‘খাদেম-গোলাম রেলগাড়ী’

‘খাদেম-গোলাম রেলগাড়ী’

তখন দুপুর পৌনে দুইটা। বাগমারা উপজেলার বীরকুৎসার হাজার দুয়ারী ঘুরে দেখা শেষ। ভিন্ন রাস্তায় বাড়ি ফেরার পথে কানে ভেসে এলো ট্রেনের শব্দ। থেমে স্থানীয়দের থেকে জানা গেল সামনেই রেলওয়ে স্টেশন রয়েছে। স্টেশনটির নাম ‘বীরকুটশা’। অবাক হলাম বাগমারায় ট্রেনের স্টেশন। তবে এলাকার নাম বীরকুৎসা হলেও বানানের পার্থক্য থাকালেও স্টেশনের লেখা নাম ‘বীরকুটশা’।

তখন দুপুর পৌনে দুইটা। বাগমারা উপজেলার বীরকুৎসার হাজার দুয়ারী ঘুরে দেখা শেষ। ভিন্ন রাস্তায় বাড়ি ফেরার পথে কানে ভেসে এলো ট্রেনের শব্দ। থেমে স্থানীয়দের থেকে জানা গেল সামনেই রেলওয়ে স্টেশন রয়েছে। স্টেশনটির নাম ‘বীরকুটশা’। অবাক হলাম বাগমারায় ট্রেনের স্টেশন। তবে এলাকার নাম বীরকুৎসা হলেও বানানের পার্থক্য থাকালেও স্টেশনের লেখা নাম ‘বীরকুটশা’।

একটি মাত্র ট্রেন থামে স্টেশনটিতে। কিন্তু স্টেশনের সামনের লাইন দিয়ে ঢাকা-দিনাজপুর ও রাজশাহী নিলফামারী রুটের সব ট্রেন চলাচল করে। কিন্তু শুধুমাত্র থামে খুলনা-পার্বতীপুরের মধ্যে চলাচল করা রকেট এক্সপ্রেস। একটি ট্রেন থামায় এই অঞ্চলের মানুষের মনে দুঃখ। কারণ তারা রাজশাহী জেলার বাগমারা উপজেলার বাসিন্দা হলেও নিজ উপজেলার একমাত্র স্টেশনে ট্রেন না থামার দুঃখ তাদের দীর্ঘদিনের।

মজার বিষয় হচ্ছে- বীরকুটশা স্টেশনটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ দাবি করছেন- রাজশাহীর বাগমারার যৌগিপাড়া ইউনিয়ন ও নাটোরর নলডাঙ্গার মাধনগর ইউনিয়নে মানুষ। 

তাদের দাবি- বীরকুটশা স্টেশনের রেললাইন সংযোগ রাজশাহী ও নাটোর জেলাকে বিভক্ত করেছে। এক কথায় দুই জেলার উপজেলার সীমানা। রেললাইনের উত্তরপাশে বাগমারা আর দক্ষিণ পাশে নাটোরের নলডাঙ্গা উপজেলা। স্টেশনটি চালু থাকা অবস্থায় দুই উপজেলা ছাড়াও আশেপাশের উপজেলার মানুষ ট্রেন সুবিধা পেত। বর্তমানে তাদের ঢাকা, খুলনা বা রাজশাহীতে ট্রেনে যেতে হলে নওগাঁর আসনাগঞ্জ স্টেশন নয়তো নাটোর স্টেশনে গিয়ে ট্রেন উঠতে হয়। এমন দুর্ভোগ তাদের সফর সঙ্গী হয়ে উঠেছে বিগত ৮ থেকে ১০ বছর ধরে।  

স্টেশনে গিয়ে দেখা গেল- টিকিট কাউন্টার বন্ধ। স্টেশন মাস্টারের রুমে তালা। মেঝে কোথাও কোথাও দেবে গেছে। মাথার উপরে ছাদের বেশকিছু জায়গার পলেস্তারা খুলে পড়ে গেছে। কোথাও কোথাও জং ধরা রড দেখা যাচ্ছে। সর্বশেষ ২০১৫ সালে শেড/যাত্রী ছাউনি নতুন করে স্থাপন করা হয়। শুয়ে আছেন কয়েকজন ভবঘুরে। যাত্রীহীন অবস্থায় থাকা স্টেশনটিতে রকেট এক্সপ্রেস ট্রেন থামে। ট্রেনটি খুলনা থেকে পার্বতীপুরের উদ্দেশ্যে ছাড়ে সকাল ৯টা ৩০ মিনিটে। পার্বতীপুর পৌঁছায় রাত ১০টায়।

যাত্রী খরা স্টেশনে কালো বোর্ডে সাদা কালিতে লেখা চোখে পড়ে অনায়াসে। যাত্রীদের উদ্দেশ্যে লেখায় বার বার বিভিন্নভাবে যাত্রীদের ট্রেনের টিকিট কাটতে আকুতি মিনতি করেছেন ‘খাদেম-গোলাম রেলগাড়ী।’

তাতে লেখা আছে- ‘সম্মানিত যাত্রী মহোদয়গণ, আপনাদের যাত্রা শুভ হোক, এই কামনা করে একটি মাত্র অনুরোধ রাখছি দয়া করে আপনাদের গন্তব্য স্থলের একখানা করে টিকিট কিনুন। অনেক বয়স আমার জন্ম থেকেই আপনাদের খেদমত করে আসছি। ভীষণ অসুস্থ আমি, আমার চিকিৎসার দরকার, প্রয়োজনীয় খাদ্যের দরকার, এছাড়াও আমার চলার একটিমাত্র পথ সেটিও অনেক দুর্বল, মেরামত প্রয়োজন, তা না হলে আমি যে আর চলতে পারবো না। আপনাদেরকে মালামালসহ সঠিক স্থানে সময় মতো পৌঁছাতে পারবো না। হয়তোবা হঠাৎ করেই একদিন বন্ধ হয়ে যাব। আমাকে ফাঁকি দিয়ে বা অবহেলা করে আপনারাও ফাঁকিতে পড়বেন না বা কন্ঠের মুখোমুখি হবেন না। কাউকে ফাঁকি দিয়ে কেউ সুখী হতে পারে না। একখানা টিকিট কিনুন ও মালামাল বুক করুন, যাত্রা শুভ করুন এবং আমাকে বাঁচিয়ে রাখুন। আপনাদেরই খাদেম-গোলাম রেলগাড়ী।’

রেলওয়ে স্টেশনে লেখা ট্রেনের সময় সূচি মতে একসময় আটটি ট্রেন থামতো এই স্টেশনে। সেই হিসেবে একটি ট্রেন যাওয়া আশা নিয়ে আটটি ট্রেন ১৬ বার দাঁড়ায়। ফলে দিনভর যাত্রীদের আনাগোনায় ভরপুর থাকত স্টেশনটি। সাতটি আন্তঃনগর ও দুটি মেইল ট্রেন এবং লোকাল একটি ট্রেন থামত।  

এই স্টেশনে দাঁড়াতো আন্তঃনগর ট্রেনগুলো হচ্ছে- ঢাকা ও দিনাজপুরের মধ্যে চলাচল করা দ্রুতযান এক্সপ্রেস, খুলনা ও সৈয়দপুরের মধ্যে চলাচল করা সীমান্ত এক্সপ্রেস, একই রুটের রূপসা এক্সপ্রেস, রাজশাহী চিলাহাটির মধ্যে চলাচল করা তিতুমীর এক্সপ্রেস, একই রুটের বরেন্দ্র এক্সপ্রেস, ঢাকা-লালমনিহাটের মধ্যে চলাচল করা লালমনি এক্সপ্রেস, ঢাকা-দিনাজপুরের মধ্যে চলাচল করা একতা এক্সপ্রেস।

মেইল ট্রেনের মধ্যে রাজশাহী-পার্বতীপুরের মধ্যে চলাচল করা উত্তরা ও খুলনা-পার্বতীপুরের মধ্যে চলাচল করা রকেট। সর্বশেষ গত  ১৪ মাস আগে উত্তরা ট্রেনটি বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে একটি মাত্র ট্রেন থামে খুলনা-পার্বতীপুরের মধ্যে চলাচল করা রকেট। এছাড়া লোকাল গোয়ালন্দ থেকে পার্বতীপুরের মধ্যে চলাচল করা লোকাল (৫১১)।

‘বীরকুটশা’ স্টেশনে কথা হয় বিরামপুর গ্রামের শ্রী বাবু লালের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এই স্টেশনে একটা ট্রেন থামে। সেটা যাওয়ার সময় আর আসার সময়। এছাড়া কোনও ট্রেন থামে না। যে সময় ট্রেন থামে কিছু লোক উঠে। তারপরে আবার ফাঁকা হয়ে যায়। স্টেশন মাস্টার আসেন ট্রেন ছাড়ার আগ মহূর্তে। ট্রেনই তো থামে না। লোকজন এসে কি করবে।’

বীরকুটশা স্টেশন মাস্টার মো. শাহারুল ইসলাম বলেন, এখানে শুধু খুলনা-পার্বতীপুরের মধ্যে চলাচল করা রকেট এক্সপ্রেস থামে। সেটা যাওয়া-আসা মিলে বিকেল তিনটা ও সন্ধ্যা ৬টায় থামে। অন্যসব ট্রেন না থামায় যাত্রী খুব বেশি হয় না। ৮ থেকে ১০ বছর আগে অনেকে যাত্রী হতো। যখন অন্তঃনগরসহ অন্যসব ট্রেনগুলো থামত।  

স্টেশন এলাকা বাগমারা ও নলডাঙ্গা হওয়ায় এই দুই উপজেলার জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা হলে নাটোরের নলডাঙ্গার ১ নম্বর ব্রহ্মপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এসএম আশরাফুজ্জামান বলেন, বীরকুটশা স্টেশনে মাত্র একটি ট্রেন থামে। ঢাকা বা রাজশাহীর কোন অন্তঃনগর ট্রেন থামলে এই অঞ্চলের মানুষের যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও ভালো হবে। আমাদের প্রত্যাশা আরও অনন্ত দুটি ট্রেন থামলে মানুষ অল্প খরচে এক জেলা থেকে অন্য জেলায় ভ্রমণ করতে পারবেন।

পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের পাকশীর অতিরিক্ত বাণিজ্যিক কর্মকর্তা একেএম নুরুল আলম বলেন, এখন শুধু খুলনা-পার্বতীপুরের মধ্যে চলাচল করা রকেট এক্সপ্রেস থামে। অন্য কোন ট্রেনের স্টপেজ নেই।

শাহিনুল আশিক/এমএসএ

Visit Source Page

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *