উপাচার্য ভাবনা : বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়

উপাচার্য ভাবনা : বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়

লেখক : উপাচার্য, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর

২০০৮ সালে ‘রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়’ নামে যে প্রতিষ্ঠানটি যাত্রা শুরু করেছিল, সেটি আজ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় (বেরোবি) নামে উত্তর জনপদের মানুষের স্বপ্নের একটি প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়টির জন্য এ অঞ্চলের মানুষ দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রাম করেছেন। ‘রংপুরে বিশ্ববিদ্যালয় চাই’-এ স্লোগান সামনে রেখে সে সময় অধ্যাপক ড. রেজাউল হকের নেতৃত্বে রংপুর বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়ন সমন্বয় পরিষদ গঠিত হয়েছিল। এ আন্দোলনের সফলতার মধ্য দিয়ে রংপুরের গর্বিত সন্তান অধ্যাপক ড. মো. লুৎফর রহমানকে প্রথম ভিসি করে রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়।

এ বিশ্ববিদ্যালয়, ২০২৪ সাল পর্যন্ত, পাঁচজন ভিসির নেতৃত্ব পেয়েছে। এরপর, ষষ্ঠ ভিসি হিসেবে গত ১৮ সেপ্টেম্বর দায়িত্বভার গ্রহণ করেছি। দায়িত্ব নেয়ার সময় বিশ্ববিদ্যালয়টি এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছিল। জুলাই বিপ্লবের পর প্রায় দুই মাস ভিসিশূন্য থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছিল। তবে আমি যোগদানের পরপর জরুরি সিন্ডিকেট সভা ডেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম পুনরায় স্বাভাবিক করার উদ্যোগ নেই। ২৫ সেপ্টেম্বর হল খুলে দেই। ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে ক্লাস ও পরীক্ষা শুরু করি।

সেই সাথে, জুলাই বিপ্লবে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে যথাযথ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষ্যে সিন্ডিকেটের নির্দেশে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করি। যতদূর সম্ভব, সাধারণ শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদের কাতারে নিজেকে শামিল করার আন্তরিক চেষ্টা করেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক পরিবেশ এবং কর্মকাণ্ড সুষ্ঠু ও গতিশীল রাখতে তাদের সাথে নিবিড়ভাবে কাজ করে যাচ্ছি। এ বিশ্ববিদ্যালয় কেবল একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, এটি একটি পরিবারের মতো, যেখানে প্রতিটি সদস্যের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এর অগ্রগতি নির্ভর করে। আমরা বিশ্বাস করি, প্রশাসনের দায়িত্ব কেবল নির্দেশনা দেয়া নয়; বরং সবার পাশে থেকে তাদের প্রয়োজনের মুহূর্তে সহযোগিতা করা এবং তাদের কণ্ঠ শোনা। এ লক্ষ্যে, আমি নিয়মিতভাবে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের সাথে মতবিনিময় করেছি, তাদের উদ্বেগ ও সমস্যা শুনেছি এবং সমাধানের জন্য যথাসাধ্য ব্যবস্থা নিয়েছি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এর প্রধান অংশীজন, তাই আমি সর্বদা তাদের কল্যাণকে অগ্রাধিকার দেওয়ার চেষ্টা করেছি। শিক্ষার্থীদের সমস্যাগুলো সরাসরি তাদের কাছে থেকে শোনা এবং তাদের চাহিদা ও প্রত্যাশা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা নিতে যথাসাধ্য সময় ব্যয় করেছি। অডিটোরিয়াম না থাকায়, অনুষদভিত্তিক শিক্ষার্থীদের সাথে মতবিনিময় সভার আয়োজন করেছি, যেখানে তারা তাদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া ও সমস্যার কথা তুলে ধরেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য একটি অডিটোরিয়ামের গুরুত্ব উপলব্ধি করে, এ প্রতিষ্ঠানে একটি আধুনিক অডিটোরিয়াম নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ইতোমধ্যে প্রাথমিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি।

শিক্ষার্থীদের আবাসন সমস্যা সমাধানে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো সশরীরে পরিদর্শন করেছি। প্রায় আট হাজার শিক্ষার্থীর জন্য মাত্র ৮০০টি আবাসিক আসন থাকা এক বিশাল ঘাটতি, যা বিশ্ববিদ্যালয়টির সামগ্রিক উন্নয়নের পথে বড় প্রতিবন্ধক। বিশ্ববিদ্যালয়টিকে একটি পূর্ণাঙ্গ আবাসিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে হলে আবাসিক আসনের সংখ্যা কমপক্ষে ১০ গুণ বাড়ানো প্রয়োজন। আমি আমার দায়িত্বকালে দু’টি ছাত্র হল এবং দু’টি ছাত্রী হল নির্মাণের লক্ষ্য স্থির করেছি, যা শিক্ষার্থীদের আবাসন সমস্যা কিছুটা হলেও লাঘব করবে।

এ ছাড়াও, বিভিন্ন বিভাগে বিভাগীয় প্রধান নিয়োগ নিয়ে যে জটিলতা ছিল, আমি তা আলোচনা ও সমন্বয়ের মাধ্যমে সমাধান করতে সক্ষম হয়েছি। সব শিক্ষকের সাথে নিয়মিত মতবিনিময় করে তাদের যৌক্তিক সমস্যাগুলোর সমাধান করার চেষ্টা করেছি। তাদের প্রত্যাশা পূরণে নিরলস কাজ করে যাচ্ছি। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, অধিকাংশ সমস্যার সমাধান আলোচনা ও সংলাপের মাধ্যমে সম্ভব। সেই লক্ষ্যে, দল-মত নির্বিশেষে সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর সাথে মতবিনিময় করেছি। সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছি। কখনো কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর ভিসি হওয়ার চেষ্টা করিনি; বরং নিজেকে সাধারণ শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদের একজন অভিভাবক হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করছি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সবার সহযোগিতা ও সমন্বয়ের মাধ্যমে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়টি সহজে সামনে এগিয়ে নিতে পারব। একইসাথে এটি উত্তরবঙ্গের শিক্ষার এক উজ্জ্বল বাতিঘর হিসেবে গড়ে উঠবে।

আজকের দিনে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি জুলাই বিপ্লবের অগ্রদূত, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শহীদ আবু সাঈদসহ শত শত বীর শহীদকে, যাদের আত্মত্যাগ আমাদের অনুপ্রেরণা। তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। শ্রদ্ধার সাথে আরো স্মরণ করি সেই পঙ্গুত্ব বরণকারী ও আহত ছাত্র-জনতাকে, যাদের আত্মত্যাগে বাংলাদেশ নতুন পথে এগিয়ে চলছে। শহীদ আবু সাঈদের স্মৃতিবিজড়িত বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় আজ তার নামে একটি গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষভাবে ১৬ জুলাইয়ের পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়টি আবু সাঈদের আত্মত্যাগের মাধ্যমে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে। গত ৯ অক্টোবর তার ছোট বোনকে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছি। তবে এ-ও স্পষ্ট যে, আবু সাঈদের আত্মত্যাগের ঋণ কোনোদিন আমরা শোধ করতে পারব না। আবু সাঈদের স্মৃতিবিজড়িত বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় দীর্ঘ দিন থেকে বাজেট বঞ্চনার শিকার। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ যাবৎকালে বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রকল্প বরাদ্দ পেয়েছে ২০০ কোটি ৫০ লাখ টাকা, অথচ বাংলাদেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে যেগুলো বেরোবির সমসাময়িক সেগুলো এক অর্থবছরে বরাদ্দ পায় এক হাজার কোটি টাকার বেশি। এ বাজেট বৈষম্য বেরোবিকে একটি উৎকর্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ার ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায়।

আমি শুরু থেকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পূর্ণ সহযোগিতা পেয়ে আসছি । বিশেষ করে, আবু সাঈদের স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে এখানে যে উন্নয়ন বৈষম্য রয়ে গেছে, তা দূরীকরণে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আন্তরিক আহ্বান জানাচ্ছি। জেনারেশন জেডের প্রতিনিধি এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে আবু সাঈদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রত্যয় নিয়ে এখানে উপস্থিত হয়েছি। এ জন্য রংপুরের সাধারণ মানুষ, শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্মিলিত সহযোগিতা কামনা করছি, যাতে আমরা একযোগে এ প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের পথ সুগম করতে পারি।

লেখক : উপাচার্য, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর

Visit Source Page

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *