শিক্ষায় শীর্ষ তিন পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিলের দাবিতে আন্দোলন

শিক্ষায় শীর্ষ তিন পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিলের দাবিতে আন্দোলন

রাষ্ট্রপতির ভাগনে থেকে ডিজি, তারপর চুক্তিভিত্তিক  

শিক্ষা প্রশাসনে শীর্ষ তিন দপ্তরে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের রয়েছে তিন কর্মকর্তা। এগুলো হলো মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালক, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী এবং জাতীয় শিক্ষাক্রম পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের চেয়ারম্যান (এনসিবিটি) চেয়ারম্যান। এর মধ্যে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার পর অফিস করছেন না মাউশির মহাপরিচালক। বাকি দুইজন শুধু হাজিরা দিয়েই চলে যাচ্ছেন। এতে শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে স্থবিরতা বিরাজ করছে।

এদিকে এই তিনজনের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের বাতিলের দাবিতে আন্দোলন করছেন ওই দপ্তরের কর্মকর্তা কর্মচারীর। তারা আওয়ামী লীগ সরকারের দেওয়া এসব চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিলের দাবিতে মাঠে নেমেছেন। শিক্ষা প্রশাসনে অন্যান্য দপ্তরগুলো আগের সরকারের সুবিধাভোগী কর্মকর্তাদের অফিসে অনুপস্থিত থাকতে দেখা গেছে।

শিক্ষা প্রশাসনে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগকে নজিরবিহীন বলছেন আন্দোলনকারী। তাদের দাবি, প্রশাসন ক্যাডার, পুলিশ ক্যাডারে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয় সরকারের স্বার্থে। কিন্তু শিক্ষা প্রশাসনে এর আগে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের তেমন নজির ছিল না। কিন্তু সাবেক দুইজন শিক্ষামন্ত্রী চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়ে এখানে নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

রাষ্ট্রপতির ভাগনে থেকে ডিজি, তারপর চুক্তিভিত্তিক  

শিক্ষা প্রশাসনে সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ পদ মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক। এ পদে সাবেক রাষ্ট্রপতির ভাগনে অধ্যাপক নেহাল আহমেদেই প্রথম চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছেন। সাধারণ কলেজ শিক্ষক থেকে আত্তীকরণের মাধ্যমে ১৪তম বিসিএসে সংযুক্ত হওয়া এই শিক্ষক আওয়ামী লীগ ক্ষমতা আসার পর শিক্ষা প্রশাসনে শীর্ষ পদে আসীন হতে শুরু করেন।

সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের ভাগনে এই সূত্রে ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ, ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান থেকে মাউশি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বনে যান। প্রায় দুই বছর নিয়মিত ডিজি থাকার পর গত ১৩ এপ্রিল তার চাকরির স্বাভাবিক মেয়াদ শেষ হয়েছিল। কিন্তু মামার জোরে তিনি ফের এক বছরের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পান। এ নিয়ে শিক্ষা ক্যাডারে ব্যাপক অসন্তোষ তৈরি হয়। ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশে ছেড়ে পালানোর পর তিনি আর অফিস করছেন না।

অফিস না করার কারণ জানতে একাধিকার ফোন দিলেও অধ্যাপক নেহাল আহমেদকে পাওয়া যায়নি।  

তার পরিবর্তীতে বর্তমান দায়িত্ব পালন করছেন পরিচালক (কলেজ ও প্রশাসন) অধ্যাপক রেজাউল করিম। তিনি ঢাকা পোস্টকে জানান, মহাপরিচালক কেন অফিস করছেন না তিনিই ভালো বলতে পারবেন।  

মাশরাফির চাচা সেই সূত্রে তিন বছরের চুক্তিতে এনসিটিবির চেয়ারম্যান

শিক্ষা প্রশাসনে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পদ জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি)। বিনামূল্যে পাঠ্যবই ছাপানো, কারিকুলাম সংক্রান্ত সব ধরনের কাজ করে থাকে প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু গত সরকার এই প্রতিষ্ঠানের রেকর্ড ভঙ্গ করে দুই দফায় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে আছেন সাবেক ক্রিকেটার ও নড়াইলের সাবেক সংসদ সদস্য মাশরাফি বিন মোর্ত্তজার চাচা অধ্যাপক মো. ফরহাদুল ইসলাম। সর্বশেষ দুই বছর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ কাটানোর পর ২৮ জুলাই ফের এক বছরের জন্য তাকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয় সরকার। এ নিয়ে তিনি তিন বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

তার বিরুদ্ধে একটি প্রিন্টার্সকে নিয়ম বহির্ভূত সুবিধা দিয়ে বিনামূল্যের বই ছাপার কাজ দেওয়ার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। গত বছর কয়েকজন প্রিন্টার্স তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে অভিযোগ করলেও সাবেক শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি তা আটকে দেন। ফের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়ার পর বিতর্কিত সেই প্রিন্টার্সকে কাজ দেওয়ার পাঁয়তারা করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এছাড়াও বর্তমান কারিকুলাম বাস্তবায়নে তার মুখ্য ভূমিকা রয়েছে বলে অভিযোগ অভিভাবকদের।

জানতে চাইলে নতুন কারিকুলাম বাতিলের দাবিতে আন্দোলন করা অভিভাবকদের সংগঠন সম্মিলিত শিক্ষা আন্দোলনের নেত্রী মারজানা আক্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, দাতা সংস্থার হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের এই কারিকুলাম জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার অন্যতম হোতা তিনি। তিনি কারও মতামত না নিয়েই এই কারিকুলাম বাস্তবায়ন করেছেন। আমরা একাধিকবার এই কারিকুলাম বাতিলের জন্য স্মারকলিপি দেখা করেছি, তিনি আমাদের তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে কের বের করে দিয়েছেন। দ্রুত তার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিলের দাবি জানাচ্ছি।

পুরো অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. ফরহাদুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি সরকারের একজন কর্মচারী। সরকার নিয়োগ দিয়েছে এখন সরকার যদি মনে করে তাহলে আমি চলে যাব।

একজন প্রিন্টার্সকে অনৈতিক সুবিধা দেওয়ার প্রসঙ্গে বলেন, ওই সময় সরকারের মন্ত্রী ও আমলাদের নানা চাপে কাজ করতে হয়েছে। সব কিছু সব সময়ে চাইলেও বলা যায়  না।

কারিকুলাম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটা সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্তে হয়েছে। আমি এককভাবে এটা বাস্তবায়ন বা বাতিল করার এখতিয়ার রাখি না।

ইইডির প্রধান প্রকৌশলীর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিলের দাবিতে আন্দোলন

সারাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন, নতুন ভবন নির্মাণ, বিদ্যমান ভবনগুলোর সম্প্রসারণ ও রক্ষণাবেক্ষণ, মেরামত ও সংস্কার এবং আসবাবপত্র সরবরাহের কাজ করে থাকে  শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর (ইইডি)।

এছাড়া মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম, আইসিটি ল্যাব স্থাপন, ইন্টারনেট সংযোগ, আইসিটি-সুবিধা সরবরাহের কাজও তারা করে থাকে। শিক্ষার উন্নয়ন বাজেটের সিংহভাগ এ দপ্তরের জন্য বরাদ্দ থাকে।  এই দপ্তরটির প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে দুই বছরের চুক্তিতে আছেন মো. দেলোয়ার হোসেন মজুমদার।

গত ১২ ফেব্রুয়ারি থেকে পরবর্তী ০২ (দুই) বছর মেয়াদে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয় সরকার। এর আগে ২০২২ সালের ১৩ অক্টোবর থেকে এ পদের চলতি দায়িত্ব এবং ২০২৩ সালের ৪ ডিসেম্বর প্রধান প্রকৌশলী পদে পদোন্নতি পান তিনি। সাবেক শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির এলাকার এই কর্মকর্তা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পান সদ্য সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের আমলে। কথিত রয়েছে, নওফেলের ব্যক্তিগত একান্ত সহকারী (এপিএস) অমিত ‍কুমার বসুকে ম্যানেজ করে এ পদে চুত্তিভিত্তিক নিয়োগ পান।

তার বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ঠিকাদারকে অগ্রিম বিল, নিম্নমানের কাজ করানো অভিযোগ রয়েছে। সর্বশেষ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে না পারায় ১৪৫টি কার্যাদেশ (ওয়ার্ক অর্ডার) বাতিল করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। একই সঙ্গে জামানত বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে এসব কাজের ঠিকাদারদের।

সম্প্রতি সিলেট অঞ্চলে ঠিকাদারকে কাজ না করিয়ে অগ্রিম বিল দেওয়ার হিড়িক পড়ে। একজন ঠিকাদার অগ্রিম বিল নেওয়ার পর তিনি মারা যান। বিষয়টি মন্ত্রণালয়ের নজরে আসার পর গঠন করা হয় তদন্ত কমিটি।  

এদিকে ইইডির প্রধান প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন মজুমদারের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিলের দাবিতে মানববন্ধন করেছে অধিদপ্তরের সর্বস্তরের প্রকৌশলী, কর্মকর্তা, কর্মচারীরা। মানববন্ধনে সভাপতিত্ব করেন ইইডির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আফরোজা বেগম। মানববন্ধনে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শহীদ আবু সাঈদসহ সকল শহীদের আত্মার মাগফেরাত ও দোয়া করা হয়।

পুরো বিষয়ে জানতে চাইলে ইইডির প্রধান প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন মজুমদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, অনেকেই হয়ত নানা কারণে সংক্ষুব্ধ ছিলেন। তারা এখন সময় সুযোগ বুঝে প্রতিবাদ করছেন।

তিনি বলেন, সরকার আমাকে নিয়োগ দিয়েছে, সরকার যদি মনে করে তাহলে আমি চলে যাব।

অনেক দপ্তর প্রধান স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছেন আপনিও কি করবেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটি সাংবিধানিক দপ্তর নয়। আমি হঠাৎ পদত্যাগ করলে প্রশাসনিক শূন্যতা তৈরি হতে পারে।

এনএম/এসকেডি

Visit Source Page

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *