয় ২০০৪ সালে। সংসার-সন্তান সবই কড়াইলকে কেন্দ্র করে। জানতে চাওয়া হয়, চাঁদপুরের স্মৃতি মনে পড়ে কি না? জানান, স্মৃতি বলতে আসলে তেমন কিছু নেই। ছোটবেলায় বাবা-মার ঝগড়ার কথাই বেশি মনে পড়ে। আর মনে পড়ে, নদীভাঙার কারণে যাদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলাম, তাদের বাড়িও বিলীন হয় নদীর গর্ভে।
আগে কীভাবে থাকতেন? উত্তরে তাসলিমা বলেন, ‘আগে তো অবস্থা আরও খারাপ আছিল। ঝুলন্ত পায়খানায় যাওয়া লাগতো। সবসময় কি লাইন ধইরা যাওয়া যায়?’
জলবায়ু অভিবাসীদের মধ্যে, বিশেষ করে নারী ও শিশুরা যে প্রক্রিয়ায় মাইগ্রেন্ট হচ্ছেন এবং যে পরিবেশে এসে জীবনযাপন শুরু করছেন, এতে তাদের শরীর ও মনে কী ধরনের প্রভাব পড়ছে— জানতে চাওয়া হয় একশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবিরের কাছে। তিনি বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অভিবাসী নারী ও শিশুরা অর্থনৈতিক ক্ষতি ছাড়াও শারীরিক ও মানসিকভাবে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন। অভিবাসীরা শুধুমাত্র আর্থিক সম্পদ হারাচ্ছেন না বরং শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং সামাজিক নিরাপত্তার দিক থেকেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এই পরিস্থিতিতে তারা সহজেই জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। শহরাঞ্চলে এসে নতুন পরিবেশে জীবন শুরু করতে তারা বিভিন্ন সামাজিক ও স্বাস্থ্যগত সমস্যায় পড়ছেন, যার মধ্যে বাল্যবিবাহ অন্যতম।
সরেজমিনে দেখা যায়, তাসলিমার মতো অসংখ্য মানুষ গাদাগাদি করে এই বস্তিতে দিন যাপন করছেন। সেখানেই বেড়ে উঠছে তাদের সন্তানেরা। তারা কি আসলেই নিরাপদ বায়ু, জল, মাটি ও পরিবেশ পাচ্ছেন আসলেই কি তারা সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠছে?
স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, নিজের বসতি থেকে উচ্ছেদ হয়ে জলবায়ু অভিবাসীরা যখন ঢাকায় আসেন তখন তারা নতুন ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েন। পরিবেশগত কারণে অভিবাসীরা বায়ু, শব্দ ও পানি দূষণজনিত স্বাস্থ্যঝুঁকির মুখোমুখি হন। এটি তারা বুঝতে পারেন না। যেহেতু তারা বস্তি এলাকায় থাকেন, তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি আরও বেড়ে যায় উচ্চ তাপমাত্রা বা হিটওয়েভের কারণে। সেখানে স্যানিটেশন ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা যে উন্নত তাও বলার সুযোগ নেই। সেখানকার ঘরবাড়িতে বাতাস চলাচলের জায়গা থাকে না। ফলে তারা আগের অবস্থা থেকে কোনোভাবেই যে উন্নত জীবনযাপন করতে পারছেন, এই ধরনের কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই।
নদীভাঙনের কারণে তাসলিমার বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ, কড়াইলে আশ্রয় নেওয়া এবং সংসার পাতা— সবই ঘটে তার চোখের সামনে। জানতে চাওয়া হয়, কখনও ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন কি না? তাসলিমা বলেন, ‘হুনি তো অনেক কথা, কিন্তু আইজ পর্যন্ত কোনো কিছু তো পাইলাম না। খালি হুইনাই গেলাম। হেই সাপোর্ট পাইলে আমার পোলা-মাইয়ার লেহাপড়া ঠিকভাবে চালাইতে পারতাম।’
কেন তারা ক্ষতিপূরণ পান না— সিপিআরডির প্রধান নির্বাহী মো. শামসুদ্দোহা এ প্রসঙ্গে বলেন, কী পরিমাণ মানুষ ডিসপ্লেস হচ্ছেন বা মাইগ্রেট হচ্ছেন, তার সঠিক তথ্য-উপাত্ত বাংলাদেশে কারও কাছে নেই। কারণ হলো, কোনো এলাকায় যেকোনো দুর্যোগের কারণে কী পরিমাণ মানুষ ডিসপ্লেস হচ্ছেন বা মাইগ্রেট হচ্ছেন, সেই তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করাও সহজ নয়। এই ধরনের পরিকল্পনা বা জনবল কারও কাছে নেই। অথচ একাধিক প্রান্তিক শহরে মানুষ ডিসপ্লেস বা মাইগ্রেট হচ্ছেন। যদি তথ্যই রাখা না যায় তাহলে সহযোগিতা আসবে কীভাবে?
তবে, বেসরকারি পর্যায়ে কিছু কিছু এনজিও দুর্যোগের শিকার ভুক্তভোগীদের সাহায্যার্থে কাজ করছে, তাও পর্যাপ্ত নয়। ব্র্যাকের ক্লাইমেট ব্রিজ ফান্ডের সেক্রেটারিয়েট প্রধান ড. মো. গোলাম রাব্বানী বলেন, বাংলাদেশে যে পরিমাণ ক্লাইমেট মাইগ্রেন্ট; প্রথমত, পলিসি লেভেলে তাদের রিকগনাইজ করা হচ্ছে না। দ্বিতীয়ত, ক্লাইমেট মাইগ্রেন্টদের জন্য যে বাজেট বরাদ্দ তা আসলে পর্যাপ্ত নয়।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন ‘অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতি ব্যবস্থাপনা বিষয়ক জাতীয় কৌশলপত্র’ ২০২১-এ বলা হয়, বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী ২০৫০ সাল নাগাদ ১৪৩ মিলিয়ন মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগের কারণে ল্যাটিন আমেরিকা, সাব-সাহারান আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ায় বাস্তুচ্যুত হবে। শুধু দক্ষিণ এশিয়ায় বাস্তুচ্যুত হবে ৩৫ মিলিয়ন মানুষ। বাংলাদেশে বাস্তুচ্যুত ব্যক্তির সংখ্যা দাঁড়াবে ১৩ মিলিয়ন। ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বে প্রতি ৪৫ জনে একজন এবং বাংলাদেশে প্রতি সাতজনে একজন জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বাস্তুচ্যুত হবে।
তথ্য ও সংখ্যা বিচারে এর চাপ অনেক। তাদের ভাগ্যে কী হবে, তা কেউ জানেন না। যেমন জানেন না রুমা বেগম। তিনিও কড়াইলে জলবায়ু অভিবাসী। বয়স ৩৬। ভোলার চরফ্যাশনের আওয়াজপুরে তার বাড়ি। এখানেই তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। বিয়ে করেন ভোলার মির্জাকালু এলাকার নাজিমউদ্দিনকে। বয়স ৪৫। নাজিমউদ্দিন সম্পর্কে তার খালাতো ভাই।
নাজিমউদ্দিনের বাবার ভিটেবাড়ি নদীতে ভাঙে কয়েকবার। সর্বশেষ ১৯৯৮ সালের বন্যা ভিটেবাড়িসহ সবকিছু তলিয়ে যায়। বন্যায় বাড়ি ভাঙার পর তারা মির্জাকালুতে স্থায়ী হন। ২০০৪ সালে নাজিমউদ্দিন আর রুমার বিয়ে হয়। বিয়ের পর নাজিমউদ্দিন চলে আসেন ঢাকায়, আর রুমা থাকেন শ্বশুরবাড়িতে। ঢাকায় রিকশা চালিয়ে প্রতিদিন নাজিমউদ্দিনের আয় হতো ২০০-২৫০ টাকার মতো। সেই টাকার কিছু অংশ খরচ করে বাকিটা জমিয়ে রাখতেন।
তার কাছে জানতে চাওয়া হয়, এই পেশায় তিনি আগে ছিলেন কি না? জানান, ঢাকায় এসেই তিনি প্রথম রিকশা চালান। আগে এই পেশায় ছিলেন না। রিকশা চালিয়ে যা পান তা জমিয়ে কয়েক মাস পর বাড়ি যেতেন। যাওয়ার সময় কিছু নিয়ে যেতেন ঠিকই কিন্তু তা দিয়ে আসলে রুমার চলতে কষ্ট হতো। একপর্যায়ে রুমা ঠিক করলেন, আরও কিছু বাড়তি আয় প্রয়োজন। সেজন্য কখনও কাঁথা সেলাই বা অন্য কোনো কাজ করে আয় বাড়ানোর চেষ্টা করতেন। কিন্তু তেমন কিছু হচ্ছিল না।
একসময় রুমা চাষাবাদ করার পরিকল্পনা করেন। প্রথমে নিজের পাঁচ গন্ডা জমি দিয়ে শুরু করেন। জমিতে ধান ও সবজি চাষ করেন। ভালো ফলন দেখে রুমা পরের বছর বিভিন্নজনের কাছ থেকে সাত গন্ডা জমি নেন চাষের জন্য। কিছু টাকা ধার নিয়ে বিনিয়োগও বাড়ান। মোট ১২ গন্ডা জমিতে রুমা বোনেন স্বপ্নের ফসল।
কিন্তু ২০১৩ সালের বন্যায় রুমার সব ফসলি জমি তলিয়ে যায়। স্বপ্নও নিঃশেষ হয়ে যায় নিমিষে। লবণাক্ত পানিতে সব ফসল নষ্ট হয়ে যায়। ভয়াবহ বিপদে পড়েন তিনি। চাষাবাদ করতে গিয়ে ৩০ হাজার টাকার লোন পড়ে যায়। পাওনা টাকা না দিয়েই পালিয়ে চলে আসেন ঢাকায়।
ঢাকায় এসে শুরু করেন মানুষের বাসায় গৃহকর্মীর কাজ। অসুস্থতার কারণে সেটিও নিয়মিত করা হয়ে ওঠে না। ছিলেন কৃষক, হয়ে যান গৃহকর্মী। গৃহকাজ আর নাজিমউদ্দিনের রিকশা চলানোর আয় দিয়ে কোনোভাবে শুরু করেন নতুন জীবন। জানতে চাওয়া হয়, পাওনা টাকা পরিশোধ করেছেন কি না, করলে কীভাবে? রুমা বলেন, দুইজনের আয়-রোজগার দিয়ে আস্তে আস্তে সবার টাকা পরিশোধ করি। এরপর আর কখনও বাড়ি যাওয়া হয়নি। কেন? উত্তরে তিনি বলেন, ‘বন্যার লবণপানি আমার যে ক্ষতি করছিল, ঋণের জালে আটকা পড়ছিলাম। ট্যাকা দেওনের ডরে আমি পালাইছি, আর বাড়ি যায় নাই। তয় ঢাকায় আইসা সবার ট্যাকা পরিশোধ করছি আস্তে আস্তে।’
লবণাক্ততা, বন্যা, নদীভাঙন বা দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন কৃষক। কৃষক ঋণ করে ফসল ফলান, আর দুর্যোগ এসে তাকে নিঃস্ব করে দেয়। এই সংকট দূরীকরণে ক্রপ ইনস্যুরেন্স বা শস্যবীমা ভালো উদ্যোগ। যদিও কিছু কিছু এলাকায় পাইলট প্রকল্পের অংশ হিসেবে ক্রপ ইনস্যুরেন্স বা শস্যবীমা চালু রয়েছে। তবে, এর পরিধি খুবই স্বল্প। কৃষক যদি এই সংকটে সরকারি পর্যায় থেকে ক্রপ ইনস্যুরেন্স বা শস্যবীমা পেতেন, তাহলে তাকে বাস্তুচ্যুত বা মাইগ্রেন্ট হতে হতো না। কিংবা ঋণের ভয়ে বাড়ি ছাড়তে হতো না— বলেন কৃষি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ সমীরণ বিশ্বাস।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রতিবেদন বলছে, শহরের বস্তিগুলোতে সবচেয়ে বেশি বরিশাল জেলার মানুষের বসবাস। বস্তিগুলোতে প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ১৩ জনের বেশি বরিশাল থেকে আসা। বরিশালের পরই ৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ বাসিন্দা ময়মনসিংহ থেকে আসেন। এরপর রয়েছেন কিশোরগঞ্জের ৭ দশমিক ৮২ শতাংশ, কুমিল্লার ৬ দশমিক ৫২ শতাংশ এবং নেত্রকোনার ৫ দশমিক ২৫ শতাংশ মানুষ। বস্তিবাসীদের সাড়ে ৪২ শতাংশই এই পাঁচ জেলার মানুষ। মূলত জীবিকার সন্ধানে তারা শহরে স্থানান্তরিত হন।
চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ ২০২২ সালের মার্চে ‘অ্যাসেসমেন্ট অব ইম্প্যাক্টস অব ক্লাইমেট ইন্ডাক্টেড মাইগ্রেশন ইন বাংলাদেশ অন ফিমেল ওয়ার্কার্স’-এর জরিপ বলছে, প্রায় ৯৬ শতাংশ উত্তরদাতা তাদের নিজ শহর থেকে স্থানান্তরিত হয়েছেন। জলবায়ু অভিবাসীদের মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশ মহিলা বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে নিজের বাসভূমি হারিয়ে ঢাকায় আসেন। তাদের মধ্যে এক-পঞ্চমাংশ বরিশালের, ১০ শতাংশ নোয়াখালীর, ৭ শতাংশ ভোলার, ৫ শতাংশ রংপুর ও সিলেটের এবং ৪ শতাংশ জামালপুর, খুলনা ও সুনামগঞ্জের।
জলবায়ু অভিবাসীদের মধ্যে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ পরিবার তাদের এলাকায় অতিরিক্ত বৃষ্টি ও বন্যার সম্মুখীন হয়েছে। এক-চতুর্থাংশ পরিবার নদীভাঙনের কারণে বাস্তুচ্যুত হয়েছে। এক-পঞ্চমাংশ পরিবার প্রবল ঝড় ও ঘূর্ণিঝড়ের কারণে বাস্তুচ্যুত হয়েছে। এক-দশমাংশ পরিবার উচ্চ লবণাক্ততা ও ভূমিধসের কারণে মাইগ্রেন্ট হয়েছে।
কেন তারা স্থানান্তরিত হয়ে শহরে আসেন— উত্তরে সিপিআরডির প্রধান নির্বাহী মো. শামসুদ্দোহা বলেন, ‘মানুষের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কতখানি— সেটা কি আমরা সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারণ করে প্রতিকার করতে পেরেছি? কোনো এলাকায় বন্যা, দুর্যোগ বা সাইক্লোন হলে সরকার ত্রাণ দেয়। এটা ভালো দিক। কিন্তু সেই জায়গায় ভুক্তভোগীদের চাকরি বা ব্যবসার যে ক্ষতি হয় বা ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনায় যে ব্যাঘাত ঘটে বা মেয়েদের যে বাল্যবিবাহের দিকে ঝুঁকতে হয়— বিষয়টি নোটিশ করার মতো সরকারি কোনো প্রজেক্ট বা প্রকল্প আছে কি?’
‘আমরা দেখেছি, বাংলাদেশ সরকার যে প্রকল্পগুলো নেয় সবগুলো অনেক টাকার অবকাঠামোকেন্দ্রিক। সেখানে মানুষের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের বিষয়টি এখনও সঠিকভাবে গুরুত্ব পায়নি।’
বরাদ্দ কি থাকে?
সেন্টার ফর পার্টিসিপেটরি রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (সিপিআরডি) ও হেক্স/ইপিইআর-এর যৌথ উদ্যোগে ‘বাংলাদেশের জলবায়ু অর্থায়নে বণ্টনমূলক ন্যায়বিচার : নীতি গ্রহণের জন্য চ্যালেঞ্জ এবং সুপারিশ’ শিরোনামের গবেষণাপত্র বলছে, ২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডের ৫০ শতাংশের বেশি বরাদ্দ ব্যয় করা হয়েছে অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পে, যার আর্থিক মূল্য ২০৯৫.৪১ কোটি টাকা। অথচ ধীরগতির দুর্যোগ, যেমন- খরা মোকাবিলায় পর্যাপ্ত বরাদ্দ দেওয়া হয়নি।
বস্তি এলাকার অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়ন খাতে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের বাজেটে বরাদ্দ ছিল এক কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ১০ কোটি টাকা। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১০ কোটি টাকা। এই বাজেট কোন খাতে ব্যয় হয় তা জানতে চাওয়া হয় ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান সমাজ কল্যাণ ও বস্তি উন্নয়ন কর্মকর্তা মোহাম্মদ মামুন-উল-হাসানের কাছে। তিনি বলেন, বস্তি এলাকার অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়ন খাতের যে বাজেট, সেই বাজেট দিয়ে রাস্তা তৈরি, বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস লাইন সংস্কারসহ নানাবিধ কাজ করা হয়। এখানে জলবায়ু অভিবাসীদের জন্য আলাদা কোনো বরাদ্দ থাকে না।
এ খাতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের বাজেট সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়। সংস্থাটির প্রধান সমাজকল্যাণ ও বস্তি উন্নয়ন কর্মকর্তা (উপসচিব) মোহাম্মদ মোবাশ্বের হাসান জানান, বস্তি এলাকার অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়ন খাতে দক্ষিণ সিটি কোনো বাজেট বরাদ্দ রাখেনি। কেন রাখেনি, বিষয়টি আমি অবগত নই। সম্প্রতি আমি এই পদে এসেছি, পূর্বের কর্মকর্তারা বলতে পারবেন।
অর্থ বরাদ্দের বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের কাছে জানতে চাওয়া হয়। উত্তরে পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (জলবায়ু পরিবর্তন ও আন্তর্জাতিক কনভেনশন) মির্জা শওকত আলী বলেন, ‘ক্লাইমেট মাইগ্রেন্টদের জন্য সরকারের ডেডিকেটেড কোনো বাজেট বরাদ্দ নেই। তবে, লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড এক্সেস করা এবং কী পরিমাণ ক্লাইমেট মাইগ্রেন্ট আছেন, তাদের সংখ্যা নিরূপণের জন্য ২০২৪ সালের জুলাই থেকে স্টাডির কাজ শুরু হয়েছে। আশা করছি স্টাডির রেজাল্ট পেলে ক্লাইমেট মাইগ্রেন্টদের সুবিধার্থে কাজ করা যাবে।’
কেন এমন হয়— জানতে চাওয়া হয় আন্তর্জাতিক জলবায়ু অর্থায়ন বিশেষজ্ঞ ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের প্রধান নির্বাহী এম জাকির হোসেন খানের কাছে। তিনি বলেন, ‘একজন মানুষ যেকোনো দুর্যোগের কারণে যখন ডিসপ্লেস বা স্থানান্তরিত হচ্ছেন; তখন তিনি কোথায় যাচ্ছেন, কেন যাচ্ছেন, কীভাবে থাকছেন— বিষয়গুলোর আসলে কোনো ট্র্যাকিং সিস্টেম নেই। ট্র্যাকিং সিস্টেম না থাকায় ক্লাইমেট মাইগ্রেন্টদের তথ্য সঠিকভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে না। আর বাংলাদেশের যে বাজেট হয়, সেই বাজেটে জলবায়ু অভিবাসীদের জন্য ডেডিকেটেড কোনো ফান্ড থাকে না।’
উত্তরণের পথ কী— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সাইক্লোন সেন্টারের মতো আলাদা শেল্টার সিস্টেম তৈরি করতে হবে। যেখানে যেকোনো অঞ্চলের ডিসপ্লেস বা মাইগ্রেন্ট পরিবারগুলো এসে আশ্রয় নেবে। তাদের সব তথ্য রাষ্ট্রের কাছে থাকবে। সেই আলোকে ধাপে ধাপে পরিবারগুলোর ট্রেনিং নিশ্চিত করতে হবে। যাতে করে তারা স্বাবলম্বী হয়ে ওঠে। এর জন্য ডেডিকেটেড বাজেট থাকতে হবে।’
বিদেশি ফান্ড বা অনুদানের বিষয়ে অনেক কিছু শোনা যায়। বিষয়টি কতটুকু সত্য— জানতে চাওয়া হয় পিকেএসএফ-এর পরিচালক ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. ফজলে রাব্বি সাদেক আহমেদের কাছে। তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের রূপরেখা সম্মেলন (ইউএনএফসিসি) ও প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী উন্নত দেশের অনুদানভিত্তিক অর্থায়ন হওয়া জরুরি। বাংলাদেশের মতো জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশে যে ধরনের অর্থায়ন হওয়া উচিত, সেই ধরনের অর্থায়ন আমরা পাচ্ছি না। সর্বোচ্চ ১-৫ শতাংশ আমরা পাচ্ছি। গুণগত মান বিচারে এই অর্থও আসলে কার্যকর নয়। জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশে এই অর্থায়ন হওয়া উচিত অনুদান ভিত্তিক, ঋণভিত্তিক নয়।
সমাধান কী?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) চেয়ারপার্সন ড. তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, বাংলাদেশের ১৯টা জেলা দুর্যোগপ্রবণ। জেলাগুলো আমরা চিহ্নিত করতে পেরেছি। এইসব এলাকা থেকে যেসব কারণে মানুষের মাইগ্রেট হয়, তার মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন অন্যতম। ক্লাইমেট মাইগ্রেশন কমানোর জন্য সরকারকে আরও দূরদর্শী হতে হবে। দিল্লি-মুম্বাইতে প্রচুর লোক পেরি আরবান বা শহরের চারপাশে থাকে। তারা খুব সহজেই কাজের সময় শহরে ঢুকে আবার চলে যায়। ক্লাইমেট মাইগ্রেন্টদের জন্য যেকোনো উন্নত শহরের মতো আমরা এই ধরনের ব্যবস্থা করতে পারি। এতে করে গ্রোথ সেন্টারগুলো ডিসেন্ট্রালাইজ (বিকেন্দ্রীকরণ) হবে।
অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতি ব্যবস্থাপনা বিষয়ক জাতীয় কৌশলপত্র ২০২১-এ বলা হয়েছে, বাস্তুচ্যুত বা মাইগ্রেন্টরা সব ধরনের অধিকার পাবে, যেভাবে একজন স্বাভাবিক মানুষ রাষ্ট্রের সব অধিকার ভোগ করেন। কৌশলপত্রে বৈষম্যহীনতা বা সমতার অধিকার, নিরাপত্তার অধিকার, জীবনের অধিকার, উন্নয়নের অধিকার, বাসস্থানের অধিকার, কাজ পাওয়ার অধিকার, অংশগ্রহণের অধিকার এবং তথ্য পাওয়ার অধিকারের কথা বলে হয়েছে। সরকারকে এইসব লক্ষ্য অর্জনে আরও গতিশীল হতে হবে। যাতে ক্লাইমেট মাইগ্রেশন কমানো যায়।
জলবায়ু অভিবাসীদের যে ধরনের জীবনমান থাকার কথা তা আছে কি না— জানতে চাওয়া হয় বুয়েটের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. ইশরাত ইসলামের কাছে। তিনি বলেন, ‘অভিবাসী যারা হন, তারা মূলত দরিদ্র জনগোষ্ঠী। তাদের জন্য কাজ বা অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা থাকে কম। আর ঢাকায় যারা বস্তিতে থাকেন, তাদের মানবেতর জীবনযাপন করতে হয়। বন্যা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জলবায়ু পরিবর্তন বা নদীভাঙনের কারণে বিভিন্ন এলাকা থেকে কাছাকাছি শহর বা মূল শহরে অভিবাসীদের ভিড় বাড়তে থাকে। এখানে তারা যে খুব ভালো থাকবেন, সেই আশা কম। কিন্তু এখানে তারা কোনো না কোনো কাজ জুটিয়ে চলতে পারবেন, এই আশায় ঢাকায় ছুটে আসেন।
‘এই যে এত বড় একটা বিষয়— জলবায়ু অভিবাসী, এটা কোথাও আমরা অ্যাড্রেস করছি না। জলবায়ু অভিবাসীদের জন্য আলাদা কোনো নগর বা অঞ্চল গড়ার পরিকল্পনাও আমরা করছি না। মূল বিষয় হলো, যাদের আসলে অ্যাড্রেস করাই হচ্ছে না, তাদের সুযোগ-সুবিধা কোথা থেকে আসবে? ফলে তাদের জীবন আর উন্নত হয় না। তাদের ছেলে-মেয়েদের সুযোগ-সুবিধার বাইরে থেকে লড়াই করতে হয়।’
কাজ করার সুযোগ থাকলেও কেন হচ্ছে না— জানতে চাওয়া হয় জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাতের কাছে। তিনি বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে স্থানান্তর বা অভিবাসী হওয়া বাংলাদেশের জন্য নতুন কিছু নয়। বরং ক্লাইমেট মাইগ্রেন্টরা ইকোনমিক মাইগ্রেন্টদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাচ্ছেন। এই বিষয়ে কাজ করার সুযোগ রয়েছে। আর ক্লাইমেট মাইগ্রেন্টরা যে জায়গা থেকে অভিবাসী হচ্ছেন, সেইসব জায়গা আমাদের অচেনা বা অজানা নয়। সেইসব জায়গায় সরকার যদি নতুন করে কর্মসংস্থান তৈরি করে, সুপেয় পানি, খাবার ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করে; তাহলে তারা স্থানান্তরিত হবেন না। এখানে সরকারের আন্তরিকতার ঘাটতি আছে।’
বিডি/এমএআর/