সহিংসতার পর নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় দীঘিনালার ব্যবসায়ীরা

সহিংসতার পর নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় দীঘিনালার ব্যবসায়ীরা

সহিংসতার পর বর্তমানে অনেকটাই শান্ত দীঘিনালার পরিস্থিতি। পুড়ে যাওয়া দোকানপাটের অবশিষ্টাংশ পরিষ্কার করে আবার নতুন করে তা তৈরি করতে ব্যস্ত সময় পার করছেন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা। তাদের মধ্যে বেশিরভাগ ব্যবসায়ীর চোখে-মুখে হতাশার ছাপ। সাজানো গোছানো স্বপ্ন চোখের সামনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। সহিংসতার জেরে মুহূর্তের মধ্যে নিঃস্ব হয়ে গেছেন তারা। 

সহিংসতার পর বর্তমানে অনেকটাই শান্ত দীঘিনালার পরিস্থিতি। পুড়ে যাওয়া দোকানপাটের অবশিষ্টাংশ পরিষ্কার করে আবার নতুন করে তা তৈরি করতে ব্যস্ত সময় পার করছেন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা। তাদের মধ্যে বেশিরভাগ ব্যবসায়ীর চোখে-মুখে হতাশার ছাপ। সাজানো গোছানো স্বপ্ন চোখের সামনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। সহিংসতার জেরে মুহূর্তের মধ্যে নিঃস্ব হয়ে গেছেন তারা। 

লারমা স্কয়ার, এবং বাস টার্মিনাল ঘুরে দেখা যায় সেদিনের বীভৎস সহিংসতার চিত্র। দোকানপাটের মালামাল পুড়ে কয়লা হয়ে পড়ে রয়েছে। দোকানের পুড়ে যাওয়া খুঁটির সারি দাঁড়িয়ে আছে। যেখানে গত কয়েকদিন আগেও সাজানো গোছানো দোকান ছিল। ক্রেতা-বিক্রেতাদের হাঁকডাকে জমজমাট ছিল। এখন বিষাদে পরিণত হয়েছে। 

কয়েকটি দোকানের মালিক নতুন করে অবকাঠামো তৈরি করতে কাজ করছেন। অনেকেই জানিয়েছেন হতাশার কথা। ধারদেনা করে ঘুরে দাঁড়াবেন তারও উপায় নেই। অনেকে আবার আগের ঋণ কী করে পরিশোধ করবেন তা নিয়েও চিন্তিত।

লারমা স্কয়ার এবং বাস টার্মিনালে পাহাড়ি-বাঙালি সব সম্প্রদায় ব্যবসা করতো। সহিংসতায় ব্যবসায়ীদের পথে বসিয়ে কারা লাভবান হলেন- এ প্রশ্ন এখানকার ব্যবসায়ীদের।

বোয়ালখালী বাস টার্মিনালের পাহাড়িকা হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের মালিক দিপন চাকমা জানান, উপার্জিত সব অর্থ ব্যয় করে গত কিছুদিন হলো নতুন করে দোকান তৈরি করেছেন। দোকানে মালামাল ভরপুর ছিল। দোকানটি ছিল তার একমাত্র আয়ের উৎস। সহিংসতায় তার দোকান পুড়ে অন্তত ৪০/৫০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। সহায়সম্বল হারিয়ে এখন তিনি নিঃস্ব। এখন তিনি কী করবেন, কীভাবে পরিবারের ভরণপোষণ চালাবেন, তা নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন। 

তার পাশের আরেকটি হোটেলের মালিক কণিকা চাকমা জানান, সামনে হোটেল আর পেছনে ছিল তাদের থাকার ঘর। দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে তাদের সবকিছুই পুড়ে গেছে। সহায়সম্বল হারিয়ে এখন অসহায় হয়ে পড়েছেন।

লারমা স্কয়ারে দোকান পুড়ে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী দিদারুল আলম বলেন, এখানে দীর্ঘ বছর ধরে পাহাড়ি-বাঙালি ভাই ভাই হিসেবে সম্প্রীতির বন্ধনে মিলেমিশে ব্যবসাবাণিজ্য করে আসছি। কেন এমনভাবে আগুন দিয়ে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান জ্বালিয়ে দেওয়া হলো? যে ক্ষতি হয়ে গেল তার ক্ষতিপূরণ কে দেবে। 

তিনি জানান, তার হার্ডওয়ারসহ ভ্যারাইটিজ মালামালের দোকান ছিল। আগুনে ১৭/১৮ লাখ টাকার মালামাল পুড়ে গেছে।

আগুনে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে লারমা স্কয়ারে দুইটি বসতবাড়ি রয়েছে। সোলাইন রাখাইন ও এডিশন চাকমার। বসতবাড়ির সামনে নাপ্পির দোকান চালাতেন সোলাইন রাখাইন। 

তিনি বলেন, আগুনে পুড়ে ঘরবাড়ি, দোকানের মালামাল মিলে বিশ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।

এছাড়া, আগুনে পুড়ে বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে পুষ্প বিতান ও সাজঘর, আম্বিয়া ট্রেডার্স, কুসুম কুকারিজ, বিসমিল্লাহ বীজ ভাণ্ডার, ত্রিরত্ন মাইক সার্ভিস এবং প্রিয়দর্শী ট্রেডার্সের। 

সেদিন কি ঘটেছিল লারমা স্কয়ারে?

গত ১৯ সেপ্টেম্বর বরাবরের মতোই স্বাভাবিক কার্যক্রম চলছিল বোয়ালখালী বাজারে। খাগড়াছড়ি সদরে এক বাঙালি হত্যার ঘটনার প্রতিবাদ জানাতে বিকেল সাড়ে চারটার দিকে দীঘিনালা কলেজের কয়েকজন বাঙালি শিক্ষার্থী মিছিল বের করে। 

প্রত্যক্ষদর্শী বিসমিল্লাহ বীজ ভাণ্ডারের মালিক আকতার হোসেন বলেন, দীঘিনালা থানা বাজার থেকে একটি মিছিল লারমা স্কয়ার, বোয়ালখালী গরুর বাজার হয়ে পুনরায় লারমা স্কয়ার হয়ে দীঘিনালা থানা বাজারের পথে যাওয়ার চেষ্টা করে। লারমা স্কয়ার পৌঁছালে হঠাৎ হট্টগোল শুরু হয়। শুরু হয় ইটপাটকেল ছোড়াছুড়ি। গুলতির সাহায্যে ছোঁড়া কিছু মার্বেল এসে পড়তে দেখা যায়। পাহাড়ি-বাঙালি দুই পক্ষের মধ্যে প্রায় আধাঘণ্টার মতো চলে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। হঠাৎ করে বাজারের কয়েকটি স্থানে দোকানে আগুন জ্বলতে দেখা যায়। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, ইটপাটকেল ছুঁড়াছুঁড়ির এক পর্যায়ে লারমা স্কয়ারের বটতলী সামনে থেকে কয়েক রাউন্ড রাইফেলের গুলি ছোঁড়ে। এতেই ঘটনার মোড় পাল্টে যায়। উত্তেজিত হয়ে যায় বাঙালিরা। কল্পরঞ্জন মাঠ এবং বোয়ালখালী বাজারে অবস্থান করে বাঙালিরা। হঠাৎ করেই লারমা স্কয়ারের দুই পাশে দুইটি দোকানে আগুনের ধোঁয়া উঠতে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাসটার্মিনাল এবং লারমা স্কয়ার বোয়ালখালী সড়কে দুই দোকানে আগুন জ্বলতে দেখা যায়। 

ফেসবুকের একটি ভিডিওতেও গুলি করার একটি দৃশ্য ছড়িয়ে পড়েছে। আগুন দেওয়ার ঘটনায় যদিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পাহাড়ি-বাঙালি একে অপরকে দোষারোপ করে যাচ্ছে। আগুনে লারমা স্কয়ার এবং বাস টার্মিনালের ছোট-বড় মিলিয়ে শতাধিক দোকান পুড়ে গেছে। 

সহিংস ঘটনার পর থেকেই এলাকায় থমথমে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। পাহাড়ি-বাঙালি সম্প্রদায়ের মাঝে আস্থার সংকট সৃষ্টি হয়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। পারস্পরিক আস্থা ফিরিয়ে আনতে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন এলাকায় পাহাড়ি-বাঙালি মিলিয়ে বেশ কয়েকটি শান্তি কমিটি করা হয়েছে। দীঘিনালার লারমা স্কয়ারের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম। তদন্ত করে দোষীদের শাস্তির ব্যবস্থা করার কথা জানিয়েছেন তিনি। 

সহিংসতার ঘটনায় অজ্ঞাতদের আসামি করে পুলিশ বাদি হয়ে দীঘিনালা থানায় একটি মামলা দায়ের করেছে জানিয়েছেন দীঘিনালা থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ জাকারিয়া। মামলাটির তদন্ত চলমান রয়েছে। এলাকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক। দোকানপাট খোলা রয়েছে। এছাড়া, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে পুলিশের পাশাপাশি সেনাবাহিনীর টহল অব্যাহত রয়েছে জানান তিনি।

খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক মো. সহিদুজ্জামান বলেন, খাগড়াছড়ির সহিংসতার ঘটনার ক্ষয়ক্ষতির তালিকা প্রস্তুত করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ, আহত এবং নিহতদের তালিকা পার্বত্য মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে দেওয়া হয়েছে। নিহত প্রত্যেকের পরিবারকে ২৫ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছে। দীঘিনালায় ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে জেলা প্রশাসন থেকে ৭ লক্ষ টাকার চেক বিতরণ করা হয়েছে। পার্বত্য মন্ত্রণালয় থেকে ২০ টন চাল এবং দুই লাখ বিশ হাজার টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে। যা দ্রুত বিতরণ করা হবে। আবার যেন এ রকম ঘটনা না ঘটে, সে জন্য শান্তি সমাবেশ করা হচ্ছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নেতৃবৃন্দের সাথে মিটিং করা হচ্ছে। নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে উপজেলা এবং ইউনিয়নগুলোতে কমিটি গঠন করতে। যার মাধ্যমে যেকোনো উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলা করা যাবে।

মোহাম্মদ শাহজাহান/কেএ

Visit Source Page

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *