ক্রীড়াঙ্গন সংস্কার : সার্চ কমিটি নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া

ক্রীড়াঙ্গন সংস্কার : সার্চ কমিটি নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া

ক্রীড়াঙ্গনের সংস্কারের দাবি অনেক দিনের। অবশেষে সেই সংস্কারের লক্ষ্যে গঠিত যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সার্চ কমিটি নিয়ে ক্রীড়াঙ্গনের কৌতূহল ছিল ব্যাপক। গত পরশু রাতে পাঁচ সদস্যের কমিটি প্রকাশের পর ক্রীড়াঙ্গনে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। 

ক্রীড়াঙ্গনের সংস্কারের দাবি অনেক দিনের। অবশেষে সেই সংস্কারের লক্ষ্যে গঠিত যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সার্চ কমিটি নিয়ে ক্রীড়াঙ্গনের কৌতূহল ছিল ব্যাপক। গত পরশু রাতে পাঁচ সদস্যের কমিটি প্রকাশের পর ক্রীড়াঙ্গনে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। 

পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট কমিটির আহ্বায়ক জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারপ্রাপ্ত ক্রীড়াবিদ ও ব্যাডমিন্টন ফেডারেশনের সহ-সভাপতি জোবায়েদুর রহমান রানা। তার সঙ্গে সদস্য হিসেবে রয়েছেন সাবেক হকি খেলোয়াড় মেজর (অব) ইমরোজ, ক্রীড়া সংগঠক মহিউদ্দিন আহমেদ বুলবুল, প্রধান উপদেষ্টার ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি আজাদ মজুমদার এবং সিনিয়র ক্রীড়া সাংবাদিক এম এম কায়সার। পাঁচ সদস্যের কমিটি দুই মাসের মধ্যে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ আইন ২০১৮ আলোকে বিদ্যমান ফেডারেশনের গঠনতন্ত্র, নির্বাচন ব্যবস্থা, ফেডারেশনের আভ্যন্তরীণ কর্মকাণ্ড, আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের নীতিমালা সহ অন্যান্য বিষয়াদি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় সংস্কারের সুপারিশমালা সরকারকে প্রতিবেদন আকারে দেবে।

সার্চ কমিটির উপর ক্রীড়াঙ্গনের সংস্কার ও ভবিষ্যত অনেকটাই নির্ভর করছে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে ক্রীড়াঙ্গনের সঙ্গে জড়িত উইং কমান্ডার (অব) মহিউদ্দিন আহমেদ। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ, বিকেএসপির পরিচালক ও ফেডারেশনেও দীর্ঘদিন কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে তার। ক্রীড়া সংস্কারে গঠিত সার্চ কমিটি নিয়ে তার পর্যবেক্ষণ, ‘জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সাবেক সচিবদের কেউ আহ্বায়ক বা প্রধান হলে সর্বোত্তম হতো। বিশেষ করে আকতার হোসেন, সৈয়দ সুজাউদ্দিন আহমেদ (ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব) যাদের গঠনতন্ত্র, নীতিমালা সংক্রান্ত বিষয়ে যথেষ্ট দক্ষতা। এরপরও রানার (জোবায়েদুর রহমান) ওপর ভরসা রাখা যায়। এই কাজের জন্য প্রয়োজনীয় যোগ্যতা তার রয়েছে।’

জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক ইমতিয়াজ সুলতান জনি। ১৯৭৮ সালে ফুটবলার হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করা জনি এখনো ক্রীড়াঙ্গনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তারও প্রায় একই রকম পর্যবেক্ষণ, ‘ক্রীড়াঙ্গন সংস্কার বিষয়টি অত্যন্ত সংবেদনশীল ও গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের ক্রীড়াঙ্গনে অনেক সিনিয়র-অভিজ্ঞ সংগঠক, সাবেক ক্রীড়াবিদ আছেন। যারা এই কমিটিতে থাকতে পারতেন। তারা থাকলে এই কমিটি আরো সমৃদ্ধ ও পরিপক্ব হতো এবং ক্রীড়াঙ্গন সংস্কার প্রক্রিয়ার কার্যক্রম আরো যৌক্তিক হতো।’ সাফের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুল হক হেলাল, অ্যাথলেটিক্স ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বিকেএসপির পরিচালক ফারুকুল ইসলাম, বিওএ সাবেক মহাসচিব কুতুবউদ্দিন আহমেদ, গোলম কুদ্দুস চৌধুরী, টেনিস ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইসতিয়াক আহমেদ কারেন, বাফুফের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মনজুর হোসেন মালু সহ আরো অনেকেই এই কমিটির প্রধানের দায়িত্বে আসতে পারতেন বলে ধারণা ক্রীড়াঙ্গনের অনেকের।

সার্চ কমিটিতে আরেকটি আলোচিত নাম ক্রীড়া সংগঠক মহিউদ্দিন আহমেদ বুলবুল। ক্রীড়াঙ্গন সংস্কারের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মাত্র পাঁচ জনের মধ্যে তার নাম থাকায় অনেকেই বিস্মিত। তিনি এক সময় জেলা-বিভাগীয় ক্রীড়া সংগঠক পরিষদের মহাসচিব ছিলেন। বর্তমান মহাসচিব আশিকুর রহমান মিকু ফেডারেশনের নির্বাচন সংক্রান্ত বিষয়ে যেমন সমালোচিত তিনিও তেমন ছিলেন। বুলবুল নিজেও ব্যাডমিন্টন ফেডারেশনে থেকে আশাব্যঞ্জক কিছু করতে পারেননি। ছাত্র-জনতার আন্দলোনে সরকার পতনের পর রাজনীতিমুক্ত ক্রীড়াঙ্গনের প্রত্যাশা সকলের। সেই ক্রীড়া সংস্কারে সার্চ কমিটিতে বুলবুলের অন্তর্ভুক্তি যোগ্যতা, সামর্থ্যের চেয়ে দলীয় প্রভাব মনে করছেন অনেকেই। কারণ বুলবুল বিএনপিপন্থী ক্রীড়া সংগঠকদের সংগঠন ক্রীড়া উন্নয়ন পরিষদের মহাসচিব। যদিও এক পক্ষের দাবি, জেলা-বিভাগীয় পর্যায়ে অনেক সংগঠক এক যুগ উপেক্ষিত তিনি তাদেরই প্রতিনিধি হিসেবে এসেছেন।

বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সাবেক পরিচালক সিরাজউদ্দীন মোহাম্মদ আলমগীর। গঠনতন্ত্র, খেলাধুলার আইন কানুন-নীতিমালা কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকা এই সংগঠক সার্চ কমিটি সম্পর্কে বলেন, ‘প্রায় প্রতিটি ফেডারেশনের গঠনতন্ত্রে ফাঁক-ফোকর রয়েছে। এর ফলে অনেকে সুবিধা পায় আবার বঞ্চিত হয়। যার প্রভাব পড়ে খেলায় এবং সামগ্রিক ক্রীড়াঙ্গনে। আশা করব যারা কমিটিতে আছেন তারা এগুলো সঠিকভাবে পর্যালোচনা করে সঠিক নির্দেশনা দেবেন। সকল ফেডারেশন, ক্রীড়া আইন নিয়ে সম্যক ধারণা রয়েছে এমন অনেকেই এই কমিটিতে থাকতে পারতেন। কমিটি গঠনে ক্রাইটেরিয়া বা মানদণ্ড সম্পর্কে জানা নেই তবে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও অর্থবহ হওয়ায় কমিটিও সেই উচ্চতায় হওয়া প্রয়োজন ছিল।’

উপমহাদেশের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার নিয়াজ মোর্শেদের একটু ভিন্ন মত। তার দৃষ্টিতে ব্যক্তির চেয়ে কর্মই বড় , ‘এখানে সেই অর্থে তারকা বা অনেক আলোচিত লোক নেই। এ রকম ব্যক্তিত্ব আমরা বিগত সময় দেখেছি যা প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। ব্যক্তির চেয়ে কাজ গুরুত্বপূর্ণ। ব্যক্তি কাজটি সঠিক ও নিরপেক্ষভাবে করলো কি না সেটাই আসল। এই কমিটি কতটুকু গভীরে গিয়ে কাজ করতে পারে সেটা দেখার বিষয়। একেক ফেডারেশনের একেক সমস্যা, একেক রকম গঠনতন্ত্র। কমিটি কাজ শুরু করুক, ক্রীড়াঙ্গনের স্বার্থে প্রতিবেদন প্রকাশ হলে ভালো। তখনই আসলে মন্তব্য করা যাবে।’

ক্রীড়াঙ্গনে অন্যতম প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারপ্রাপ্ত ক্রীড়াবিদ ও সংগঠক কামরুন নাহার ডানা। তিনি সার্চ কমিটি সাধুবাদ জানিয়েও একটু কাঠগড়ায় দাড় করিয়েছেন, ‘ক্রীড়াঙ্গনের উন্নয়নে সংস্কারের বিকল্প নেই। উপদেষ্টা এটি করেছেন এজন্য ধন্যবাদ। পাঁচ জনের সার্চ কমিটিতে একজন নারী ক্রীড়াবিদ বা সংগঠক থাকা উচিত ছিল। ক্রীড়াঙ্গনে নারীদের অবদান অনেক। গঠনতন্ত্রে, নীতিমালায় নারীদের অধিকার নিশ্চিত করা প্রয়োজন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারেও কয়েকজন উপদেষ্টা নারী। সেখানে ক্রীড়াঙ্গনের পাঁচ জনের সার্চ কমিটিতে একজন নারী থাকতেই পারতো।’

কমিটির অন্যতম সদস্য সাবেক হকি খেলোয়াড় মেজর (অব) ইমরোজকে নিয়ে অবশ্য সবাই কমবেশি ইতিবাচক। ক্রিকেট, হকি সহ অনেক খেলাই প্রতিনিয়ত অনুসরণ করেন। গঠনতন্ত্র, নীতিমালা সংক্রান্ত বিষয়েও যুগোপযোগী ধারণা প্রদান করবেন বলে অনুমান অনেকের।

ক্রীড়া সাংবাদিকরা প্রতিনিয়ত ক্রীড়াঙ্গনের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করেন। ক্রীড়া উন্নয়নে নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে প্রকৃত চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেন। বিগত সময়ে ক্রীড়া সাংবাদিকদের মতামত ও পর্যবেক্ষণ সেভাবে মূল্যায়ন না করলেও বর্তমান ক্রীড়া মন্ত্রণালয় ক্রীড়াঙ্গন সংস্কারে সাংবাদিকদের অত্যন্ত গুরুত্ব দিচ্ছে। জেলা-বিভাগীয় অ্যাডহক কমিটিতে একজন ক্রীড়া সাংবাদিক সদস্য হিসেবে রাখার নির্দেশনা দিয়েছে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ। ক্রীড়াঙ্গন সংস্কারে সার্চ কমিটিতে বিশিষ্ট দুই জন সিনিয়র ক্রীড়া সাংবাদিক আজাদ মজুমদার ও এমএম কায়সারকে সদস্য করা হয়েছে। দুই জনই দেশের শীর্ষ পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত সাংবাদিক।

আজাদ মজুমদার বর্তমানে প্রধান উপদেষ্টার ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি। রাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায়ের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি ক্রীড়াঙ্গন সংস্কারের কমিটিতে সময় ও পূর্ণ মনোযোগ দেয়াটাই তার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। ক্রিকেট বাদে দেশের প্রায় সকল ফেডারেশন বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম এলাকায়। এই অঞ্চলে খেলা ও ফেডারেশনগুলো নিয়ে দীর্ঘদিন নিবিড়ভাবে রিপোর্টিং করাদের মধ্যে একজন থাকলে সার্চ কমিটি আরো যৌক্তিক হতো বলে মনে করেন অনেক ক্রীড়া সাংবাদিকই।

পাঁচ জন সদস্যের ওপর পুরো ক্রীড়াঙ্গন সংস্কারের ভার। জাতীয় হকি দলের সাবেক খেলোয়াড় রফিকুল ইসলাম কামালের মতে কমিটির সংখ্যা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন, ‘ফেডারেশন, এসোসিয়েশন মিলিয়ে সংখ্যা ৫০ এর বেশি। সকল ফেডারেশন নিয়ে সমান গুরুত্ব দিয়ে কাজ করলে কমিটির সদস্য সংখ্যা আরো বাড়ানো উচিত। বর্তমান কমিটির পাঁচ জন যোগ্য হলেও তাদের জন্য চাপ হয়ে যাবে।’

ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সার্চ কমিটি গঠনের অফিস আদেশে কমিটির সদস সংখ্যা হ্রাস-বৃদ্ধির বিষয়টি রয়েছে। আকার কমানো বাড়ানোর এখতিয়ারও কমিটির ওপরই দিয়েছে মন্ত্রণালয়। ক্রিকেট বোর্ডের সাবেক পরিচালক সিরাজউদ্দীন আলমগীর সার্চ কমিটির সময়সীমা আরো বাড়ানোর তাগিদ দিয়ে বলেন, ‘দুই মাস কম সময়। প্রকৃত সংস্কার ও টেকসই নির্দেশনার জন্য কমিটিকে আরো সময় দেয়া প্রয়োজন।’

কমিটি বেশি সময় নিলে তাদের সুপারিশ বাস্তবায়ন ও কার্যকর সময়সাপেক্ষ হবে। ফেডারেশনগুলোর গঠনতন্ত্র সংশোধন করতে হলে বার্ষিক সাধারণ সভা প্রয়োজন। বার্ষিক সাধারণ সভা আয়োজনে নূন্যতম এক মাসের প্রস্তুতি প্রয়োজন। 

এজেড/এইচজেএস 

Visit Source Page

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *