ছেলেটা বলেছিল— ‘মা ঘরে চাল নেই, না খেয়েই মারা যাবো মনে হচ্ছে’

ছেলেটা বলেছিল— ‘মা ঘরে চাল নেই, না খেয়েই মারা যাবো মনে হচ্ছে’

ছাত্র আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হওয়ার একদিন আগে পারভেজের সঙ্গে কথা হয় তার মা ফাতেমা বেগমের। ছেলে তার মাকে বলেন, ‘মা আমি বাঁচবো না, না খেয়েই মারা যাবো। প্রতিউত্তরে তার মা বলেন, বাবা তুই বাড়ি চলে আয়। মা যদি একমুঠো খেতে পারি, তুইও পারবি।’ কিন্তু না খেয়ে মারা না গেলেও, গুলি খেয়ে নিহত হয়েছেন পারভেজ। জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করেও বাঁচতে পারেননি তিনি।

ছাত্র আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হওয়ার একদিন আগে পারভেজের সঙ্গে কথা হয় তার মা ফাতেমা বেগমের। ছেলে তার মাকে বলেন, ‘মা আমি বাঁচবো না, না খেয়েই মারা যাবো। প্রতিউত্তরে তার মা বলেন, বাবা তুই বাড়ি চলে আয়। মা যদি একমুঠো খেতে পারি, তুইও পারবি।’ কিন্তু না খেয়ে মারা না গেলেও, গুলি খেয়ে নিহত হয়েছেন পারভেজ। জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করেও বাঁচতে পারেননি তিনি।

‘পারভেজ ছোটবেলা থেকেই সংসার খরচ দিতো। ছেলেটা পড়ালেখা বেশি করতে পারেনি। তবে তার বোনদের পড়ালেখার খরচ সে বহন করতো। আজতো সে নেই। আগে তো সংসার খরচ পারভেজ চালাইতো। সামনে কে দেবে? তার বাবার সামর্থ্য নেই কোনো কাজ করার। তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ।’

কথাগুলো বলছিলেন গত ৪ আগস্ট রাজধানীর মিরপুর ১০ নাম্বারে আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে ছাত্র আন্দোলনের সময় মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত পারভেজের মা ফাতেমা বেগম।

‘পারভেজের বাবা মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। প্রায়ই তিনি পারভেজকে দা-বঁটি নিয়ে ধাওয়া করতেন। এতে বেশি বাড়িতে থাকা হয়নি তার। শিশুকাল কেটেছিল নানার বাড়িতে। চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখাও করেছিলেন। কিন্তু পরিবারের অভাব অনটনের কারণে ১২ বছর বয়সেই কাজের সন্ধানে ঢাকা শহরে পাড়ি দেন তিনি। সেখানে কাজ জোটে থাই গ্লাসের দোকানে। সেখানে কাজ শুরু করা সেই ছোট্ট পারভেজের বয়স দাঁড়িয়ে হয় ২২ বছর। ছোটবেলা থেকেই সংসারের হাল ধরেছিলেন তিনি। এখন তো তিনি নেই, সংসারের হাল ধরার মতো কেউ রইলো না তার পরিবারে।’ মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত পারভেজ হোসেনের পরিবারের ঘটনাটা এমনই।

বৃহস্পতিবার (১৯ সেপ্টেম্বর) বিকেলে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার চন্দ্রগঞ্জ ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের ধন্যপুর গ্রামের মিন্নত আলী হাজী বাড়িতে গেলে পারভেজের স্বজনরা এভাবেই তার জীবনে কিছু কথা জানান। পারভেজ ওই বাড়ির নবী উল্যা ও ফাতেমা বেগম দম্পতির বড় ছেলে।

জানা গেছে, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় ৪ আগস্ট রাজধানীর মিরপুর ১০ নাম্বারে আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে পারভেজের মাথায় গুলি লাগে। এরপর ১ মাস ৮ দিন চিকিৎসাধীন থেকে ১২ সেপ্টেম্বর সকালে রাজধানীর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্সেস হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) তিনি মারা যান। তিনি মিরপুর ১০ নাম্বারে সেনপাড়া থাই গ্লাসের দোকানে কাজ করতেন।

পারভেজের মা ফাতেমা বেগম বলেন, ঢাকার মিরপুর ১০ নাম্বারে স্ত্রী রুপা আক্তারকে নিয়ে পারভেজ ভাড়া বাসায় থাকতো। আন্দোলনের সময় দোকান বন্ধ ছিল। তার বাসায় পর্যাপ্ত খাবার ছিল না। এ জন্য আমাকে বলেছিল, মা ঘরে চাল নেই, না খেয়েই মারা যাবো মনে হচ্ছে। আমি চলে আসতে বলেছি, কিন্তু সে আর আসেনি। বাড়িতে তার লাশ এসেছে। পারভেজের স্ত্রী তার বাবার বাড়ি পাবনায় চলে গেছে।

তিনি আরও বলেন, ঘটনার দিন এক ডাক্তার ফোন দিয়ে বলেছিলেন মোবাইলের মালিক কে হয়? আমি বলেছি আমার ছেলে। তারপর বলেছে, তার নাম কী? বললাম পারভেজ। তখন বলেছে আপনার ছেলে গুলিবিদ্ধ হয়েছে, তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। পরে হাসপাতালে গিয়ে দেখি, আমার ছেলে কথা বলতে পারে না। প্রথম থেকেই একই অবস্থা। মাঝে মধ্যে হাতের ইশারা দিয়ে কিছু বুঝানোর চেষ্টা করতো, কিন্তু কিছুই বুঝতাম না।

ঢাকায় হাসপাতালে পারভেজকে দেখতে যান তার বোন নাহিদা আক্তার। কিন্তু শেষবারের মতো ভাইয়ের সঙ্গে একটি কথা বলতে পারেননি তিনি। উলটো তার দাবি, ভাই তার সঙ্গে রাগ করেই চলে গেছে না ফেরার দেশে। তিনি বলেন, আমি হাসপাতালে গিয়েছি। ভাইকে আইসিউতে রাখা হয়েছিল। সেখানে থাকা লোকজনকে পরিচয় দিলে তারা আমাকে ভাইয়ের কাছে যেতে দেয়। ভাই প্রথমে চোখ বন্ধ করে রেখেছিল। পরে চোখ খুলে আমাকে দেখতে পেয়ে হাতে লাগানো স্যালাইনসহ বিভিন্ন ডাক্তারি সরঞ্জাম খুলে দিতে ইশারা করে। খুলে না দেওয়ায় একপর্যায়ে ভাই আমার ওপর রাগ হয়ে গেছে। পরে সেখানের লোকজন আমাকে বের হয়ে যেতে বলেন।

ভাইয়ের কথা মনে পড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে দুই চোখে পানি চলে আসে নাহিদার। এরপর আর কোনো জবাব দিতে পারেননি তিনি।

মানসিক সমস্যা থাকায় প্রায়ই ধাওয়া করা ছেলেটির জন্য এখন পরান পোড়ে বাবা নবী উল্যার। তিনি বলেন, হঠাৎ দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছে, অবশ্যই ছেলেটার জন্য মন টানে। কোরবানের ঈদের সময় বাড়িতে আসেনি। বাড়িতে থাকলে তো আর ছেলেটা এভাবে মারা যেতো না।

পারভেজের চাচাতো ভাই আরাফাত হোসেন কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, পারভেজই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন। আমার বিকাশেই বাড়ির জন্য সবসময় টাকা পাঠাত। বাড়িতে আসলে আমার সঙ্গেই সবচেয়ে বেশি সময় কাটাত। তাকে ভুলে যাওয়া আমার পক্ষে কখনো সম্ভব হবে না।

গ্রাম পুলিশের সদস্য সাইফুল ইসলাম বলেন, পারভেজই সংসারের খরচ চালাতো। তার বাবা মানসিকভাবে অসুস্থ। প্রায়ই ঘরে ভাঙচুরসহ বিভিন্ন সমস্যা করেন। এলাকার মানুষ তাদের পর্যাপ্ত সহায়তা করেন। পারভেজের এক বোনকে এলাকার সবাই উদ্যোগ নিয়ে বিয়ে দিয়েছে। এখনো তার একটি বোন অবিবাহিত আছে। এছাড়া তার ছোট দুটি শিশু আছে। তাদের সংসারে হাল ধরার কেউ নেই। এখন অনেকেই তাদের সাহায্য করেছে। কিন্তু পরবর্তীতে তাদের সংসার চালানোর মতো কেউ থাকলো না।

তিনি আরও বলেন, ১৩ সেপ্টেম্বর স্থানীয় কামারহাট ঈদগাঁহ মাঠে পারভেজের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। তাদের পারিবারিক কবরস্থান বন্যার পানিতে ডুবে ছিল। এতে পার্শ্ববর্তী আরেক জায়গায় তার মরদেহ দাফন করা হয়েছে। পারভেজের মৃত্যু সনদ ইউনিয়ন পরিষদের কার্যালয় থেকে এনে তার মাকে বুঝিয়ে দিয়েছি।

হাসান মাহমুদ শাকিল/এফআরএস

Visit Source Page

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *