রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার ঘনিরামপুর বড়গোলা উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষক-কর্মচারী আছেন মোট ২১ জন। তাদের মধ্যে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আলিয়ার রহমানের পরিবারের সদস্যই রয়েছেন ৭ জন।
রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার ঘনিরামপুর বড়গোলা উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষক-কর্মচারী আছেন মোট ২১ জন। তাদের মধ্যে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আলিয়ার রহমানের পরিবারের সদস্যই রয়েছেন ৭ জন।
অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, আধিপত্য বিস্তারের জন্য গোপনে প্রধান শিক্ষক আলিয়ার রহমান নিয়মনীতি না মেনে তার স্ত্রী, ভাই, ভাতিজা এবং ভাতিজার বউকে চাকরি পাইয়ে দিয়েছেন। এরপর যৌথভাবে অনিয়ম-দুর্নীতি করছেন। রংপুর শহরে বিলাসবহুল বাড়ি, গ্রামে কোটি টাকার জমি কিনেছেন আলিয়ার রহমান।
এদিকে শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর প্রধান শিক্ষকের এসব অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে সোচ্চার হন অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা। এ নিয়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা বিভিন্ন দপ্তরে প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেন। এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে রোববার (২২ সেপ্টেম্বর) প্রধান শিক্ষককে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
বিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৫ সালে উপজেলার কুর্শা ইউনিয়নের বড়গোলা এলাকায় ঘনিরামপুর বড়গোলা উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৯৬ সালে ওই বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান আলিয়ার রহমান। এরপর তার বড় ভাই মফিজাল রহমানকে কৌশলে ওই বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি করেন।
স্থানীয় ও অভিভাবকদের অভিযোগ, প্রধান শিক্ষক আলিয়ার রহমান ও সভাপতি মফিজাল মিলে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে গোপনে ভাই, ভাতিজা, ভাতিজার বউকে নিয়োগ পাইয়ে দেন। ২০০০ সালে প্রধান শিক্ষকের স্ত্রী আলেয়া বেগম বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান। ২০০৪ সালে ভাতিজা আজম আলী, ২০১৬ সালে ভাতিজার স্ত্রী মোরশেদা বেগমকে সহকারী শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এরপর ২০২২ সালে আরেক ভাতিজা আজমির সরকারকে পিয়ন ও ভাতিজার স্ত্রীকে মালি পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০২৩ সালে আরেক ভাতিজাকে ঝাড়ুদার পদে নিয়োগ দেন প্রধান শিক্ষক।
বিদ্যালয়ের দাতা সদস্য গোলাম রসূল ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময় ১১ শতক জমি দিয়েছি। প্রতিষ্ঠার সময় আমরা যারা কমিটিতে ছিলাম, তাদের কাউকেই বর্তমান কমিটিতে রাখেননি প্রধান শিক্ষক আলিয়ার। কমিটিতে তার বড় ভাই মফিজালকে সভাপতি করা হয়। এরপর গোপনে বাইরের আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে বিভিন্ন সময় প্রধান শিক্ষক তার ৭ স্বজনকে বিভিন্ন পদে নিয়োগ দেন। স্কুলে এখন লেখাপড়ার থেকে অনিয়ম, দুর্নীতি বেশি চলছে।
ঘনিরামপুর এলাকার বাসিন্দা লেবু মিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, স্কুলটি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যাদের ভূমিকা রয়েছে, তাদের বেশিরভাগকে কমিটিতে রাখেনি। কৌশলে প্রতিষ্ঠানটিকে পারিবারিক বিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তুলেছেন প্রধান শিক্ষক আলিয়ার। এ কারণে এখানে কর্মরত শিক্ষক-কর্মচারীরা তার অন্যায়, অনিয়মের বিরুদ্ধে কথা বলতে সাহস পান না। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর শিক্ষক, অভিভাবক, সাবেক-বর্তমান শিক্ষার্থীসহ এলাকাবাসী আলিয়ারের পদত্যাগের দাবি জানিয়েছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই বিদ্যালয়ের এক সহকারী শিক্ষক ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রধান শিক্ষকের স্ত্রী হওয়ার সুবাদে সহকারী প্রধান শিক্ষক সপ্তাহে এক-দুই দিন বিদ্যালয়ে আসেন। কিছু বললে শিক্ষকদের লাঞ্ছিত করেন। নানা অজুহাতে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টাকা আদায় করেন। প্রতিবাদ করলে লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়। প্রধান শিক্ষক কথায় কথায় চাকরি ছেড়ে চলে যাওয়ার হুমকি দেন।
আরেক শিক্ষক অভিযোগ করে বলেন, আমরা কখনোই জানতে পারিনি কখন, কবে, কোথায় বিজ্ঞাপন হয়েছে, পরীক্ষা হয়েছে। যোগদানের পর জানতে পারি, কেউ একজন আমাদের বিদ্যালয়ে চাকরি পেয়েছে।
একাধিক শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের পরিবারের শিক্ষক-কর্মচারীর ব্যাপারে কেউ কথা বলতে পারেন না। অন্য শিক্ষকেরাও ভয়ে থাকেন। এই সুযোগে প্রধান শিক্ষক দীর্ঘদিন ধরে আর্থিক দুর্নীতিসহ নানা অনিয়ম করেন। কেউ কিছু বললে হুমকি দেন।
শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বিদ্যুৎ বিল বাবদ প্রতি মাসে ৫০ টাকা, বই বিতরণে রসিদ ছাড়াই ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা, প্রতিটি পরীক্ষার ফি বাবদ ৬০০-৮০০, এসএসসি পরীক্ষার নিবন্ধনের নামে ৮০০ টাকা, ফরম পূরণের সময় বোর্ড ফির চার গুণ অতিরিক্ত টাকা, নম্বরপত্র উত্তোলনে ৩০০ টাকা, প্রশংসাপত্রের জন্য ৪০০ এবং সনদ উত্তোলন বাবদ ৪০০ টাকা বাধ্যতামূলক আদায় করেন প্রধান শিক্ষক।
এগুলোর কোনো রসিদ দেন না। এভাবে শিক্ষার্থীর কাছ থেকে গত কয়েক বছরে টাকা আদায় করে অঢেল সম্পদ অর্জন করেছেন। রংপুর শহরে গড়ে তুলেছেন বিলাসবহুল বাড়ি।
অভিভাবক নাজির উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রধান শিক্ষক তার ইচ্ছামতো বিদ্যালয় পরিচালনা করেন। সব বিদ্যালয় থেকে এখানে লেখাপড়ার খরচ অনেক বেশি। তাদের দাপটে কেউ কথা বলতে সাহস পান না। বিদ্যালয়ের অর্থ প্রধান শিক্ষকের পুরো পরিবার লুটপাট করে খেয়েছেন।
ওই বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী ঢাকা পোস্টকে বলে, স্কুলে কোনো কাগজ স্বাক্ষর করতে গেলেও টাকা লাগে। কিছু বললে হেড স্যার টিসি দেওয়ার হুমকি দেন। উনার স্ত্রী, ভাতিজারাও ভয় দেখান।
এর আগে অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধান শিক্ষক আলিয়ার রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, নিজের জমি-জায়গা দিয়ে অনেক কষ্টে এই বিদ্যালয় আমি- আমার ভাই প্রতিষ্ঠা করেছি। নিয়ম অনুযায়ী আমার ভাই মফিজাল রহমান সভাপতি হয়েছেন। বিধি মোতাবেক প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। একটি মহল প্রতিষ্ঠানের সুনাম নষ্টের চেষ্টা করছে।
তারাগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রুবেল রানা ঢাকা পোস্টকে বলেন, নিয়োগ-বাণিজ্যসহ অন্যান্য অভিযোগ পাওয়ার পর প্রধান শিক্ষককে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। তিনি জবাব দিয়েছেন। আজ দুপুরে আমরা এটা নিয়ে বসেছিলাম। বিধি অনুযায়ী উনাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এছাড়া তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন দিলে সে অনুযায়ী পরবর্তীতে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
আরকে