কোটা সংস্কারে পরিচালিত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমনের নামে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ২৫ কোটি টাকা আনার তথ্যটি ‘ভুয়া’ বলে দাবি করেছেন পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (এসবি) মনিরুল ইসলাম।
কোটা সংস্কারে পরিচালিত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমনের নামে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ২৫ কোটি টাকা আনার তথ্যটি ‘ভুয়া’ বলে দাবি করেছেন পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (এসবি) মনিরুল ইসলাম।
তিনি বলেন, ‘২৫ কোটি টাকা আনতে হলে কয় বস্তা লাগবে? সেটা আনার ক্ষেত্রে তো অন্তত দুটি পিকআপ লাগার কথা। টাকা যদি এনেই থাকি তাহলে সিসি ক্যামেরা আছে। সেখানে নিশ্চয়ই তথ্য থাকবে। যারা তদন্ত করছেন বের করুক। আমার বক্তব্য হলো, এটা ভুয়া। টাকা আনার কোনো ঘটনাই ঘটে নাই।’
‘আর আমি পালিয়ে যাইনি। পালাবোও না। আমি দেশেই ছিলাম, দেশেই আছি। ভবিষ্যতে দেশেই থাকবো। তবে, দীর্ঘদিন জঙ্গিবিরোধী কার্যক্রমে যুক্ত ছিলাম। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর অনেক সন্ত্রাসী, জঙ্গি জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। যাদের আমি নিজের হাতে গ্রেপ্তার করেছিলাম। তারা আমাকে এখন হুমকি দিচ্ছে। আমি তো এখন পুলিশের কেউ নই। আমাকে অবসরে পাঠানো হয়েছে। আমি এখন স্বাধীন। তাই কোথায় আছি সেটা তো ব্যক্তিগত। তবে, দেশেই আছি। নিরাপত্তার স্বার্থে সরকারি বাসায় ফিরিনি।’
বুধবার (১৮ সেপ্টেম্বর) ঢাকা পোস্টের পক্ষ থেকে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি এসব কথা বলেন।
স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের আমলের প্রভাবশালী পুলিশ কর্মকর্তা, পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) সাবেক প্রধান মনিরুল ইসলামের কক্ষ থেকে ২৫ কোটি টাকা সরিয়ে নেওয়ার অভিযোগ ওঠার পর চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এরই মধ্যে ঘটনাস্থল পরিদর্শন, আলামত সংগ্রহ ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাক্ষ্য নিয়েছে তদন্ত কমিটি। সিসি ক্যামেরা বন্ধ কেন, মনিরুলের কক্ষে কার কার প্রবেশাধিকার ছিল, কারা সেদিন প্রবেশ করেছিল, টাকা আদৌ কত ছিল, সরিয়েছে মূলত কারা— এসব প্রশ্নের সমাধান খুঁজছে চার সদস্যের এই তদন্ত কমিটি। তদন্তে কাজ শুরু করেছে সিআইডির ফরেনসিক টিমও। ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটনে নেওয়া হচ্ছে বিশেষজ্ঞ মতামত।
পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা মনিরুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করা গেলে অনেক প্রশ্নের উত্তর মিলবে। জানা যাবে ওই ২৫ কোটি টাকা আনা ও সরানোর তথ্য। তাকে খোঁজা হচ্ছে বলেও দাবি করা হয়েছে।
সোর্স মানির নামে ২৫ কোটি টাকার ঘটনা ভুয়া দাবি
‘আমি ৪ আগস্ট গণভবন থেকে ২৫ কোটি টাকা নিয়ে এসেছি, ৫ তারিখে (আগস্ট) অফিসে যাইনি। অন্য সহকর্মীরা টাকাটা মেরে দিয়েছে’— এমনটাই অভিযোগ। আমি আসলে টাকা আনিনি। এটা ভুয়া অভিযোগ।’
তিনি বলেন, ‘টাকা আনার কোনো ঘটনা ঘটেনি। এসবি তো অপারেশনাল ফোর্স না। অস্ত্র নিয়ে এই আন্দোলনে এসবির কেউ ডিউটিও করেনি। দ্বিতীয়ত হলো, এসবি হলো ইনটেলিজেন্স ফোর্স, ফাইটিং ফোর্স না। সুতরাং এমন টাকা আনার প্রশ্নই ওঠে না। আমি সত্যিকার অর্থে বলছি, বিশ্বাস করবেন কি করবেন জানি না, ২৫ কোটি টাকা আমি একসঙ্গে কোনোদিন দেখিনি। এটা পুরোটাই ভুয়া।’
মনিরুল ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, ‘২৫ কোটি টাকায় কয় বান্ডিল, কয় বস্তা টাকা হয়, বলেন? দুই কোটি নিতেই তো এক বস্তা লাগবে। তাহলে ৪ আগস্ট এই বস্তা যদি ১২/১৩টা হয়, তা গণভবন থেকে আমার গাড়িতে আনা সম্ভব না। আর আমার রুমে যেতে তো অন্তত ১০টা সিসি ক্যামেরা আছে। এই সময়ে তো ১০টা সিসি ক্যামেরা এক সেকেন্ডের জন্য বন্ধ রাখার সুযোগ নাই। তাহলে তো নানা রকমের ফুটেজ থাকার কথা। মূল কথা হলো কোনো ভিত্তি নাই, এক টাকাও আনি নাই। এক টাকাও দেয় নাই।’
‘আর টাকা আমাকে কেন দেবে? টাকা দিলে তো ফাইটিং ফোর্সকে দেবে। আমাকে কেন? আমরা ইনটেলিজেন্স বেইজ। এজন্য সোর্স মানি আসে। সেটা তো মন্ত্রণালয় থেকে পুলিশ সদরদপ্তর হয়ে চেকের মাধ্যমে বরাদ্দ হয়ে আসে। যদিও গোয়েন্দা সংস্থা হিসেবে এর অডিট হয় না, কিন্তু হিসাব আছে।’
ছাত্র আন্দোলনে শক্তিপ্রয়োগ করলে হিতে বিপরীত হবে, গোয়েন্দা প্রতিবেদন দেওয়ার দাবি
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন হচ্ছে। এই আন্দোলনেই সরকারের পতন ঘটলো। আপনারা আসলে কী ধরনের ইনটেলিজেন্স রিপোর্ট দিয়েছিলেন? জানতে চাইলে মনিরুল ইসলাম বলেন, ইনটেলিজেন্স এজেন্সিগুলোর কিছু ঝামেলা আছে। সবসময় বলা হয় ইনটেলিজেন্স ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু কখনও সফল হয়েছে তা বলা হয় না। এই আন্দোলনে আমরা কী রিপোর্ট দিয়েছিলাম তা তো মিনিস্ট্রিতে দেওয়া হয়েছে। আদালতে যখন রায় হয় তার পরে অনেকগুলো রিপোর্ট দিয়েছি। ছাত্র আন্দোলন দিনে দিনে বাড়ছে, মানুষের সম্পৃক্ততা বাড়ছে। রাজনৈতিক দলগুলোও যুক্ত হচ্ছে। জাতীয় পার্টি রংপুরে সক্রিয় হয়েছে। শক্তি নয় আলোচনার মাধ্যমে সমাধানে পৌঁছানো যাবে। শক্তিপ্রয়োগে হিতে বিপরীত হবে। এসবই রিপোর্ট দিয়েছি। তবে, সব তো বলা যাচ্ছে না। কারণ, আমি শর্ত মোতাবেক পিআরএলে আছি।
ছাত্র আন্দোলনে শুরু থেকে যুক্ত ছিল ছাত্রলীগের একটি অংশ
সবসময় বলেছি, এটা ছাত্রদের আন্দোলন। এই আন্দোলনে শুরু থেকে ছাত্রলীগেরই একটা অংশ সমর্থন দিয়েছে। আমরাও বলেছি আদালতে সমাধান হোক, কোটা কমিয়ে আনা হোক। সংযম ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে সব আন্দোলন দমনে গোয়েন্দা প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছিল বলে দাবি করেন মনিরুল ইসলাম।
জঙ্গিবাদে অর্থদাতা নিষিদ্ধ দুই এনজিও’র সঙ্গে সম্পৃক্ততা অস্বীকার
মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক দুটি এনজিওকে পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন মনিরুল ইসলাম, এমন অভিযোগও উঠেছে। ‘কুয়েত সোসাইটি ফর রিলিফ’ ও ‘শারজাহ চ্যারিটি ইন্টারন্যাশনাল’ নামের দুটি এনজিও জঙ্গি অর্থায়নে অর্থদাতা হিসেবে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট কর্তৃক এনজিও দুটির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি আছে। বাংলাদেশেও এর কার্যক্রম নিষিদ্ধ ছিল। এমনকি ২০১৭ সালে জঙ্গি সংগঠনগুলোর অর্থের জোগানদাতা হিসেবে চিহ্নিত ১৭টি এনজিওর তালিকা করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ওই তালিকায় মনিরুল ইসলামের দখল করা এনজিও দুটির নামও ছিল।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘এ ব্যাপারে মানবজমিনের খবর আমি পড়েছি। ওই এনজিও প্রতিবাদ দিচ্ছে। আমার পরিবার থেকেও প্রতিবাদ দেওয়া হচ্ছে। জঙ্গিবাদে অর্থদাতা নিষিদ্ধ দুই এনজিওর সঙ্গে আমার সম্পৃক্ততার তথ্য পুরোটাই ভুয়া। কেএসআর কুয়েতভিত্তিক একটি খাদ্য বিতরণ এনজিও। ১৯৯৪ সালে প্রতিষ্ঠা হওয়া এনজিওটির পূর্ব নাম ছিল রিভাইভাল অব দ্য ইসলামিক হেরিটেজ। এটা যথাসম্ভব বন্ধ হয়েছে ২০০৪ সালে। এটার সঙ্গে কারা কারা আছে তা এনজিও কর্তৃপক্ষই বলবে। আমি কোনোদিন যাইনি।’
তবে, কুয়েত সোসাইটি ফর রিলিফ ও শারজাহ চ্যারিটি ইন্টারন্যাশনাল নামের দুটি এনজিওতে টুকটাক ঠিকাদারি কাজ করার বিষয়টি স্বীকার করেন তিনি। ‘এনজিও ব্যুরোতে তো কাগজপত্র আছে। পারিবারিকভাবে আমাদের কোনো সম্পৃক্ততা নাই। কাগজ ঘাটলেই পাওয়া যাবে’— বলেন মনিরুল ইসলাম।
জঙ্গি অভিযানের নামে অনেক ঘটনা ‘বানোয়াট’ ও ‘নাটক’ সাজানোর অভিযোগ পুরোনো। জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার বিরুদ্ধে অভিযানের সময় রাজনৈতিক দমন-পীড়নের অংশ হিসেবে জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান ও তার ছেলেকে জড়ানোর অভিযোগ ওঠে। এসবিতে থেকেও সিটিটিসিকে ব্যবহার করে এক সাংবাদিকের বুদ্ধি-পরামর্শে আপনি (মনিরুল) তাদের ফাঁসাতে গ্রেপ্তার করেছিলেন।
এ সম্পর্কে মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘দুজন রাজনৈতিক নেতার নাম বলুন যাদের আমি গ্রেপ্তারের নামে হয়রানি করেছি। তাবেলা সিজার হত্যার সময় আমি ডিবিতে ছিলাম। কোনো বিএনপি নেতাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করিনি। পরবর্তী সময়ে আমি সিটিটিসিতে যাই। মামলার তদন্ত-সংক্রান্ত কোনো সংযোগও নেই আমার।’
জামায়াত আমিরের সঙ্গে কখনও দেখা হয়নি, ফাঁসানোর চেষ্টা অবগত নই
‘জামায়াতের আমির ও তার ছেলেকে ফাঁসানোর চেষ্টায় আমার কোনো ধরনের ইনভলমেন্ট নাই। আমি কিছু জানিও না। অবগতও নই। সিটিটিসি তো চলে ডিএমপির অধীনে। সেখানে আমি যখন ছিলাম তখন এসবি চিফের সঙ্গে কখনও পরামর্শ করিনি। এই ধরনের কোনো ঘটনা ঘটে থাকলে সেটা ডিএমপিই বলতে পারবে। আর জামায়াতের আমিরের সঙ্গে আমার কখনও দেখা হয়নি, কোনো জমিজমা বা টাকা-পয়সা নিয়েও বিরোধ নাই। আর শারক্বীয়াবিরোধী অভিযান তো প্রথমবার শুরু হয়েছে। পরবর্তী সময়ে সিটিটিসি অভিযান করেছে বলে জানি।’
‘আমি সবসময় পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজ করার চেষ্টা করেছি। অনেক সময় রাজনৈতিক শীর্ষ নেতারা গ্রেপ্তার হয়েছেন। ২০১৬ সাল পর্যন্ত আমি ডিবিতে ছিলাম। সিটিটিসিতে যাওয়ার পর কোনো রাজনৈতিক দল বা নেতা-কর্মীর সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না।’
হুমকি-নিরাপত্তার কারণে আমি সরকারি বাসায় ফিরিনি
আমি তো পিআরএলে (অবসর-উত্তর ছুটি) আছি। এর কিছু শর্ত আছে। নিরাপত্তাহীনতা বোধ থেকেই আমি সরকারি বাসায় ফিরিনি ৫ আগস্টের পর। কারণ, সরকার পতনের পর অনেক সন্ত্রাসী, জঙ্গি জামিনে মুক্তি পেয়েছে। যাদের অনেকে আমার হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিল। ফেসবুকের ম্যাসেঞ্জার, সোশ্যাল মিডিয়ায় আমার বিরুদ্ধে এবং আমাকে ক্রমাগত হুমকি দেওয়া হচ্ছে। সে কারণেই আমি বাসায় নাই।
দেশেই আছি, দেশেই থাকবো
‘আমি তো এখন পুলিশের কেউ নই। আমাকে অবসরে পাঠানো হয়েছে। আমি এখন স্বাধীন। তাই কোথায় আছি সেটা তো ব্যক্তিগত। তবে, দেশেই আছি। দেশেই থাকবো।’
আমি আন্দোলনের সময় আমেরিকা ছিলাম, তবুও ১৪ মামলা
তিনি বলেন, ‘ফৌজদারি মামলা হলে তো মেরিট থাকতে হবে। এখন পর্যন্ত আমার বিরুদ্ধে ১৪টা মামলার হিসাব রেখেছি, আর রাখি না। কারণ, এগুলোর অধিকাংশই (মামলা) হয়েছে ১৮ ও ১৯ তারিখের (জুলাই) ঘটনায়। যখন আমি আমেরিকায়। ১৪ তারিখ (জুলাই) থেকে আমি নিউইয়র্কে ছিলাম। ১৮ তারিখ (জুলাই) রাতে রওনা দিই। ১৮ ও ১৯ তো আমি ফ্লাইটে। সেসময় তো হুকুম দেওয়ার সুযোগ নাই ফ্লাইট থেকে। এ ছাড়া দেশে তো তখন ইন্টারনেট ছিল না। মামলাগুলোর ধরন দেখলে বুঝবেন, লোক ঠিক করে ধরে ধরে মামলা দেওয়া হচ্ছে।’
মামলার তদন্তে আস্থা রাখতে চাই, জড়িত থাকলে গ্রেপ্তার করুক
‘বেশিকিছু তো আমি বলতে পারবো না। মামলা হলেই তো অ্যারেস্ট করা যায় না। সার্কুলারও হয়েছে। আমি আস্থা ও বিশ্বাস রাখতে চাই। আমি না হয় আগে দলীয় পুলিশ ছিলাম। এখন যারা দায়িত্বে আছেন তারা নিশ্চয়ই পেশাদার পুলিশ, আস্থা রাখতে চাই তারা পেশাদারিত্বের সঙ্গে অভিযোগের তদন্ত করবেন। তদন্তে যদি তারা সম্পৃক্ততা পান আমাকে গ্রেপ্তার করবেন। সেটা আমি আইনগতভাবে মোকাবিলা করবো।’
জেইউ/এসএম