ক্রিকেটের সাকিব, রাজনীতির সাকিব

ক্রিকেটের সাকিব, রাজনীতির সাকিব

সাকিব আল হাসানের অবসর ঘোষণার খবর ছড়িয়ে পড়তেই সোশ্যাল মিডিয়ায় একজন লিখেছেন, এত বড় মাপের একজন ক্রিকেটার হয়েও এই বিদায়ে কেউ কাঁদছে না। অথচ এই বিদায় কতটা আবেগের হওয়ার কথা ছিল। কি দরকার ছিল…

সাকিব আল হাসানের অবসর ঘোষণার খবর ছড়িয়ে পড়তেই সোশ্যাল মিডিয়ায় একজন লিখেছেন, এত বড় মাপের একজন ক্রিকেটার হয়েও এই বিদায়ে কেউ কাঁদছে না। অথচ এই বিদায় কতটা আবেগের হওয়ার কথা ছিল। কি দরকার ছিল…

বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সফলতম এই ক্রিকেটার দীর্ঘ ক্যারিয়ারে সমালোচনা আর বিতর্কে কম জড়াননি। তবুও দিনশেষে ক্রিকেটার সাকিব ছিলেন বাংলাদেশের জান– বাংলাদেশের প্রাণ। ক্যামেরায় অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি, গ্যালারিতে দর্শক পেটানো, স্ট্যাম্পে লাথিকাণ্ড, শেয়ার মার্কেট কেলেঙ্কারি, জুয়াড়ির তথ্য গোপন করে আইসিসির নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হওয়া—এত সব বিতর্কের পরও সমর্থকদের পাশে পেয়েছিলেন সাকিব। কিন্তু এবার যেন সব ছাপিয়ে গেল! বিশ্বের বাঘা বাঘা সব ক্রিকেটারের চোখে চোখ রেখে লড়াই করা ‘বেয়াদব’ সাকিবকে নিয়ে সেই আবেগটা যেন উবে গেছে কোথায়!

বাইশগজের দীর্ঘ রাজত্বে ক্রিকেট বিশ্বে লাল-সবুজের দেশকে চিনিয়েছেন সাকিব। তার আকস্মিক অবসর ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় বিকেএসপিতে একসময়ের রুমমেট সাবেক জাতীয় হকি খেলোয়াড় ইমরান হাসান পিন্টু বলেই ফেললেন কথাটা, ‘নক্ষত্র (ধুমকেতু) দেখতে যেমন ৭৫ বছর অপেক্ষা করতে হয়। সাকিব বাংলাদেশের ক্রিকেটের সেই নক্ষত্র। এই রকম নক্ষত্র দেখতে কত বছর অপেক্ষা করতে হয় সেটাই দেখার বিষয়।’

সেই সাকিবের রাজনীতির ময়দানে দ্বিতীয় অধ্যায়টা সুখকর হয়নি। বরং রাজনীতিতে নাম লেখানোই যেন কাল হয়ে দাঁড়াল। সর্বশেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। তবে মাত্র ৭ মাসের মাথায় গণ আন্দোলনের মুখে পতন হয় সেই সরকারের। সাকিবকেও খোয়াতে হয় সংসদ সদস্যের পদ। ছাত্রদের আন্দোলনে নীরব থাকায় তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েন জাতীয় দলের সাবেক এই অধিনায়ক। পরিস্থিতি এতটাই বেগতিক, নিজ দেশে ঢুকতেও নিরাপত্তার কথা ভাবতে হচ্ছে তাকে। অথচ একবার কল্পনা করুন, মিরপুরে ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট খেলতে নেমেছেন সাকিব, গ্যালারিতে দর্শক-সমর্থকের ঢল…কানে বাজছে শুধু ‘সাকিব’ ‘সাকিব’…. 

কোটা সংস্কার আন্দোলনে দেশ যখন উত্তাল, একের পর এক তাজা প্রাণ ঝড়েছিল রাস্তায়। বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের পাশাপাশি ক্রীড়াঙ্গনের অনেকে ছাত্রদের আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানালেও নীরব ভূমিকায় ছিলেন সাকিব। এ ছাড়া বিদেশে সে সময় তিনি পরিবার নিয়ে বেশ ভালো সময় কাটান। কানাডার ফ্র্যাঞ্জাইজি লিগের ব্যস্ততার পাশাপাশি পরিবার নিয়ে ঘুরে বেড়াতেও দেখা গেছে তাকে। শুধু তাই নয়, প্রবাসী দর্শকরা আন্দোলনে তার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুললে তিনি পাল্টা বলেছিলেন ‘দেশের জন্য আপনি কী করেছেন?’

সাকিবের এমন ভূমিকা ভালোভাবে নেয়নি ক্রিকেটপ্রেমীরা। সাকিবের অন্ধভক্ত অনেকেরই এখন যেন ‘দুই চোখের বিষ’ এই ক্রিকেটার। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিনিয়ত আক্রমণের শিকার হচ্ছেন। সাকিবের মতো আরেক সাবেক ক্রিকেটার মাশরাফি বিন মোর্ত্তজাও রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলেন। মামলা হয়েছে তার নামেও। কিন্তু নিজের দায় আর আন্দোলনে নীরবতা নিয়ে সমর্থকদের কাছে ব্যাখ্যা দেন। তেমন কিছুরও প্রয়োজন মনে করেননি সাকিব। সব ভুলে ক্রিকেটে ফিরেছিলেন। পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজের পর ক্রিকেটাররা দেশে ফিরলেও ইংল্যান্ডের কাউন্টিতে খেলতে যান সাকিব। সেখান থেকে এখন দলের সঙ্গে আছেন ভারতে। কারও কারও ধারণা ছিল, ভালো পারফরম্যান্সে কিছুটা হলেও মন জিততে পারবেন সাকিব, কিন্তু ফর্মটাও যেন পক্ষে কথা বলছে না তার। 

একবার সাকিব বলেছিলেন, যেদিন মনে হবে তিনি ড্রাইভিং সিটে নেই সেদিনই তিনি খেলা ছেড়ে দেবেন। প্যাসেঞ্জার হয়ে থাকবেন না। তবে চলতি বছরের পুরোটা সময়ই প্যাসেঞ্জার হয়েই ছিলেন সাকিব। ওয়ানডে খেলেননি, টেস্ট আর টি-টোয়েন্টি মিলিয়ে ব্যাটে-বলে একেবারেই বিবর্ণ। সাকিবের টি-টোয়েন্টি আর টেস্ট থেকে অবসরের ঘোষণাটা তাই অনেককেই অবাক করেনি। বরং বাংলাদেশের কোন ক্রিকেটার মাঠ থেকে বিদায় নিচ্ছেন এটা স্বস্তির ছিল।

ক্যারিয়ার শেষের ইঙ্গিতটা দিয়ে রেখেছিলেন অনেকদিন আগেই। গেল বছরের নভেম্বরে ভারতের মাঠে ওয়ানডে বিশ্বকাপ খেলতে যাওয়ার আগেই সাকিব বলেছিলেন, খুব শিগগিরই ক্যারিয়ার শেষ করতে চান। তবে আজকের ঘোষণাটা অনেকটা আকস্মিকই ছিল। একদিন পরই (আগামীকাল-শুক্রবার) কানপুরে শুরু হবে ভারতের বিপক্ষে সিরিজের দ্বিতীয় টেস্ট। ম্যাচের আগের দিন আজ সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হয়ে আসলেন সাকিব। গত কয়েক বছরে খুব একটা মিডিয়ার মুখোমুখি হননি সাকিব। যখনই হয়েছেন, কিছু একটা উদ্দেশ্য ছিল। আজকের সংবাদ সম্মেলনটাও আসন্ন টেস্ট ছাপিয়ে হয়ে উঠল সাকিবময়। 

অবসরের কথা জানিয়ে সাকিব প্রেস কনফারেন্সে বলেন ‘আমার মনে হয় টি-টোয়েন্টি তে আমি আমার শেষ ম্যাচ খেলে ফেলেছি, মিরপুর টেস্টে (দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে) খেলতে পারলে সেটি হবে আমার শেষ টেস্ট’। এই ‘খেলতে পারা’ নিয়ে পরে ব্যাখ্যাও দিয়েছেন সাকিব, ‘আমি যেন গিয়ে খেলতে পারি এবং নিরাপদ অনুভব করি। যখন দেশের বাইরে আসার দরকার হবে, দেশের বাইরে আসতেও যেন আমার কোনো সমস্যা না হয়। বোর্ড খেয়াল রাখছে, বিষয়গুলোর সঙ্গে যারা জড়িত তারা দেখছেন। তারা হয়তো আমাকে একটা সিদ্ধান্ত দেবেন, যেটার ভিত্তিতে আমি দেশে গিয়ে খুব ভালোভাবে খেলে অন্তত টেস্ট ফরম্যাটটা ছাড়তে পারব।’

দেশের মাটিতে টেস্ট ক্রিকেটকে বিদায় জানানোর সুযোগ না হলে কানপুর টেস্টই হবে শেষ টেস্ট এমন কথাও বলেছেন সাকিব। বলেন, ‘আমার কাছে দেশের সমর্থকদের সামনে টেস্ট ক্যারিয়ার শেষ করাটা উপযুক্ত হবে বলে মনে হচ্ছে। বাংলাদেশ ক্রিকেট আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে এবং এই ফরম্যাটের শেষটা আমি ঘরের মাঠেই করতে চাই। আমি বিসিবির কাছে নিজের শেষ টেস্টটি মিরপুরে খেলার ইচ্ছা প্রকাশ করেছি। যদি তা না হয়, তাহলে কানপুরে ভারতের বিপক্ষে ম্যাচটিই আমার শেষ টেস্ট হবে।’

সাকিবের দাবি, বিসিবি প্রধান ও নির্বাচকদের সঙ্গে আলোচনা করেই সব করেছেন। তাদের কাছ থেকেই নিরাপত্তার আশ্বাস চেয়েছেন। অন্যদিকে, ঘরের মাঠে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে আসন্ন টেস্ট সিরিজে সাকিবকে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দিতে তৎপর বিসিবিও। এরই মধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তরফেও সবুজ সংকেত পাওয়ার কথা জানিয়েছে বিসিবি। তবে শেষ পর্যন্ত সাকিবকে বিসিবি নিরাপত্তা দিতে পারে কি না সেটা সময়ই বলে দেবে। ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর পাকিস্তানের সঙ্গে খেলা চলাকালেই একটি হত্যা মামলায় আসামী করা হয়েছিল সাকিবকে। সর্বশেষ চলমান ভারত সিরিজের মধ্যেই পেলেন শেয়ার বাজারে কেলেঙ্কারির দায়ে বড়সড় জরিমানার খবর। টাকার অঙ্কে যা ৫০ লাখ। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী দিনে এমন মামলার সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। এসব কারণে দেশে ফিরলে গ্রেপ্তার কিংবা হয়রানির শিকার হবেন না সে নিশ্চয়তা আসলে কতটা দিতে পারবে বিসিবি?

সাকিব অবসরকেও অনেকে কৌশল মনে করছেন। সাকিব অবসর নিয়েছেন দুই ফরম্যাটের ক্রিকেট থেকে। টেস্ট আর টি-টোয়েন্টি। তবে টেস্ট নিয়ে চিরতরে দুয়ার বন্ধ করে দিলেও টি-টোয়েন্টি নিয়ে একটা পথ খোলা রাখলেন ঠিকই। কখনো বিসিবি মনে করলে আবারও ফিরতে পারেন জানিয়ে সাকিব বলেন,  ‘আমি যদি ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে খেলার সুযোগ পাই, ওখানে ভালো করতে থাকি; ৬ মাস এক বছর পর যদি কখনো মনে করে বিসিবি যে, না টি-টোয়েন্টিতে আমার অবদান রাখার একটা সুযোগ আছে, আমি পারফর্ম করছি এবং ফিট আছি। তখন আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি।’ তাহলে টেস্ট কি দোষ করল? ওহ আচ্ছা, সাকিবতো বেশ আগে থেকেই বেছে বেছে নিজের পছন্দমাফিক টেস্ট খেলেন। আর ওয়ানডের দৌড় রাখলেন আগামী বছর চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি পর্যন্ত। এমন কিছুর আভাস অবশ্য আগেই দিয়ে রেখেছিলেন।

ক্রিকেট ক্যারিয়ারে অনেক রেকর্ড আছে সাকিবের। বিশ্বের একমাত্র ক্রিকেটার হিসেবে হয়তো একই সঙ্গে রাজনীতি, ব্যবসা, খেলা, পরিবার—সামলানোর রেকর্ডটাও নিজের করে নিয়েছিলেন এই অলরাউন্ডার। খেলার আগে ফটোসেশনে প্রতিপক্ষের অধিনায়ককে বসিয়ে রেখে বিজ্ঞাপনের শুটিংয়ে যাওয়ার ঘটনাতো অহরহ ছিল। মানুষের সমালোচনা প্রসঙ্গে একবার বলেছিলেন, তাকে নিয়ে সমালোচনা দেখলে নাকি ‘হাসি পায়’। 

আওয়ামী লীগের হয়ে মনোনয়ন পাবার পর সাকিবের বেশ পুরনো একটা পোস্ট বেশ ভাইরাল হয়েছিল। যেখানে তিনি লিখেছিলেন, ‘জীবনেও রাজনীতি করব না।’ পোস্টটির প্রেক্ষাপট আর উদ্দেশ্যেই যেটাই হোক, এখন হয়তো সত্যি সত্যিই তেমন কিছু ভাবতে পারেন তিনি।

এফআই

Visit Source Page

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *