৪০ বছর ধরে লালন মেলায় ছুটে আসেন ভাই-বোন

৪০ বছর ধরে লালন মেলায় ছুটে আসেন ভাই-বোন

‘আমি ৪০ বছর ধরে লালন মেলায় আসি। লালন মেলার কথা শুনলে আর বাড়িতে মন থাকে না। লালনের মায়ার টানে মেলায় ছুটে আসি। এখান থেকে বাড়িতে যেতে ইচ্ছে করে না। মন বলে থেকে যাই। আমি ও আমার আপন বড় বোন প্রায় ৪০ বছর ধরে এখানে আসি। এখানে এসে খুব ভালো লাগে, শান্তি লাগে। আগে এতো বড় বড় বিল্ডিং ছিল না। তখন ছোট ছোট ঘর ছিল। লালনের মাজারে অনেক উন্নয়ন হয়েছে। আরও উন্নয়ন হোক।’

‘আমি ৪০ বছর ধরে লালন মেলায় আসি। লালন মেলার কথা শুনলে আর বাড়িতে মন থাকে না। লালনের মায়ার টানে মেলায় ছুটে আসি। এখান থেকে বাড়িতে যেতে ইচ্ছে করে না। মন বলে থেকে যাই। আমি ও আমার আপন বড় বোন প্রায় ৪০ বছর ধরে এখানে আসি। এখানে এসে খুব ভালো লাগে, শান্তি লাগে। আগে এতো বড় বড় বিল্ডিং ছিল না। তখন ছোট ছোট ঘর ছিল। লালনের মাজারে অনেক উন্নয়ন হয়েছে। আরও উন্নয়ন হোক।’

এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন নাটোর জেলার বড়াইগ্রাম উপজেলার অন্তর্গত হারোয়া গ্রামের বাসিন্দা ও মানু প্রামাণিকের ছেলে সলেমান ফকির (৭৪)। তিনি একজন লালন অনুসারী। প্রায় ৪০ বছর ধরে তিনি ও তার আপন বড় বোন সামর্থভান (৮০)। মায়ার টানে ৪০ বছর ধরে লালন মেলায় আসছেন তারা।

সমর্থভান বলেন, লালনের মায়ার ও ভালোবাসার টানে প্রায় ৪০ বছর ধরে লালন মেলায় আসি। এখানে আসলে ভালো লাগে, শান্তি লাগে। লালন মেলা একটা ফুলের বাগান, ফুলের বাগান দেখতে আসি। আমার সাঁইজি ফুলের বাগান তৈরি করে দিয়ে গেছে। ফুল ফুটে, আমরা সেবা করতে আসি।

রাজশাহী থেকে লালন মেলায় আসা বোরহান উদ্দিন ফকির বলেন, লালনকে ভালো লাগে, লালনের বাণী ভালো লাগে। তাই লালনকে ভালোবাসি। লালন ফকির যেভাবে দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন, আমরা সেভাবে চলছি। ভালোবাসার টানে ৩০ বছর ধরে এখানে আসি। আগের চিত্র আর এখনকার চিত্র অনেক পার্থক্য, অনেক উন্নতি হয়েছে। সাধুর মেলা, মিলনমেলায় এসে খুব শান্তি লাগে। এখানে করাও মধ্যে কোনো হিংসা নেই।

নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা একজন লালন ভক্ত বলেন, সাঁইজি বলে গেছেন, এই জগৎ-সংসার করার জন্য, মানুষকে সঠিক পথে চলার জন্য। যেখানে হিংসা-বিদ্বেষ অহংকার থাকবে না। সবাই মানুষ, সবাই সমান হবে। মানুষের কল্যাণে কাজ করবে। সাঁইজির বাণী পৃথিবীর মানুষ মানলে, এতো অকল্যাণ হতো না। আত্মশুদ্ধির জন্য লালন মেলায় ছুটে আসি। এখানে আসলে শান্তি লাগে।

তাদের মতো হাজারো ভক্তরা কয়েক যুগ ধরে লালন মেলায় ছুটে আসেন। আধ্যাত্মিক সাধক বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহের ১৩৪তম তিরোধান দিবস উপলক্ষ্যে তিন দিনব্যাপী লালন মেলা চলছে। আজ মেলার শেষ দিন। কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় লালন মেলায় লাখো ভক্ত-অনুসারী ও দর্শনার্থীদের ঢল নেমেছে। এতে  লালন শাহের মাজার প্রাঙ্গণ, মাঠ, কালি নদীর পাড় ঘেঁষে বসেছে দূরদূরান্ত থেকে আসা ভক্ত-অনুসারীদের দল। সেখানে ভিড় জমাচ্ছে লাখো মানুষ। আখড়াবাড়ি চত্বরে তিল পরিমাণ জায়গা ফাঁকা নেই। মানুষের খারাপ অবস্থা। চত্বরের দুই কিলোমিটার আগে থেকে সাধু, ভক্ত ও অনুসারীদের ভিড় লেগেই আছে। লালন মেলা পরিণত হয়েছে লাখো মানুষের মিলন মেলায়।

দূরদূরান্ত থেকে আসা দেশি-বিদেশি ভক্ত-অনুসারীরা খণ্ডভাবে দলবদ্ধ হয়ে লালন ফকিরের গান গাইছেন। দিনরাত গান ছাড়াও তারা লালন ফকিরের বাণী নিয়ে একে-অপরের সঙ্গে আলোচনা করছেন। অনেকে আবার লালনের মত ও পথের দীক্ষা নিচ্ছেন। লালন মেলায় আসা লাখ লাখ মানুষের মধ্যে নারীদের সংখ্যা খুবই কম। মেলায় আসা অসংখ্য নারী শারীরিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। মেলায় আসা বখাটে মাতালরা এমন আচরণ করেছেন বলে জানা গেছে। 

বৃহস্পতিবার (১৭ অক্টোবর) থেকে তিন দিনব্যাপী শুরু হয়েছে লালন মেলা। সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় লালন অ্যাকাডেমির আয়োজনে এই মেলার আজ শেষ দিন। এ উৎসবকে কেন্দ্র করে লাখো বাউল-ভক্ত ও দর্শনার্থীরা এসেছেন লালন আখড়াবাড়িতে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, লালন মেলা উপলক্ষ্যে ছেঁউড়িয়ার আখড়াবাড়িতে দূরদূরান্ত থেকে এসেছেন লাখ লাখ ভক্ত-অনুসারী ও দর্শনার্থীরা। আখড়াবাড়ি চত্বর ও আশেপাশের কয়েক কিলোমিটার তিল পরিমাণ জায়গা ফাঁকা নেই। ভিড়ে মানুষের দিশেহারা অবস্থা। ঠেলাঠেলিতে কেউ কেউ অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। ভক্ত-অনুসারীদের দলবদ্ধ হয়ে লালন ফকিরের গান গাইতেও দেখা যায়।

এ ছাড়াও লালনের বাণী ও আদর্শ নিয়ে একে অপরের সঙ্গে আলোচনা করছেন। লালনের গানে গানে মুখরিত পুরো মেলা। অনুসারীরা লালন ফকিরের মাজার প্রাঙ্গণ, মাঠ, কালি নদীর পাড় ঘেঁষে অস্থায়ীভাবে পলিথিন খুপরি ঘর তৈরি করেছেন আস্তানা। লালন মেলায় কালি নদীর পাড়ে মাঠে বসেছে গ্রামীণ মেলা। আশপাশের এলাকায়ও হরেক রকম পসরা সাজিয়ে বসেছেন ব্যবসায়ীরা।

মেলায় আসা লালন ভক্ত, অনুসারী ও দর্শনার্থীরা বলেন, লালন মেলায় এক লাখেরও বেশি মানুষের পদচারণা মুখরিত। যতই সময় পার হচ্ছে ততই ভিড় বাড়ছে। কয়েক কিলোমিটার ভিড়ে ঠেলাঠেলি করে মেলার মাঠে আসতে হচ্ছে। এতে খুব কষ্ট হচ্ছে। ঠেলাঠেলিতে শরীর ব্যথা হয়ে যাচ্ছে। চারপাশে মানুষ আর মানুষ, লাখ লাখ মানুষের মিলন মেলায় পরিণত হয়েছে এই মেলা।

লালন মেলায় আসা কয়েকজন নারী দর্শনার্থী বলেন, কয়েক কিলোমিটার রাস্তায় মানুষের ভিড় ঠেলে মেলার মাঠে পৌঁছাতে হয়। ধাক্কাধাক্কি, ঠেলাঠেলিতে খুব কষ্ট হয়েছে। এক প্রকার যুদ্ধ করে মেলার মাঠে এসেছি। মানুষের উপচে পড়া ভিড়ে বখাটেরা নারীদের শারীরিক নির্যাতন করে। মেলায় আসা নারীর সংখ্যা খুবই কম। যারা আসছে তাদের অনেকেই শারীরিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। শতশত গাজার দোকান বসেছে, হাজার হাজার মানুষ গাজা সেবন করছে। গাজার গন্ধ লালন মেলায় ছড়িয়ে পড়েছে। এতে অনেকেই অস্বস্তিতে পড়ছেন।

মানুষের মরমি সাধক ফকির লালন শাহ কুষ্টিয়ার শহরতলি কুমারখালী উপজেলার চাপড়া ইউনিয়নের ছেঁউড়িয়া গ্রামে ১৮৯০ সালের ১ কার্তিক মারা যান। পরবর্তীতে এখানে লালন মেলার আয়োজন শুরু হয়। সেই থেকে লালন ভক্তরা প্রতি বছরই নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে তাদের কাঙ্ক্ষিত এ উৎসব পালন করেন। সাঁইজির স্মরণে দিবসটি ঘিরে তিন দিনের অনুষ্ঠান হয় আখড়াবাড়িতে। লালন ফকিরের গানে গানে এখন পুরো এলাকা মুখরিত।

লালন অ্যাকাডেমির কয়েকজন সদস্য বলেন, এবার মেলায় অন্যবারের তুলনায় মানুষের ভিড় বেশি। এক লাখেরও বেশি ভক্ত-অনুসারি, সাধু-ফকির ও দর্শনার্থীরা এসেছেন। লালন মেলার দ্বিতীয় দিনে মানুষের উপস্থিতি অনেক বেড়েছে। কুষ্টিয়ার আখড়াবাড়ির ভেতরে ও বাইরে যেন পা ফেলার জায়গা নেই।

এসব বিষয়ে কুষ্টিয়ার ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক ও লালন অ্যাকাডেমির অ্যাডহক কমিটির সভাপতি শারমিন আখতার বলেন, লালন মেলা উপলক্ষ্যে মাজার প্রাঙ্গণ ও তার আশপাশের এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। পুলিশ, র‌্যাব ও সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা মোতায়েন আছে। মাজার এলাকা সিসি ক্যামেরার আওতায় রয়েছে।

প্রসঙ্গত, ১২৯৭ বঙ্গাব্দের পহেলা কার্তিক উপমহাদেশের প্রখ্যাত সাধক বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহের মৃত্যুর পর থেকে তার স্মরণে লালন অ্যাকাডেমি ও জেলা প্রশাসন এই মেলা চালিয়ে আসছিল। প্রতিবছর ১ কার্তিক আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে কুষ্টিয়ার কুমারখালির ছেঁউড়িয়ায় ফকির লালন শাহের তিরোধান দিবস পালন করা হয়।

রাজু আহমেদ/এএমকে

Visit Source Page

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *