ছাত্র আন্দোলনে নিহত সজিবের দুই শিশু ও পরিবারের খোঁজ নেয়নি কেউ

ছাত্র আন্দোলনে নিহত সজিবের দুই শিশু ও পরিবারের খোঁজ নেয়নি কেউ

ঘরের দরজায় কেউ কড়া নাড়লেই তিন বছরের আব্দুর রহমান মনে করে তার বাবা এসেছে। আব্দুর রহমানের ছোট ভাই আহাদও অস্পষ্ট স্বরে বাবাকে ডাকে। বাবা সজিব হাওলাদার আর আসবে না জেনেও অবুঝ দুই শিশুকে মিথ্যা সান্ত্বনা দিয়ে যাচ্ছেন মা রাবেয়া বেগম। এভাবেই অবুঝ দুই সন্তানকে নিয়ে দিন কাটছে তার। 

ঘরের দরজায় কেউ কড়া নাড়লেই তিন বছরের আব্দুর রহমান মনে করে তার বাবা এসেছে। আব্দুর রহমানের ছোট ভাই আহাদও অস্পষ্ট স্বরে বাবাকে ডাকে। বাবা সজিব হাওলাদার আর আসবে না জেনেও অবুঝ দুই শিশুকে মিথ্যা সান্ত্বনা দিয়ে যাচ্ছেন মা রাবেয়া বেগম। এভাবেই অবুঝ দুই সন্তানকে নিয়ে দিন কাটছে তার। 

তাদের পরবিবারের দাবি, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিহত হয়েছেন সজিব হাওলাদার। এখন পর্যন্ত সজিবের অবুঝ দুই সন্তান ও পরিবারের খোঁজ-খবর নেয়নি কেউ। সম্প্রতি শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার সখিপুর থানার চরকুমারিয়া ইউনিয়নের মাঝিকান্দি গ্রামে গিয়ে সজিব হওলাদারের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া যায়।

সজিবের পরিবার ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, নজরুল হাওলাদারের ছেলে সজিব হাওলাদার। তিনি পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করে পালিয়ে ঢাকায় গিয়ে খাবার হোটেলে কাজ নেন। এরপর সেখানেই বড় হয় সজিব। ২০১৭ সালে চাঁদপুর জেলার হাইমচর উপজেলার ভৈরবী গ্রামের হযরত আলীর মেয়ে রাবেয়াকে বিয়ে করেন। বিয়ের পরে সজিব হোটেলের কাজ ছেড়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে যাত্রাবাড়ি এলাকায় ভ্রাম্যমাণ চা বিক্রির পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যবসা শুরু করেন। এরই মধ্যে সজিব ও রাবেয়া দম্পত্তির ঘর আলো করে জন্ম হয় আব্দুর রহমান (৩) ও আহাদ (১১ মাস) নামে দুই সন্তানের। স্ত্রী-সন্তান ও মা সেলিনাকে নিয়ে বেশ ভালোই কাটছিল সজিবের সংসার।

যাত্রাবাড়ী এলাকায় ভ্রাম্যমাণ হিসেবে চা বিক্রি করলেও সজিব রাজধানীর ডেমরা থানার মিরপাড়া স্টাফ কোয়াটারের মারিয়া কমিউনিটি সেন্টারের ৬ষ্ঠ তলায় ভাড়া থাকতেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এক পর্যায়ে সরকার পতনের এক দফা দাবিতে রূপ নিলে সজিব আন্দোলনকে সমর্থন দেয়। চা বিক্রির ফাঁকে আন্দোলরত ছাত্র-জনতার মধ্যে পানি, চা ও বিস্কুট বিতরণ করতেন সজিব। এছাড়া কাজের ফাঁকে সজিব ও তার বড় ভাই রানা হাওলাদার প্রতিদিনই আন্দোলনে যোগ দিতেন। ৫ আগস্ট বেলা ১১টা পর্যন্ত সজিবকে আন্দোলনকারীদের সহযোগিতা করতে দেখা যায়। এরপর সে নিখোঁজ হলে অনেক খোঁজাখুজি করেও তার কোনো সন্ধান পায়নি পরিবারের সদস্যরা। স্থানীয়দের সহযোগিতায় নিখোঁজের ১০ দিন পরে নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদী থেকে সজিবের অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার করে সোনারগাঁও থানা পুলিশ। মরদেহের জিন্সের প্যান্টে থাকা একটি মোবাইল ফোন থেকে সজিবের পরিবারকে খুঁজে বের করে পুলিশ। পরে তাকে শরীয়তপুরের গ্রামের বাড়িতে এনে দাফন করা হয়। সজিবের পরিবারের দাবি আন্দোলনের শেষ দিন সজিব পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার পর তাকে নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। এরপর সজিবের অবুঝ দুই সন্তানের মুখে খাবার তুলে দিতে অসহায় মা রেহানা বেগমকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। কিন্তু এখনো সরকার বা কোনো প্রতিষ্ঠান সজিবের পরিবারের কোনো খোঁজ-খবর নেয়নি।

সজিবের ভাই রানা হাওলাদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমিও আন্দোলনে ছিলাম। নিখোঁজের তিন দিন আগে মায়ের সঙ্গে কথা হয়েছে বাড়িতে ফিরব বলেছিল। কিন্তু আর ফেরা হয়নি। শেখ হাসিনা পদত্যাগ করার পরে আমরা সজিবকে অনেক খোঁজাখুজি করেছি। কিন্তু কোথাও পাইনি। নিখোঁজের ১০ দিন পরে নারায়ণগঞ্জে তার মরদেহ পেয়েছি। আমার ছোট ভাইয়ের দুইটি ফুটফুটে বাচ্চা রয়েছে। তার সংসার ভালোই চলছিল। কিন্তু এখন আমার পরিবার পুরো হতাশায় ভুগছে। কেউ আমাদের কোনো খবর নেয়নি। আমার ভাই হারিয়ে ফেলছি কিন্তু ওর দুইটি বাচ্চা আছে। সরকার বা কোনো প্রতিষ্ঠান অবুঝ বাচ্চা দুইটির মুখের খাবার ও পড়াশোনার দায়িত্ব নিলে ভবিষ্যত অন্ধকারটা আর থাকত না।

সজিবের স্ত্রী রাবেয়া বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আব্দুর রহমান ও আহাদের বাবা তার মায়ের বুকের দুধ ছাড়ার আগেই এতিম হয়েছে। আমার দুই সন্তানের মধ্যে বড় ছেলে সব সময় জানতে চায় ওর বাবা কোথায় গেছে, কখন আসবে। আর ছোট ছেলেটা ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে বাবা বাবা ডাকতে শুরু করেছে। আমি তাদের প্রতিদিনি মিথ্যা কথা বলি। বলি, তোমার বাবা বেড়াতে গেছে। ক’দিন পরই চলে আসবে। বর্তমানে আমার মায়ের আয় থেকে দুই সন্তান নিয়ে কোনোরকম দিন পার করছি। আপনারা জানেন একজন চা বিক্রেতার কী পুঁজি থাকে? আমার পরিবারও গরিব। এখনো আমার মা প্রতিদিন কাজ না করলে না খেয়ে থাকতে হয়। তার (সজিব) অনেক ইচ্ছে ছিল নিজের দুই সন্তানকে পড়াশোনা করাবেন। কিন্তু এখন এটা কী হলো? আমি চাই এতিম দুইটি বাচ্চার দায়িত্ব নিয়ে আমার স্বামীর স্বপ্ন পূরণ করে দেবে দেশের সরকার ও মানুষ। এছাড়া আমার কিছু চাওয়ার নেই।

নিহত সজিবের দুধ মা সেলিনা বেগম বলেন, সজিবকে আমি নিজের পেটের সন্তানের মতো করে বুকের দুধপান করিয়েছি। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করে সজিব পালিয়ে ঢাকা চলে গেছে। এরপর সে নিজে বড় হয়ে আয় করা শেখার পরে বিয়ে করেছে। আমার সজিব ১০-১৫ দিন পর পর আমাকে দেখতে বাড়িতে আসত। আমার খরচ দিতো, খবর নিতো। আমার ফুটফুটে দুইটা নাতি। অনেক স্বপ্ন ছিল আমার বাবার। কিন্তু বাবা এখন আমার কবরে শুয়ে আছে। কে দেখবে আমার নাতিদের, কে নিবে আমার খবর? কার কাছে বলব আমি দুঃখের কথা? কেউ কী সজিবের সন্তানদের কোলে নিয়ে আদর করে দায়িত্ব নিবে?

চরকুমারিয়া ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান আয়েশা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, সজিব হাওলাদার নিতান্ত গরিব পরিবারের সন্তান। ছোটবেলায় মাকে হারিয়েছে। ঢাকায় সে চা বিক্রি করত। তার দুইটি সন্তান রয়েছে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সজিব ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেছে। তাকে গত মাসে শরীয়তপুরের গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হয়েছে।

সাইফ রুদাদ/আরকে

Visit Source Page

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *