ইশারা ভাষায় অভিজ্ঞ কর্মকর্তা দিয়ে হাজী সেলিমকে জিজ্ঞাসাবাদ

ইশারা ভাষায় অভিজ্ঞ কর্মকর্তা দিয়ে হাজী সেলিমকে জিজ্ঞাসাবাদ

আইডিয়াল কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র খালিদ হাসান সাইফুল্লাহ হত্যা মামলায় ঢাকা-৭ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতা হাজী মোহাম্মদ সেলিমকে ৫ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। তবে দীর্ঘ ৮ বছর ধরে বাকশক্তি হারানোয় কথা বলতে পারেন না তিনি। রিমান্ডে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডিবির বিশেষ অফিসারদের ডাকা হয়েছে, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে বিরল। এসব অফিসাররা সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ বা ইশারা ভাষা বুঝতে পারদর্শী। তারা হাজী সেলিমকে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন।

আইডিয়াল কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র খালিদ হাসান সাইফুল্লাহ হত্যা মামলায় ঢাকা-৭ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতা হাজী মোহাম্মদ সেলিমকে ৫ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। তবে দীর্ঘ ৮ বছর ধরে বাকশক্তি হারানোয় কথা বলতে পারেন না তিনি। রিমান্ডে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডিবির বিশেষ অফিসারদের ডাকা হয়েছে, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে বিরল। এসব অফিসাররা সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ বা ইশারা ভাষা বুঝতে পারদর্শী। তারা হাজী সেলিমকে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন।

হত্যা মামলার আসামি হাজী সেলিমের বিরুদ্ধে লালবাগের ঢাকা বধির হাইস্কুলের জমি দখলসহ বেশ কয়েকটি গুরুতর অভিযোগ রয়েছে।

রিমান্ডের বিষয়ে ডিবির দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, রোববার (১ সেপ্টেম্বর) রাতে গ্রেপ্তারের পর হাজী সেলিমকে রাতে আর জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি। ডিবির হাজতখানায় রাত কাটান তিনি। সোমবার আদালতে পাঠানোর আগে তার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তিনি কোনো কথা বলেননি। তিনি বারবার ইশারা দিয়ে জানান যে, তিনি কথা বলতে পারেন না। তার সামনে একটি সাদা কাগজ ও বলপেন দেওয়া হয়েছিল। তিনি বেশ কয়েকবার কলম ধরেছেন, আবার রেখে দিয়েছেন। তিনি কিছু লিখেননি। কলম ধরে ছটফট করে বুঝাতে চেয়েছেন তিনি লিখতে পারেন না। তার হাত কাঁপে। এরপর আর তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি।

সোমবার রিমান্ড শুনানির পর তাকে আবার ডিবি অফিসে নেওয়া হয়। সেসময় হাজী সেলিমকে জিজ্ঞাসাবাদের কোনো উদ্দেশ্য ছিল না ডিবির। তবে ডিবির অফিসারদের সামনে বারবার আঙুল নেড়ে ইশারায় কিছু একটা বলছিলেন। ডিবির অভিজ্ঞ অফিসাররা জানান, হাজী সেলিম বুঝাতে চেয়েছেন তিনি কাউকে হত্যা করেননি। তার কোনো দোষ নেই। তিনি শিক্ষার্থীকে হত্যার বিষয়ে কিছুই জানেন না।

ডিবির দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, মঙ্গলবার (৩ সেপ্টেম্বর) রিমান্ডের প্রথমদিন ডিবির তদন্ত কর্মকর্তাসহ অন্যান্য অফিসারদের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন ডিবির একজন বিশেষ অফিসার। তিনি সাংকেতিক ভাষা বা সাইন ল্যাঙ্গুয়েজে পারদর্শী। তবে তাদের নিয়েও জিজ্ঞাসাবাদের কোনো কূলকিনারা করতে পারেননি অফিসাররা। কারণ বারবার ইশারায় হাজী সেলিম একই কথা বোঝাতে চেয়েছেন যে, তিনি অসুস্থ, কিছুই জানেন না।

ডিবির যুগ্ম কমিশনার (উত্তর) মো. রবিউল হোসেন ভূঁইয়া ঢাকা পোস্টকে জানান, মামলার তদন্ত চলছে। তদন্তে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হাজী সেলিমকে রিমান্ডে আনা হয়েছে। তিনি কথা বলতে বা লিখতে পারেন না। তার জন্য সাইন ল্যাংগুয়েজে পারদর্শী ডিবি অফিসার আনা হয়েছে।

ডিবির একজন অফিসার ঢাকা পোস্টকে বলেন, গ্রেপ্তারের পর থেকেই হাজী সেলিমের কারণে ডিবি অফিসারদের নানা বেগ পেতে হচ্ছে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বিশেষজ্ঞ অফিসার আনা হলেও অন্য সময়গুলোতে হাজী সেলিমকে সামলানো কঠিন হয়ে পড়ছে। শারীরিক নানা অসুস্থতার কারণে তিনি ৩ বেলায় মোট ১৬টি ট্যাবলেট নেন।

জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়ে দায়িত্বশীল সূত্র ঢাকা পোস্টকে জানায়, জিজ্ঞাসাবাদে হাজী সেলিম হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার বিষয়ে কিছুই জানেন না বলে দাবি করেন। তিনি আরও বলেছেন, কয়েক বছর আগে তিনি তার স্ত্রীকে হারিয়েছেন। ৩ ছেলে, দুই পুত্রবধূ ও নাতি নাতনিদের নিয়ে দিন কাটে তার। এর বাইরে আর তিনি কিছু জানেন না। তিনি এমনিতেও এখন সক্রিয় রাজনীতিতে নেই। যখন আন্দোলন চলছিল, তখন তিনি আন্দোলন সম্পর্কে সরাসরি তেমন কিছু জানতেন না। তার বড় ছেলে সোলাইমান সেলিম ঢাকা-৭ আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন এবং মেজো ছেলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। তাদের কাছ থেকে আন্দোলনের বিষয়ে জানতেন হাজী সেলিম। তার বড় পুত্রবধূর জন্ম উজবেকিস্তানে। ইংরেজিতে পারদর্শী হওয়ায় আন্তর্জাতিক সংবাদগুলো তিনিই হাজী সেলিমকে পড়ে শোনাতেন। খাওয়া-দাওয়া ও ঘুম ছাড়া সারাদিন আর কিছু করতেন না বলে জানান তিনি।

ডিবির দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, এই হত্যার ঘটনা ছাড়াও হাজী সেলিমের বিরুদ্ধে পুরান ঢাকায় চাঁদাবাজি, বাদামতলি ফলের আড়তে প্রভাব বিস্তার ও চাঁদাবাজি, বাড়ি দখল, বাজারমূল্য থেকে অনেক কমে জোরপূর্বক বাড়ি কিনে নেওয়া, মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে ছেলেকে এমপি বানানো, নদী দখল সংশ্লিষ্ট নানা অভিযোগ রয়েছে। সেগুলো নিয়েও তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

সূত্র জানায়, হাজী সেলিমের বিরুদ্ধে সাবেক এক ফুটবলারের হাতের কবজি কাটার অভিযোগ আছে। সেই ভিক্টিম ফুটবলারকেও আমরা খুঁজছি। এসব বিষয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।

হাজী সেলিমের ব্যক্তিগত আইনজীবী শ্রী প্রাণ নাথ ঢাকা পোস্টকে বলেন, উনি ওপেন হার্ট সার্জারি করেছেন, উচ্চ ডায়াবেটিসের রোগী। কথা বলতে পারেন না। তাকে কীভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে এ বিষয়ে কোনো তথ্য পাইনি। আমাদের কোনো কথাই বলতে দেওয়া হচ্ছে না।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গত ১৮ জুলাই লালবাগের আজিমপুর সরকারি আবাসিক এলাকায় আইডিয়াল কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র খালিদ হাসান সাইফুল্লাহ গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। এ ঘটনায় তার বাবা কামরুল হাসান ১৯ আগস্ট লালবাগ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় রোববার (১ সেপ্টেম্বর) রাতে গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল পুরান ঢাকার বংশাল এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারের পর তাকে ৫ দিনের রিমান্ডে নেয় ডিবি।

জানা গেছে, রিমান্ড শুনানি চলাকালে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে অঝোরে কাঁদেন সেলিম। তার দুই হাতে হ্যান্ডকাফ, পরনে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট ও মাথায় হেলমেট ছিল। কাঠগড়ায় হেলমেট খুলে শুনানি চলাকালীন পুরো সময় তিনি কাঁদতে থাকেন।

পুরান ঢাকার ‘তালা হাজী’

বিএনপির কর্মী হিসেবে রাজনীতি শুরু করা হাজী সেলিম পুরান ঢাকায় ‘তালা হাজী’ নামে বেশি পরিচিত। স্থানীয়রা জানান, কয়েকবছর বিএনপির রাজনীতির পর তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন। ১৯৯৬ সালে এমপি হওয়ার পর এলাকায় সালিশ-বিচারের নামে ভুক্তভোগী পরিবারের ঘরে তালা লাগিয়ে দিতেন। কারও জমিজমার সমস্যা সমাধান করতে গেলে সমাধানের পর নিজেই ভুক্তভোগীর কাছ থেকে জোর করে জমি কিনে নিতেন।

পুরান ঢাকার মৌলভীবাজারের অগ্রণী ব্যাংকের একটি জায়গা দখল করে স্ত্রী গুলশান আরার নামে জাল দলিল করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এই ঘটনায় ব্যাংকের পক্ষ থেকে ২০২০ সালে হাজী সেলিমের স্ত্রীর নামে একটি জিডি হয়েছিল চকবাজার থানায়। এরপর হাজী সেলিমের লোকজন মৌলভীবাজার শাখার অগ্রণী ব্যাংকের  কর্মকর্তাদের হত্যার হুমকি দেন। ৩ জন কর্মকর্তা সেসময় ভয়ে এই শাখা ছেড়ে স্বেচ্ছায় বদলি হয়ে যান।

২০১৯ সালে হাইকোর্টের নির্দেশ অমান্য করে পুরান ঢাকার চকবাজারে ঈদের দিন রাতে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের ‘জাহাজ বাড়ি’ ভেঙে ফেলে হাজী সেলিমবাহিনী। এই ঘটনায় চকবাজার থানায় একটি জিডি হয়েছিল। তবে তদন্ত আর আলোর মুখ দেখেনি।

এআর/জেইউ

Visit Source Page

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *