শুধুমাত্র এশিয়া-আফ্রিকা মহাদেশেই ৯০ লাখ মানুষ মারা যাবে

শুধুমাত্র এশিয়া-আফ্রিকা মহাদেশেই ৯০ লাখ মানুষ মারা যাবে

চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন বা পরামর্শ ছাড়াই ভোক্তারা সরাসরি ফার্মেসি থেকে অ্যান্টিবায়েটিক কিনে নিচ্ছে, অথবা ফার্মেসিতে গিয়ে সমস্যার কথা বললেই দিয়ে দেওয়া হচ্ছে অ্যান্টিবাঢোটিক। এছাড়া চিকিৎসকরাও কারণে অকারণে অতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক দিচ্ছেন।

চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন বা পরামর্শ ছাড়াই ভোক্তারা সরাসরি ফার্মেসি থেকে অ্যান্টিবায়েটিক কিনে নিচ্ছে, অথবা ফার্মেসিতে গিয়ে সমস্যার কথা বললেই দিয়ে দেওয়া হচ্ছে অ্যান্টিবাঢোটিক। এছাড়া চিকিৎসকরাও কারণে অকারণে অতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক দিচ্ছেন।

সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তারপরও বন্ধ হচ্ছে না বিভিন্ন ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি। অপ্রয়োজনে এই ওষুধ সেবনে তৈরি হচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ্যতা।

অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিতে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করেছেন একদল গবেষক। 

সম্প্রতি আইসিডিডিআর,বিসহ বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতাল, যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস আমহার্স্ট বিশ্ববিদ্যালয় এবং অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক ‘২০১০-২০২১ এর মধ্যবর্তি সময় বাংলাদেশি সংবাদপত্রে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ্যতা বিষয়ক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। বিগত এক দশকে বাংলাদেশের মূলধারার সংবাদপত্রে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ্যতা সংক্রান্ত সংবাদ কীভাবে প্রকাশ করা হয়েছে তা জানার জন্য গবেষণাটি করা হয়।

এছাড়া গবেষণাটি অ্যান্টিবায়োটিকের অকার্যকারিতা সম্পর্কে জনসাধারণের ধারণা এবং সচেতনতা গঠনে গণমাধ্যমের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার ওপর জোর দিয়েছে। 

বুধবার (০৯ অক্টোবর) আইসিডিডিআর,বি এ তথ্য জানিয়েছে।

২০১০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে ১২টি বাংলাদেশি দৈনিকের ২৭৫টি সংবাদ (প্রতিবেদন, সম্পাদকীয় ও মতামত) বিশ্লেষণ করা হয় এই গবেষণায়। পত্রিকা নির্বাচনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের— “পত্র-পত্রিকার প্রচার সংখ্যা ও বিজ্ঞাপন হার ২০১৮” তালিকা অনুসরণ করে সর্বাধিক প্রচার সংখ্যার ভিত্তিতে ছয়টি ইংরেজি এবং ছয়টি বাংলা পত্রিকা বাছাই করা হয়। পত্রিকাগুলো হলো— প্রথম আলো, ইত্তেফাক, যুগান্তর, কালের কণ্ঠ, সমকাল, ডেইলি স্টার, নিউ এজ, ফাইন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস, জনকণ্ঠ, নয়া দিগন্ত, ভোরের কাগজ এবং ডেইলি সান।

সংবাদ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ্যতা সম্পর্কিত ৩২.২% প্রতিবেদন করা হয় ভোক্তাদের দ্বারা অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার বিষয়ে। এছাড়া ২৯% সংবাদ ছিল প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি নিয়ে এবং ২৬.১% প্রতিবেদনে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের অতিরিক্ত ওষুধ দেওয়ার ঘটনা দেখা যায়।

তবে, গবেষণায় অ্যান্টিবায়োটিকের প্রসার এবং বিক্রিতে ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলির ভূমিকার বিষয়ে খুব বেশি প্রতিবেদন দেখা যায়নি। যেমন ডাক্তারদের কিছু নির্দিষ্ট অ্যান্টিবায়োটিক লিখতে উৎসাহিত করা, প্রণোদনা দেওয়া— এসব বিষয় সম্পর্কে প্রতিবেদন দেখা যায়নি। 

এছাড়া বিভিন্ন ঘটনার ভিত্তিতে করা সংবাদের পরিমাণ ছিল প্রায় ৪৫ শতাংশ। যেমন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ্যতা সম্পর্কিত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সেটি পত্রিকায় তুলে ধরা। এ ধরনের সংবাদ হওয়ার এখান থেকে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ্যতা বিষয়ে বিস্তারিত জানার সুযোগ ছিল না। এছাড়া অ্যান্টিবায়োটিকের অকার্যকারিতা মোকাবিলায় করণীয় সম্পর্কিত সংবাদে যেসব সুপারিশ দেওয়া হয়েছে সেগুলোও পর্যাপ্ত নয়। তবে, এসব বিষয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন করা হলে তা জনগণের জন্য ইতিবাচক হবে। 

আইসিডিডিআর,বির হেলথ সিস্টেমস অ্যান্ড পপুলেশন স্টাডিজ বিভাগের রিসার্চ ইনভেস্টিগেটর এবং এই গবেষণার প্রধান গবেষক ডা. তাহমিদুল হক বলেন, “মানুষের মাঝে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ্যতা বিষয়ে সচেতনতা তৈরি এবং জাতীয় কর্ম পরিকল্পনা সমর্থন করতে গণমাধ্যমে সঠিক, বিস্তারিত, এবং সামঞ্জস্যপূর্ণ সংবাদ প্রয়োজন। এর ফলে মানুষের মাঝে যেমন সচেতনতা তৈরি হবে তেমনি স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদেরও জবাবদিহিতার আওতায় নিয়ে আসা যাবে। বৈজ্ঞানিক তথ্য ও উপাত্তের ভিত্তিতে প্রতিবেন লেখার পাশাপাশি বাংলায় আরো বেশি সংবাদ প্রকাশ করলে জনসাধারণের মাঝে অ্যান্টিবায়োটিকের অকার্যকারিতা নিয়ে বোঝাপড়া উন্নয়ন হবে।”

১৭ কোটির জনসংখ্যার বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্যভাবে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ্যতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাম্প্রতিক তথ্য অনুসারে, মূত্রনালীর সংক্রমণ, গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল ইনফেকশন এবং সেপসিস সহ বিভিন্ন সংক্রমণের জন্য দায়ী ই. কোলাই-এর মতো সাধারণ অণুজীবের মধ্যে প্রতিরোধ্যতার হার উদ্বেগজনকভাবে বেশি, অ্যামপিসিলিনের রেজিস্ট্যান্স ৯৪.৬%, অ্যামোক্সিক্লাভ ৬৭.১%, সিপ্রোফ্লক্সাসিন ৬৫.২% এবং কো-ট্রাইমক্সাজোল ৭২%। অ্যান্টিবায়োটিকের উচ্চ প্রতিরোধ্যতা স্তরগুলো জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি গুরুতর হুমকির কারণ। কেননা এর ফলে ওষুধের কার্যকারিতা সীমিত হয়ে যায়, যার ফলে দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতা, উচ্চ চিকিৎসা ব্যয় এবং মৃত্যুর হার বৃদ্ধি পায়।এছাড়া  অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ্যতার এই উচ্চ হার আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক হুমকি। 

অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ্যতা বিষয়ে প্রতিবেদনের সংখ্যা বৃদ্ধি করা হলে, বিশেষত বাংলা প্রতিবেদন আরো বাড়াতে পারলে মানুষকে আরো সহজে সচেতন হতে সহায়তা করা যাবে। অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার বৃদ্ধিতে কোন প্রতিষ্ঠান চিকিৎসকদের কোনোভাবে প্রভাবিত করছে কিনা সেসব বিষয়ে অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদন সহ, বিভিন্ন প্রতিবেদন করার সময় সাংবাদিকরা স্বাস্থ্যসেবা বিশেষজ্ঞ, গবেষক এবং জনস্বাস্থ্য বিষয়ে যারা কাজ করে তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে পারেন। এর ফলে, প্রতিবেদনগুলোতে সর্বশেষ গবেষণার তথ্যাবলি প্রতিফলিত হবে এবং মানুষ আরো বিস্তারিত জানার সুযোগ পাবে, যা প্রতিবেদনগুলিকে সমৃদ্ধ করার পাশাপাশি জনসাধারণের মাঝে সচেতনতা এবং অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স বোঝার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

শুধুমাত্র ২০১৪ সালে, অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ্যতা বিশ্বব্যাপী ৭ লাখ মৃত্যুর কারণের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ছিল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী, ২০৫০ সাল নাগাদ অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের কারণে প্রতি বছর ১ কোটি মানুষ মারা যেতে পারে। শুধুমাত্র এশিয়া এবং আফ্রিকা মহাদেশেই প্রায় ৯০ লাখ মানুষ এর ফলে মারা যাবে। এছাড়া অর্থনৈতিকভাবে এই ক্ষতির পরিমাণ ২১০ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ২০৫০ সালে এই দুই অঞ্চলের জিডিপির ৭%। এছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ্যতা কাটিয়ে উঠার চিকিৎসার প্রয়োজনে আনুমানিক ২ কোটি ৪০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যেতে পারে, যা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আরো বাধা সৃষ্টি করে।

টিআই/এসএম

Visit Source Page

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *